ডিপ্রেশন একটি মানসিক ব্যাধি। মন খারাপ থাকা আর ডিপ্রেশন এক জিনিস না। মা বকা দিল, আর অমনি আমি "আমাকে কেউ বালুবাসে না" ভেবে নিজের রুমের কোণে পড়ে থাকলাম, সেটাকে মন খারাপ বলে। সেটার পেছনে সলিড কোন কারন থাকে, একটু পরে সেই মাই যখন বলে "ভাত খেতে আয়" তখন তা কেটে যায়।
কিন্তু ডিপ্রেশনের জন্য এমন সলিড কারন না থাকলেও চলে। উল্টো হাসি ঠাট্টা, খেলাধুলার মতন চরম আনন্দময় মুহূর্তকেও তখন ফিকে মনে হয়। টাকা পয়সা, অঢেল সম্পদ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, প্রেম ভালবাসা, সাকসেসফুল ক্যারিয়ার ইত্যাদি সব কিছুকেই অর্থহীন মনে হয়। সেটা ডিপ্রেশন।
অনেকেই আবার দুইটাকেই গুলায় ফেলে, তাই ভেঙ্গে উদাহরণ দিয়ে বললাম।
তা হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের একটি আর্টিকেল মতে ডিপ্রেশনের কারন শুধু ব্রেইনের কেমিক্যাল ইমব্যালেন্সই নয়, এর জটিলতা আরও গভীরে। বছরের পর বছর ধরে চালানো গবেষণা ইঙ্গিত করে যে ডিপ্রেশন শুধুমাত্র ব্রেইন কেমিক্যালের কম বা বেশি হয়ে যাওয়ার জন্যই ঘটে না, বরং এর পেছনে আরও অনেক কারন থাকে। যেমন ব্রেইন হয়তো আমাদের মেজাজ মতন রিয়েক্ট করতে ব্যর্থ বা ভুল করে, জিনগত দুর্বলতা, ঘটমান জীবনের স্ট্রেস বা টেনশন ইত্যাদি। আপনি হয়তো একই লক্ষনওয়ালা রোগী দেখবেন, বাইরের দিক দিয়ে তাঁদের দুইজনকে একই মনে হবে, কিন্তু তাঁদের ডিপ্রেশন হয়তো ভিন্ন ভিন্ন কারনে ট্রিগার করেছে, কাজেই তাঁদের চিকিৎসা পদ্ধতিও অবশ্যই ভিন্ন রকম হতে হবে। বর্তমান মনোবিজ্ঞানীরা অনেক কিছুই জানেন ডিপ্রেশন সম্পর্কে, কিন্তু ডিপ্রেশনকে পুরোপুরি বুঝে ফেলতে, বা একে জয় করতে তাঁদের এখনও আরও বহু গবেষণা, তথ্য, উপাত্তের প্রয়োজন আছে।
রোগটি আরও গভীরে ডুব দেয়। মানে ব্রেনের কোন কোন অংশ ডিপ্রেশনের সময়ে কিভাবে রিয়েক্ট করে সেটার ব্যাপারেও স্টাডি ও রিপোর্ট আছে। ওসব টেকনিক্যাল ব্যাপারে আপাতত না যাই। সেটা লিখে ফেললে একদল লোক আমার ইনবক্সে আসবে ডিপ্রেশনের রোগ নিরাময়ের ওষুধ জানতে। আরেকদল নিজেই নিজেকে ডাক্তার ভেবে অন্যের চিকিৎসা শুরু করে দিবে।
আপাতত যা বলতে চাইছি তা হচ্ছে,
১. যদি মেডিক্যাল লাইনে পড়াশোনা না থাকে, তাহলে নিজেকে ডাক্তার ভেবে বসবেন না। যদি আপনার মনে হয়ে থাকে কোন কারন ছাড়াই আপনাকে বিষন্নতা ভর করছে, তাহলে অবশ্যই মেডিক্যাল সাপোর্ট নিন। আপনার ব্রেইনের কোন অংশে হয়তো কোন কেমিক্যাল কম বা বেশি রিয়েক্ট করছে, ওষুধ ছাড়া তা সারানো সম্ভব না।
২. আবারও বলি, যদি মেডিক্যাল লাইনে পড়াশোনা না থাকে, তাহলে নিজেকে ডাক্তার ভেবে বসবেন না। অন্য কেউ যখন বলবে তাঁর বিষন্নতা আছে, তখন "এইটা করো, ঠিক হয়ে যাবে" টাইপ কথাবার্তা না বলে সে কি বলতে চায় শুনুন। ওকে প্রানভরে কথা বলতে দিন, ওকে ভরসা দিন যে ওর পরিস্থিতি আপনি বুঝতে পারছেন, এবং কোন মনোরোগ চিকিৎসকের সাথে কথা বলতে বলুন।
