somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিটাগং ও গুগল স্যাটেলাইট

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গতরাতে কিছু একটা হলো। সবাই ছিল ঘুম, আমি ঘুম আনার জন্য নেটফ্লিক্স দেখছিলাম। হঠাৎ সব বাদ দিয়ে ল্যাপটপ খুলে গুগল ম্যাপে টাইপ করলাম কাতালগঞ্জ, চিটাগং। তারপর খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম আমার শৈশবের বাড়িঘর। স্যাটেলাইট ভিউতে ক্লিক করে মুহূর্তেই ফিরে গেলাম আমার শৈশবে। বুক তখন কাঁপছে দুরুদুরু করে। আমি যেন দাঁড়িয়ে গেছি সেই ৯২ সালের কাতালগঞ্জের রাস্তায়।
প্রথমেই খুজলাম এক নম্বর রোডের শেষের কোনায় আমাদের বাড়িটিকে। চারতলা উঁচু দুইটি বিল্ডিঙে মোট ষোলটা ফ্ল্যাট ছিল সেখানে। ষোলটি পরিবার মিলে আমরা ছিলাম এক বিরাট যৌথ পরিবার। এর ঘরে গিয়ে ও ভাত খেয়ে এসেছি, তার বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছি। এর ওর উৎসবে সবাই মিলে আনন্দ করেছি। একের বিপদে সবাইকে এগিয়ে আসতে দেখেছি।
বৃদ্ধ বয়সে মানুষের স্মৃতি লোপ পায়। ভুলে যায় নিজের নাম, নিজের প্রিয় মানুষ, আপনজন সবাইকে। কিন্তু কিছু স্মৃতি তাঁর সাথে তাঁর কবরে যায়। কাতালগঞ্জ জীবন আমার কাছে এমনই।
সেই ক্লাস টুতে পড়া অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম সিলেট। ছাব্বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। মাঝেমাঝে যাওয়া হতো। তাও কয়েক ঘন্টার জন্য কেবল। একে একে সব পরিবার যখন সেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন, আর কখনই যাওয়া হয়নি। শেষবার গিয়েছিলাম অনেক পরে, কলেজে পড়ি তখন। দেখি আমাদের ফ্ল্যাটে আর মানুষ থাকে না। স্কুল হয়ে গেছে ততদিনে। খুব অবাক হয়েছিলাম ফ্ল্যাটগুলোর সাইজ দেখে। কত ছোট ছোট একেকটি ইউনিট। অথচ সেই সময়ে মনে হতো কত বিশাল আমাদের ভূবন!
এইবার গুগলে সেই বাড়িটি খুঁজে পেলাম না। অথচ আমি নিশ্চিত এখানেই ছিল বাড়িটি। রাস্তার উল্টো দিকের মসজিদ (শেখ বাহার উল্লাহ জামে মসজিদ) দেখে ঠিকই চিনলাম। মোঘল নকশায় নির্মিত ও সজ্জিত মসজিদের ছাদের মোজাইকের কাজটি আমার চোখের সামনেই হয়েছিল। এই মিস্ত্রিরাই পরে সিলেটে আমাদের বাড়ির মোজাইকের কাজ করেছিল। আমার রুমের জানালা দিয়ে রাস্তার ওপারে মসজিদের ছাদে মোজাইক মিস্ত্রিদের কাজ দেখাটাই ছিল আমার শৈশবের বিনোদন। শিশুদের আনন্দিত হতে বিশেষ কিছুর প্রয়োজন হয়না।
মসজিদের লাগোয়া কবরস্থান। বলা ভাল, কবরস্থানের উপরেই মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে। ঝোপ ঝাড় দেখেই বুঝা যেত অতি প্রাচীন এর বয়স। জীবনে মাত্র একবারই কাউকে সেখানে কবর দিতে দেখেছিলাম। রাতের বেলা বাতি জ্বালিয়ে গোর খোদকেরা কবর খুঁড়ছিল। আমার বোন সেটা দেখে নানা অশরীরীর গল্প শুনিয়েছিল। ভয়ে সে রাতে ঘুমাতে পারিনি।
