"ভাষ্কর্য্য নিয়ে কিছু লিখেন নাই?"
ফালতু বিষয় নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করেনাই, তাই লেখা হয়নাই।
তবে যেহেতু কেউ কেউ এপ্রোচ করেছেন, তবে নিজের কিছু ধারণার কথা বলি।
প্রথম কথা, আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যেখানে যেদিকেই তাকাই, সমস্যাই সমস্যা নজরে আসে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে ট্রাফিক জ্যাম হয়ে রাস্তাঘাটে খানাখন্দ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট ইত্যাদি হয়ে সরকারি দপ্তরে পিয়ন থেকে মন্ত্রী পর্যায়ে দুর্নীতি, চিটারি, বাটপারি, অরাজকতা, ছিনতাই, গুম, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, পুলিশ কর্তৃক চাঁদা আদায়, অনাদায়ে খুন, ক্রসফায়ার, বিচারহীনতা, ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি কি নেই দেশে? সেখানে এসব কিছু ফেলে কেবল ভাষ্কর্য্য নিয়ে পড়ে থাকা কতটা যৌক্তিক? ইসলামিক দলের কি ধারণা ভাষ্কর্য্য গায়েব করে দিলেই দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? মাদ্রাসা শিক্ষক শিশু বলাৎকার বন্ধ করে দিবে?
"সকল মূর্তিই ভাষ্কর্য্য কিন্তু সকল ভাষ্কর্য্যই মূর্তি নহে" জাতীয় থিওরি আমি কপচাবো না। ওসব ইসলামিক পন্ডিতদের কাজ। তাঁরা ব্যাখ্যা করবেন। আমি শুধু জানি ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রুর নাম মিসরাধিপতি ফেরাউন। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ এই বদমাইশকে তীব্রভাবে তিরস্কার করেছেন। সেই ফেরাউনের দেশ মিশর হজরত উমারের (রাঃ) খেলাফতেই মুসলিমদের হাতে আসে। পতন ঘটান হজরত আমর ইবনে আল আস (রাঃ)। বিখ্যাত সাহাবী। মক্কা থেকে হিজরত করা শেষ সাহাবীদের একজন তিনি। তাঁর সম্মান কিন্তু আল্লাহর কাছে অনেক। তা হজরত উমারের (রাঃ) শাসনামলে রাজ্যময় সাহাবী গিজগিজ করতেন। একেকজন সাহাবী আমাদের যুগে হাজার খানেক আলেমের চাইতেও কোটিগুন বেশি মর্যাদার অধিকারী। তা সেই সাহাবীদের দখলে থাকার পরেও ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন ফেরাউনের মূর্তি/ভাষ্কর্য্য/স্থাপনা/দেবদেবীর মূর্তি কোনটাই ভাঙা হলো না কেন? মুসলিমরা সেগুলোর পূজা করেনি, অন্যরাও করতো না। ওগুলো ছিল পরিত্যক্ত সম্পদ। প্রত্নতাত্বিকরা এখনও নিত্যই আবিষ্কার করে চলেছেন সেগুলো। সাহাবীরা চাইলেই কিন্তু ধ্বংস করতে পারেন। করেননি কেন? আমার ধারণা তাঁরা হয়তো ভাষ্কর্য্য রাখা না রাখা জাতীয় ফালতু কাজে সময় ব্যয় না করে জাতি গঠনের মতন মহৎ কাজে সময় ব্যয়ে আগ্রহী ছিলেন। আপনাদের কি মত? কি যুক্তি দিবেন? এই ইসলামী দল কি ধর্ষণের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে পারতো না? দুর্নীতির বিরুদ্ধে? মাজার ব্যবসা বা পীরাকি ভণ্ডামি ইত্যাদি ইসলামের সরাসরি ক্ষতি করছে। এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কবে নিবে? কবে দেখবো এইসব ইসলামী দল মাজারে মাজারে হানা দিয়ে গাঁজা সেবন, শিরকী কর্মকান্ড সমূলে উৎপাটন করছে?