৩. আপনার নিজেরও যদি আগে ডিপ্রেশন থেকে থাকে, সেটা থেকে কোন ওষুধে বা টোটকায় ভাল ফল পেয়ে থাকেন, তবুও ওর চিকিৎসা ভিন্ন হবার সম্ভাবনাই বেশি। কাজেই, ওকে মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টে পাঠান, নিজে প্রেসক্রিপশন রচনা করতে শুরু করবেন না। আপনার ইনটেনশন ভাল হলেও এতে আপনি ওর ১০০% ক্ষতিই করবেন। ওর যদি আসলেই ভাল চান, তাহলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
৪. "যার ঈমান থাকে, সে কখনও ডিপ্রেস্ড হয় না" - শুধু অতি ফালতু ও আজাইরা বাক্যই নয়, বরং ইসলামবিরোধী কথাও। আমাদের রাসূলের (সঃ) জীবনীতেও একটা সময়ে তিনি ডিপ্রেস্ড ছিলেন। যদি সেটাকে ডিপ্রেশন নাও বলি, এঞ্জাইটি যে ছিল সেটাতো বলতেই হবে, এবং এর পরিপ্রেক্ষিতেই সূরা আদ-দুহা নাজেল হয়। পৃথিবীর অনেক অনেক অনেক দেশে ইসলামিক স্কলাররা ডিপ্রেস্ড রোগীদের চিয়ার করতেই এই সূরা বারবার পড়তে বলে। সূরাটি আসলেই ইন্সপায়ারিং। পড়ুন, বুঝুন, নিজের জীবনের ঘটনাগুলোর উপর এপ্লাই করুন, মনে হাতির বল পাওয়া উচিত। না পেলে অবশ্যই বুঝবেন আপনার ডিপ্রেশন আছে নিশ্চিত।
৫. ডিপ্রেশন যেহেতু একটি রোগ, কাজেই কোন চিকিৎসক বা মেডিক্যাল প্রফেশনাল ছাড়া অন্য কারোর কথাকে দুই পয়সার মূল্যও দিবেন না। হোক তিনি কোন মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট কোন ডিগ্রিধারী স্কলার, হোক তিনি দুর্দান্ত সেলিব্রেটি লেখক, অভিনেতা, খেলোয়াড় কিংবা হোক তিনি পৃথিবীখ্যাত কোন নেতা। হয়তো তাঁরা তাঁদের নিজস্ব ফিল্ডে একেকজন লেজেন্ড, কিন্তু মেডিক্যাল ফিল্ডে তাঁরা হাতুড়ে ডাক্তার। এবং হাতুড়ে ডাক্তারদের উপর ভরসা করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।
৬. ক্যান্সার, ডায়রিয়া, আমাশয়, করোনা ইত্যাদি যেমন ধনী গরিব দেখে আসেনা, কাজেই ডিপ্রেশনও আপনার ব্যাংক ব্যালেন্সের খোঁজ নিয়ে আপনাকে ধরবে না। এমন ভাবার কোনই উপায় নেই যে "আমিতো গরিব, আমার ডিপ্রেশন হবেনা - ওটা ধনীদের হয়।" আপনি পথের ফকির হলেও আপনার ডিপ্রেশন হবে, আপনি ইলন মাস্ক হলেও হবে। গরিব হলে, ডাক্তারের কাছে না গেলে, গন্ডমূর্খ হলে রোগটা সম্পর্কে জানবেন না, কাজেই ধরেই নিবেন "আজ আমার মন ভাল নেই। ইচ্ছা করতেছে তিনতলা বিল্ডিং দিয়ে নিচে লাফ দেই।" ওটাই ডিপ্রেশন।
এই যে আমি এতক্ষন লিখলাম, আবারও পড়ুন, ভাল করে পড়ে দেখুন কোথাও আমি এটাকে হাল্কা করে দেখিয়েছি কিনা, কোথাও বলেছি কিনা ওটা আপনাতেই সেরে যায়, কোথাও মনে হচ্ছে কিনা আমি বলার চেষ্টা করেছি ডিপ্রেস্ড রোগী আসলে ঢং করে, দুইটা চটকানা দিলেই লাইনে চলে আসবে, কিংবা এমনই কিছু। যদি কোন বাক্যে বা শব্দে তা মনে হয়ে থাকে, এখুনি আমাকে জানান, এডিট করে দিব। এটি অতি সিরিয়াস বিষয়। মোটেই হাল্কাভাবে নিবেন না। পরে দেখবেন আপনার অতি আপনজন কোন কারন ছাড়াই আত্মহত্যা করে ফেলেছে, এবং আপনি আফসোস করে মাথা চাপড়াচ্ছেন। তখন আপনার মনে হবে আপনি জানতেন, অথচ কিছু করেননি।
কিংবা কে জানে! রোগী হয়তো আপনি নিজেই, এবং কিছু ক্ষেত্রে আপনার নিজের উপরই কন্ট্রোল থাকবে না।