অল্প বৃষ্টি দিলেই রাস্তায় হাঁটু পানি জমতো। আমাদের নিচতলার ফ্ল্যাটগুলোয় পানি ঢুকে যেত। বন্যার পানি এক ভাড়াটের দামি কার্পেট নষ্ট করে ফেলেছিল। রক্ত বর্ণ হয়ে উঠেছিল সিঁড়ির গোড়া। তারপর বাড়িওয়ালা বাধ্য হয়ে নিচেরতলার প্রতিটা ফ্ল্যাটের দোরগোড়া এক ফুট উঁচু করে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করে দিয়েছিলেন।
রাস্তায় পানি কেটে এগিয়ে যেত রিকশা, সাইকেল, লুঙ্গি উঁচিয়ে বা প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটতো মানুষ। গাড়ি গেলে বিশাল ঢেউ উঠতো। দুপাশের দেয়ালে আঘাত করে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলতো। সেটা দেখাতেও খুব আনন্দ ছিল।
একবার মনে আছে সেই পানি সাঁতরে এক বিশালাকৃতির কালো সাপ রাস্তার এপার থেকে কবরস্থানের ঝোপে পালিয়েছিল। এতদিন সাপ কেবল দেখেছি বেদ বেদেনীর হাতে। কিংবা ভিসিআরে "নাগিন" সিনেমায়। জংলী সাপ সেই প্রথম দেখা। শিহরিত হয়েছিলাম খুব। সেই সাপ আবারও দেখার আশায় এরপর প্রতি বৃষ্টির দিনে জানালায় বসে রাস্তার পানির দিকে অপলক তাকিয়ে থেকেছি। সাপ দেখা হয়নি আর। মাঝে বৃষ্টির প্রেমে পড়ে গেছি।
বৃষ্টি ছাড়াও জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি মানুষ দেখতাম। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষ। ভিক্ষুক, পথচারী, টোকাই, শ্রমিক, চাকরিজীবী - নানা ধরনের মানুষ। এরশাদ পতন আন্দোলনের জ্বালাময়ী সব মিছিল, এরশাদ সরকারের দেয়া কারফিউর সময়ে ফাঁকা রাস্তাঘাট, মিলিটারি ট্রাকের যাওয়া আসা, বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে জঙ্গি মিছিল, গল্ফ ওয়ার চলাকালে সাদ্দামের সমর্থনে মিছিল, এমনকি নব্বই বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর আর্জেন্টাইন সমর্থকদের "রেফারির ফাঁসি চাই" মিছিল - সব আমার এই জানালাতেই বসে দেখা। স্যাটেলাইটপূর্ব যুগে এটিই ছিল আমার চৌকোনা বোকাবাক্স।
গুগলে আমাদের সেই বাড়িটি আস্ত খুঁজে পেলাম না। মানে অর্ধেকটা পেলাম শুধু। দুই নম্বর বিল্ডিং এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সাদা রং পাল্টে সবুজ করা হয়েছে। সেটি এখন "সারাদিনের স্কুল এন্ড কলেজ" ক্যাম্পাস। সাথে হোস্টেল। আমাদের এক নম্বর বিল্ডিংটি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। দেয়াল জুড়ে নীল রংয়ের বিশাল সাইন বোর্ড। রাজা প্যালেসের বিজ্ঞাপন। ফ্ল্যাট বিক্রি করছে তাঁরা। ১৩৫০ স্কয়ার ফিটের প্ল্যান এ, এবং ১৩০০ স্কয়ার ফিটের প্ল্যান বি। নিচে