এদিকে সরকারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে।
আওয়ামীলীগ নিজের কর্মীদের টাকায় ভাষ্কর্য্য কেন, বিস্কুট ফ্যাক্টরি দিক, তাজমহল বানাক, যা খুশি তাই করুক, কোনই সমস্যা নাই। কিন্তু সরকার যখন জনগনের টাকা দিয়ে ভাষ্কর্য্য নির্মাণ করতে চাইবে, তখন একদল লোক যদি শান্তিপূর্ণভাবে আপত্তি তোলে, আমি তাতে কোনই সমস্যা দেখি না। কারন এটাই গণতন্ত্র। যেহেতু জনগনের কষ্টের টাকায় সরকার চলে, তাই জনগনের অধিকার আছে সেই টাকা কোথায় কোন খাতে ব্যয় হবে তা নিয়ে মত প্রকাশ করার।
যেমন আমি জন্মের পর থেকেই দেখছি আমার দেশের চিকিৎসা খাত দুর্নীতিতে ভরপুর। আমার আব্বুর চিকিৎসা করতেন যে ডাক্তার আংকেল, তিনি নিজে অসুস্থ হলে ছুটতেন ইন্ডিয়াতে। দেশের মন্ত্রী মিনিস্টার কয়জন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়? আমার টাকায় যখন তোমার চিকিৎসা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর আমেরিকায় হচ্ছে, তাহলে আমার টাকায় আমার দেশে আমার কেন এত বাজে চিকিৎসা হবে? দেশের শ্রেষ্ঠ ডাক্তার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিক্যালের বেডে তেলাপোকা গিজগিজ করে। আর কি বলবেন?
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর হতে চললো, এখনও আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, এর বাজেট যদি উন্নত বা মাঝারি মানের কোন দেশের নাগরিককে বলি, সে চোখ কপালে তুলে ফেলে। এই যে কয়েকদিন ধরে "বোনম্যারো দান করুন, বোনম্যারো দান করুন" বলে বলে চিল্লাচ্ছি, দেশের অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তাঁরা দিতে আগ্রহী। কিন্তু শালার একটা সিস্টেম নাই যেখানে সবার ডিএনএ স্যাম্পল কালেক্ট করে রাখবে, যাতে যখন কোন রোগীর প্রয়োজন হবে, তখন সেটা সহজেই সার্চ করে পাওয়া যায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বান্ধবীর শিশু সন্তান ছয় সাত বছর ধরে বোনম্যারোর সন্ধানে অপেক্ষায় আছে। বেচারাকে ইন্ডিয়াতে গিয়ে স্যাম্পল দিতে হলো। ওরা বিশ্বব্যাপী সার্চ করে সন্ধান পেলে জানাবে বলেছে। অথচ যে দেশে ম্যাচ পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যে দেশে অনেকেই আগ্রহী শিশুটিকে সুস্থ একটি জীবন দিতে, সেই দেশেই সামান্য ডাটাবেজ সিস্টেম নাই। কারন সেই দেশেরই এক সরকারি দপ্তরের ড্রাইভার দুর্নীতির টাকায় আলিশান বাড়িতে থাকে। এরচেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে?
আমি দেখছি দেশে এখনও প্যারামেডিক্স সহ এম্বুলেন্স ব্যবস্থা নাই। একটা বয় অক্সিজেন সিলিন্ডার সহ হাজির হয়ে যাবে। রোগীকে যে বাড়িতেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হসপিটাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে আনার ব্যবস্থা করবে, সেই বিদ্যা, ধ্যান ধারণা কিছুই তাদের নেই। অসংখ্য রোগীর মৃত্যু তাই এম্বুলেন্সেই ঘটে।
আমি দেখছি আমার দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য নেই। চোর এসে চুরি করে চলে যাচ্ছে, খুনি এসে খুন করে চলে যাচ্ছে, পুলিশ আসতে আসতে কমসে কম আধা ঘন্টা সময়তো লাগছেই। ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশি। অথচ উন্নত বিশ্বে দুই তিন মিনিটেই পুলিশি সাহায্য এসে হাজির হয়।
ফায়ার সার্ভিসের ক্ষেত্রেও ঘটনা একই। সেদিন মধ্যরাতে ফোন দিয়েছি, দেড় মিনিটে আমার বাড়ির সামনে ফায়ার ট্রাক এসে উপস্থিত। আর আমার দেশের কথা বাদই দিলাম। "ফায়ার হাইড্রেন্ট" সেই উনিশ শতকের আবিষ্কার। বিশ্বের প্রতিটা আধুনিক দেশের প্রতিটা শহরে আছে। আজ পর্যন্ত আমাদের বাংলাদেশে এর দেখা মিলল না। কেন ভাই, বঙ্গবন্ধুর নামে ভাষ্কর্য্য নির্মাণ না করে সেই টাকায় এসব কল্যাণমুখী কাজ করা যায় না?