যোগাযোগের ঠিকানা। আমাদের সময়ে প্রতিটা ফ্ল্যাটের সাইজ কত ছিল? মনে নেই। দুই কামরার সংসার ছিল আমাদের। বাবা-মায়ের এক ঘর, সেখানে ছোট ভাইকে নিয়ে তাঁরা থাকতেন। দাদির ঘরে দুইটা বিছানা পাতা, সাথে পড়ার টেবিল, চেয়ার। দাদির সাথে আমরা দুই ভাইবোন থাকতাম সেখানে। দাদার স্মৃতি তেমন একটা ছিল না। শুধু মনে আছে তাঁর বিছানায় তিনি তসবিহ হাতে বসে ছিলেন, আমাকে কাছে ডাকছেন।
আরেকটা স্মৃতি আমাদের ড্রয়িং রুমে। সাদা কাপড় জড়িয়ে তিনি খাটিয়ায় শোয়া। তাঁকে ঘিরে লোকজন কান্নাকাটি করছে।
বিকেলে সব বাচ্চারা একসাথে নিচে নেমে আসতো। ষোলোটা পরিবারে বাচ্চাকাচ্চার সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল না। হাডুডু, ছোঁয়া ছুঁই, বরফপানি, কুমির কুমির, রান্নাবাটি থেকে শুরু করে ক্রিকেট ফুটবল সব ধরনের খেলাই হতো। ক্রিকেট খেলার সময়ে বল প্রায়ই দেয়াল টপকে রাস্তার ড্রেনে চলে যেত। আমরা ছোট ছিলাম, আমাদের গেটের বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল। দারোয়ান জাহাঙ্গীর ভাই এবং জামাল ভাই দুইজনের কড়া দৃষ্টি থাকতো আমাদের বয়সী বাচ্চাদের দিকে। বাইরে থেকে বল আনতে ছুটে যেতেন আশরাফ ভাইয়া, টুটু ভাইয়া, রাশেদ ভাইয়ারা। লোহার গেট দুটো এখনও আছে। শুধু রং পাল্টে লাল থেকে নীল হয়েছে।
রাস্তার ওপারে ছাপড়া দোকানগুলো এখনও একই আছে। সেবানিকেতনের অফিসটাও তাই। তার সামনে কলা বনরুটির দোকানটিও। পেছনের গ্যারেজটারও চেহারা পাল্টায়নি। এর পাশের জংওয়ালা টিন শেডের দোকানগুলোরও পরিবর্তন নেই। এক সময়ে কোক-পেপসির বিজ্ঞাপন উপরে থাকতো, এখন মোজোর। পেছনে একটি বুড়ো বটগাছ ছিল। রাস্তা থেকে সেটাকে খুঁজে পেলাম না। অনেক শেকড় ঝুলতো তার ডাল থেকে। টিভিতে দেখতাম এমন শেকড় জড়িয়ে ধরেই টারজান এক গাছ থেকে অন্য গাছে যেত।
মসজিদ ভবনের শাহ আমানত স্টোর বা মেসার্স হক ফার্মেসিরও কিছু বদলায়নি। মনে আছে এরশাদের কারফিউর সময়ে সেখানে রেস্টুরেন্ট খোলা ছিল। মিলিটারি ট্রাক আসতে দেখে চোখের পলকে শাটার নামিয়ে কর্মচারী ও কাস্টমার সহ ভিতরে ঢুকে যায় মালিক। মিলিটারি জওয়ানেরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বাইরের চুলা, কড়াই ইত্যাদি তছনছ করে ফেলে। ওরা বিদায় নেয়ার পরে আবারও শাটার খোলা হয়। বেরিয়ে আসেন দোকানের কর্মচারী, কাস্টমার। দোকান বন্ধ রাখলে পেট চলবে? সেই দোকানের পরোটা খেতে এত ভাল লাগতো! আম্মু রুটি বানালে খেতে চাইতাম না। আমার ঐ পরোটাই লাগবে। জিফরানেরও একই জেদ। আমাদের মায়েরা তখন রাগ করে বলতেন, আমরা পরিষ্কার হাতে রুটি বানালে তোদের ভাল লাগেনা। ঘাম ওয়ালা ব্যাটাদের নাকের সর্দি ওয়ালা রুটি খেতে খুব মজা লাগে, না?
কী জানি, আমাদের মনে তখনও ঘেন্না আসতো না। চিনি দিয়ে খেতাম। মনে হতো বেহেস্তি খাবার খাচ্ছি।
এক বিন্দু থমকে চিন্তা করলাম জিফরান চলে গেল ইংল্যান্ড, আমি থাকি অ্যামেরিকা, জেরিফ-মিনহাজ ভাইয়া ঢাকায়...বাকিদের কে কোথায় আছেন কোন খোঁজ জানিনা। আমাদের কারোরই বাবারা এখন পৃথিবীতে নেই। আমাদের জীবনের কত পরিবর্তন হয়ে গেল; ওদের জীবন কী এখনও ওখানেই থমকে আছে? যেই দোকানদারের কাছ থেকে আমাদের কাজের মেয়ে নসিরন বিনে পয়সায় লজেন্স এনে আমাদের খাওয়াতো, সেই দোকানদার কী এখনও সেখানেই বসে? রাস্তা পেরুতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল জেরিফ, তাঁর উপর দিয়ে যাত্রীসহ রিকশা চলে গেল, তখন টেইলার্সের দোকান থেকে ছুটে এসেছিল যেই ভদ্রলোক, সে কী এখনও ঝিম ধরা চেহারায় লোকজনের শরীরের মাপ নেয়?
কিছুক্ষণ হাঁটলাম শৈশবের গলি ধরে। রাস্তার ধারে একটি ডাস্টবিন ছিল, খুঁজে পেলাম না। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের পোষা কুকুর লালি তাঁর বাচ্চাকাচ্চা সহ অসুখে মারা গিয়েছিল। সবার স্থান হয়েছিল সেই আস্তাকুঁড়ে। পঁচা গন্ধ ছেড়েছিল তাঁদের শরীর। পথচারীরা নাক চেপে সেই রাস্তা ধরে হাঁটতেন। আমরা বাচ্চারা সেটা করতাম না। আমাদের মনে হতো এতে লালি ও তার বাচ্চাদের অপমান করা হবে। যাকে ভালবাসা হয়, তাঁকে অপমান করতে নেই।
একনম্বর রোড ধরে হেঁটে এগুলাম পাঁচলাইশ রাস্তার দিকে। কোনই পরিশ্রম নেই, মাউসের এক ক্লিক আমাকে কয়েক কদম এগিয়ে নেয়। আমি দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাই। কিছু বাড়ি চিনতে পারলাম, কিছু মনে হলো নতুন হয়েছে।
রাস্তার একদম মাথায় আমার জীবনের প্রথম স্কুল। লিটল জুয়েলস। একবার স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাওয়ায় আপুর নেতৃত্বে এই রাস্তা ধরে আমি এবং জিফরান বাসায় চলে আসায় আমাদের মায়েদের সে কী ভয়! যদি ছেলেধরা উঠিয়ে নিয়ে যেত!