আমি দেখছি শিক্ষা দীক্ষায় আমার দেশ এখনও পিছিয়ে আছে। লোকজন মুখস্ত বিদ্যায় পাশ করে বেরুচ্ছে। শিক্ষার মান ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে। শিক্ষার পেছনে, শিক্ষকদের পেছনে বাজেট নেই সরকারের?
সিঙ্গাপুরের সাথে একই সময়ে স্বাধীন হওয়া দেশটি আজকে কোথায় পড়ে আছে, আর সিঙ্গাপুরিরা কোথায় পৌঁছে গেছে। অথচ স্বাধীনতার সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের কী স্বপ্নটাই না ছিল! আমরা পারতাম এতদিনে বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ হতে। আমরা পারতাম দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্ব দিতে। জনশক্তি, মেধা, প্রাকৃতিক সম্পদ সব ছিল এবং আছে আমাদের। কিন্তু তারচেয়ে বেশি আছে চ্যালা চামচা তেলবাজদের সংখ্যা। সঠিক লোক সঠিক স্থানে যদি নিয়োগ পেত, দুর্নীতির সাথে কোন অবস্থাতেই আপোষ করা না হতো, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হতো, এক জেনারেশনের মধ্যে আমাদের মেরুদন্ড জালিবেতের মতন সোজা হয়ে থাকতো।
এইসব বাদ দিয়ে আমরা পড়ে আছি রাস্তায় রাস্তায়, কোণায় কোণায় ভাষ্কর্য্য নির্মাণ হবে কি হবে না সেই বিতর্কে।
বঙ্গবন্ধুর নাম প্রতিষ্ঠিত করতেই এই ভাষ্কর্য্য নির্মাণতো? কেননা বঙ্গবন্ধুর নামেই ঐ একই টাকায় একেকটি জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হোক? "বঙ্গবন্ধু ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট" যেখানে আন্তর্জাতিক মানে ক্যান্সার রোগের গবেষণা হবে। ইমরান খানের মা ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন বলে তিনি শপথ করেছিলেন নিজ দেশে একটি ক্যান্সার রিসার্চ হসপিটাল করবেন। আজকে শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হসপিটাল বিশাল একটি নাম। সরকারি টাকায় হয়নি, মানুষের ভালবাসায় হয়েছে। উদ্যোগটা সরকার নিক, লোকজন ভালবেসেই একেকটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে দিবে।
আমার দেশের মধ্যবিত্তের এক শ্রেণীর বিশাল সংখ্যক মানুষ আজও মাসের শেষের দিকে একবেলা খেয়ে বেঁচে থাকেন। মাথার উপর ছাদ আছে, এই যথেষ্ট। কারোর কাছে হাত পাততে লজ্জা পান। আমার দেশের বস্তিতে বৃদ্ধ বৃদ্ধা দম্পতি মুড়ি খেয়ে রোজা ভাঙে। প্রতিবন্দি শিশুর মা নিজের সন্তানকে কুকুরের মতন খুঁটির সাথে বেঁধে কাজে যান। নাহলে খাওয়া জুটবে না। এইসব আমি মানতে পারিনা।
সেদিন ইত্যাদিতে দেখলাম রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক বৃদ্ধ বৃদ্ধা দম্পতি এতিম ও সমাজ পরিত্যক্ত শিশু ও আশ্রয়হীন বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে নিজেরাই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধফেরত স্বাধীন দেশে ফিরে শহীদ সহযোদ্ধাদের এতিম শিশুদের অনাহারে অবহেলায় ঘুরে বেড়াতে দেখে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেন। এবং তারপরে আরও বহু বছর পরে ১৯৮৪ সালে গড়ে তোলেন এক এতিমখানা। এই হচ্ছে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক আর ভন্ডদের মধ্যে পার্থক্য। এই ভদ্রলোক নিজের দেশের মানুষদের কল্যাণ নিয়ে ভেবেছেন। আর আমাদের নেতানেত্রীরা পড়ে আছেন ভাষ্কর্য্য গড়া না গড়া নিয়ে।
স্বাধীনতার আরও পঞ্চাশ বছর যাক। আমি বেঁচে থাকবো না নিশ্চিত। এবং বাংলাদেশেরও কোন পরিবর্তন হবে বলে মনে হয়না।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০২০ সকাল ৯:৩৬