স্কুল ভবনের সামনে জাতীয় পতাকা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তা থেকে ছোট্ট মাঠটি দেখা যায় না। দেয়ালের ওপাশেই মর্নিং স্টার কিন্ডার গার্টেনের ক্যাম্পাস। যার উল্টোদিকে বিচিত্রা লাইব্রেরি। আমাদের বই খাতা থেকে শুরু করে সংগ্রহের জন্য দেশবিদেশের স্ট্যাম্প কেনা - সবকিছু হতো এই লাইব্রেরিতেই। পঞ্চম জন্মদিনে এক আন্টি আমাকে "আলাউদ্দিন ও আশ্চর্য্য প্রদীপ" নামের একটি উপন্যাস উপহার দিয়েছিলেন এই লাইব্রেরি থেকেই। আমার জীবনে পড়া প্রথম কিছু বইয়ের একটি সেটি।
পাঁচলাইশ থানা এখনও তেমনই আছে। জব্দ করা রিকশা, গাড়ি, মোটর সাইকেল সামনের দিকে জমা করে রাখা হতো। এখন সেখানে বেবি টেক্সির জায়গা সিএনজি নিয়েছে।
এর উল্টোদিকে একটি কমিউনিটি সেন্টার ছিল মনে আছে। "ফেস্টিভ্যাল" ছিল হয়তো নাম। এখন দেখি একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে "দি কিং অফ চিটাগং" নামের। এর পাশেই আলিশান আধুনিক ফ্ল্যাট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সময়ে কী সেটা ছিল? মনে করতে পারলাম না। আরেকটু সামনে এগিয়ে বাঁ পাশের এক বাড়িতে দেখলাম স্লাইডিং গেট। আব্বু চাইতেন আমাদের সিলেটের বাড়িতে এমনই গেট দিতে। ধাক্কা দিলে সাইডে সরে খুলবে। সেটা করা হয়নি। আরেকটু সামনে ডানদিকে প্রবর্তক বিদ্যাপীঠের ক্যাম্পাস। যতবার এর পাশ দিয়ে আমরা যেতাম, আম্মু আঙ্গুল তুলে বলতেন, এটি আমার স্কুল। আম্মুও যে একসময়ে আমাদের সমান ছিলেন, স্কুলে যেতেন, প্রথমে বিশ্বাসই হতো না।
এক সময়ে আমরা নিজেরাই এর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলতাম, এটি আম্মুর স্কুল।
মনে হয় এককালে দূর্গা পূজার মেলা হতো এর আশেপাশে কোথাও। এখনও কী হয়?
গুগলে ধোঁকা খেতে পারি, তবে জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদটিতেই আমরা ঈদের নামাজে যেতাম। মাঠে বসে ভাবতাম এটিই বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর সুন্দর মসজিদ। নামাজের কিছুই জানতাম না, বুঝতাম না। আব্বুর সাথে তবু ঈদের দিন সকাল সকাল যেতে মজা লাগতো। কিছুক্ষন পরপর আব্বু আনন্দিত স্বরে বলতেন, দাঁড়িয়ে মানুষ দেখো। আমি দেখতাম চারপাশে সাদা টুপি মাথায় হাজার হাজার মানুষ। মানুষ দেখার মধ্যে এত আনন্দের কী আছে, সেটা বুঝতাম না।
গরীবুল্লাহ শাহ মাজারও পাশ কাটিয়ে গেলাম। এই স্থানে যাওয়া ছাড়া আজ পর্যন্ত চিটাগংয়ের মাটিতে একবারও পা রাখিনি। আমার দাদা শুয়ে আছেন সেখানে। রমজান নামের এক লোক তাঁর কবর দেখা শোনা করতেন। পয়সা দিলে নতুন বেড়া দিতেন, বেড়ায় রঙও দিতেন। পয়সা না দিলে দেখা যেত বেড়া নেই। রমজান কী এখন বেঁচে আছে? সে কী এখনও কবর দেখভাল করেই জীবন কাটায়?
ইস্পাহানীর মোড়ের "হাইওয়ের" মিষ্টি ছিল আমার খাওয়া পৃথিবীর সেরা মিষ্টি। বনফুলের পাশের গলি ধরে ছিল নানুর বাসা। লালখান বাজারে। প্রতি শনিবার সকালে আমরা চলে যেতাম নানুর বাসায়। সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় ফিরতাম। নানা আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে বিকেলে পাহাড়ে হাটতে বেরুতেন। পাহাড়ে মানুষের পাশাপাশি ছাগল চড়ে বেড়াতো। আমরা ছাগলকে ঘাস পাতা খাওয়াতাম। মামারা খাঁচায় ফাঁদ দিয়ে পাখি ধরতেন। কয়েকদিন পুষে ছেড়ে দিয়ে আবারও নতুন পাখি ধরা হতো। পাহাড় থেকে দূরের সমুদ্র দেখা যেত। তাতে ভাসতো জাহাজ। সন্ধ্যায় সেই সমুদ্র সূর্যকে গিলে খেত। পাখিদের মতন আমরাও বাড়ি ফিরতাম। নানা আমাদের কবিতা মুখস্ত করাতেন।
"আমি হবো সকাল বেলার পাখি,
সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি ডাকি।"
আমরা সব ভাইবোন তখন এক স্বরে আওড়াতাম, "আমি হবো সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি ডাকি।"
লালখান বাজারের সেই পাহাড় থেকে কী এখনও সমুদ্র দেখা যায়?
আমাদের তিন ভাইবোনের জন্ম যে ক্লিনিকে (শাহেদা করিম ক্লিনিক বা এইরকম কিছু একটা নাম ছিল) সেটি খুঁজে পেলাম না। আমার বোনের জন্মের সময়ে যে ডাক্তার আমার বাবাকে বলেছিলেন, "মনে রাখবেন, আমিও আমার বাবার মেয়ে।"
ভদ্রমহিলা ভেবেছিলেন "মেয়ে" জন্মের সংবাদে আমার বাবা বুঝিবা মন খারাপ করেছেন।
আমার বাবা আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে আমার বোনকেই বেশি ভালবাসতেন। সেদিন তিনি খুবই ক্লান্ত ও নার্ভাস ছিলেন বলেই হয়তো ডাক্তার ভুল বুঝেছিলেন। অথবা তাঁর ডাক্তারি পেশায় কন্যাশিশুর জন্মদানের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই হয়তো আগে থেকে এই উক্তি করা।
এই ক্লিনিকেই আমার ভাইয়ের জন্মের পর কাঁচের জানালার ওপাশ থেকে অন্যান্য বাচ্চার ভিড়ে আমার ভাইকে দেখতাম।
মনে হলো আজ সেই বিল্ডিংয়ে অন্য কোন অফিস খোলা হয়েছে।
টাইগার পাস ধরে এগুলাম আরও কিছুদূর। বাঁয়ে রেলস্টেশন। সেদিকে আর গেলাম না। দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের উপর দিয়ে যাবার সময়ে সবসময়েই ভাল লাগতো। আমরা উপর দিয়ে যাচ্ছি, নিচে হাজার যাত্রী নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। সিলেট থেকে ট্রেনে যতবার চিটাং আসতাম, এই ওভারব্রিজ অতিক্রমের সময়েই মনে হতো আমি চিটাগং ফিরে এসেছি।
একবার দেওয়ানহাট রেলক্রসিংয়ে কোন অজানা কারনে ট্রেন আটকে গেছিল। রাস্তায় সব গাড়ি, রিকশা, টেম্পো আটকা পড়েছে। ট্রেন না সরলে কেউ ক্রস করতেও পারবে না। তখন শুরু হলো চাটগাইয়াদের বিখ্যাত গালাগালি। লোকে বলে ঢাকাইয়ারা নাকি গালাগালিতে ওস্তাদ। আমার ধারণা চাটগাঁইয়াদের কাছে ঢাকাইয়ারা দুগ্ধপোষ্য শিশু। অন্যান্য জেলার মানুষ যেখানে কুত্তার বাচ্চা-শুয়োরের বাচ্চা থেকে শুরু করে খাঙ্কির পোলায় দিয়ে থামে, চিটাগংয়ে গালি শুরুই হয় "চুদানির পুৎ" থেকে। শেষ কোথায় হতে পারে চিন্তাও করতে পারবেন না। তিন মিনিটের জন্য ট্রেন বন্ধ হয়েছিল। দেড় মিনিটের মাথাতেই বেচারা ড্রাইভারের চৌদ্দগুষ্ঠির পরিচয় পাল্টে ফেলেছিল লোকজন।
আচ্ছা, সিঙ্গাপুর মার্কেটই কী আমাদের সময়ের দুবাই মার্কেট? আমার মা চিটাগং যেতেনই কেবল এই মার্কেটে শপিং করার জন্য। সুন্দর ক্রিস্টালের জিনিসপত্র পাওয়া যেত। চকলেট, বার্মিজ আচারও মিলতো খুব। বিদেশী রেইনকোট, যা দেশের অন্য কোন মার্কেটে পাওয়া যেত না, সেটা পাওয়া যেত এই মার্কেটে। মায়ের যাবতীয় সঞ্চয় ব্যয় হতো ক্রিস্টালের থালাবাসন শো-পিস্ কেনার পেছনে। অ্যামেরিকায় স্থায়ী হবার সময়ে যখন সেসব ছেড়ে আসতে হলো, তখন মানব জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর শিক্ষাটা তিনি উপলব্ধি করলেন, এক জীবনে আমরা যাই করি না কেন, একদিন সব ছেড়ে যেতেই হয়।
হালিশহর রোড আমাকে নিয়ে গেল হালিশহরে। মাঝে আগ্রাবাদ পড়লো। বাবার অফিস ছিল সেখানে। ভেস্পা চালিয়ে প্রতিদিন অফিসে যেতেন বাবা।
লালখান বাজার থেকে মামারা বাসা বদলে হালিশহর মুভ করেছিলেন। বড়লোকদের এলাকা। বিশাল বিশাল বাড়ি। আধুনিক সব বাড়ি। লালখান বাজারেরটা ছিল নানীর সংসার, হালিশহরেরটা মামীর। বড় মামী আমাদের মায়ের মতোই আদর করতেন। ছোটবেলায় আমরা যখন ছড়া শিখছি, "তাই তাই তাই, মামার বাড়ি যাই। মামা দিল দুধভাত, পেট ভরে খাই। মামী এলো লাঠি নিয়ে, পালাই, পালাই।"
মামী তখন কপট রাগ করে বলতেন, "এই, আমি কী তোদের লাঠি নিয়ে তেড়ে আসি?" আমরা সমবেত স্বরে বলতাম, "না।"
নিঃসন্দেহে এই কবির মামীভাগ্যের চেয়ে আমাদের মামীভাগ্য ভাল ছিল।
আরও কিছুক্ষন এখানে ওখানে হেঁটে বেড়ালাম। কাতালগঞ্জের দিকে তেমন বদল না ঘটলেও চিটাগং শহর বদলে গেছে অনেকটুকু। কোথাও কোথাও দেখলাম ফ্লাইওভার তৈরী হয়েছে। কোথাও কোথাও কোন কোন রাস্তার মোড়ে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছি, পথ খুঁজে না পেয়ে জুম আউট করে আবার পরিচিত কোন ঠিকানা থেকে ঘোরাঘুরি শুরু করেছি।
যাওয়া হয়নি স্টেডিয়াম এলাকায়, যেখানে বিজয় মেলা হতো। যাই নি পাথরঘাটার পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীর ধারে। বাতাস এসে এলোমেলো করে দিত চুল। যাইনি পতেঙ্গায়, নেভাল বীচে। ভাজা গরম গরম ছোট পেঁয়াজু এবং কাঁকড়া ভাজা খেতে - যা ছিল বিশ্বসেরা! যেতে পারলাম না মিমি সুপার মার্কেটে, যেখানে জীবনে প্রথম এস্কেলেটর চড়েছিলাম।
অন্যদিন যাওয়া যাবে। তোলা থাকলো।
কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষকে তাঁর জন্মভূমির মাটি টানে। ঘটনা সত্য। সেই টান খুব কঠিন টান।
গুগলকে ধন্যবাদ। এক রাতেই আমাকে জন্মভূমিতে ফিরে যাবার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:১১
৫টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×