আমরা তখন নতুন নতুন সংসার জীবন শুরু করেছি। আমি ফুলটাইম চাকরি করি, যদিও এন্ট্রি লেভেলের বেতন। বৌ পার্টটাইম কাজ করে, ওও এন্ট্রি লেভেল। দুইজনের দুইটা টয়োটা ক্যামরি গাড়ি আছে যার একটির ইঞ্জিন গরম হলেই যখন তখন বন্ধ হয়ে যায়। সেই ছাত্রজীবনে কিনেছিলাম, প্রায় আট বছর চালিয়েছি। আর কত? বিক্রি করে নতুন গাড়ি কিনবো, সেই সাহস করছি না। নিজেদের বাড়ি নেই, এপার্টমেন্টে ভাড়া থাকি।
কিন্তু সব মিলিয়ে আমরা সুখী।
এই সময়ে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাদের অবস্থার পরিবর্তন করবেন।
এক রাতে আমার বৌ আমাকে জানালো সে প্রেগন্যান্ট।
এবং সেই মুহূর্ত থেকেই আমাদের জীবন পাল্টে গেল।
ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্টের জন্য মুখিয়ে থাকতাম। বাচ্চা কেমন আছে, কি করতে হবে, কি করা যাবেনা ইত্যাদি পরামর্শের পাশাপাশি সেই মেডিকেলে রাতের বেলা নতুন বাবা মায়েদের জন্য প্রফেশনাল নার্সরা কিছু ক্লাস নিতেন। এত তথ্যবহুল আর উপকারী যে সেসব ক্লাসে নিয়মিত মনোযোগ ধরে রাখলে আপনি নিজেই ধাত্রী ব্যবসা চালু করে দিতে পারবেন।
সময়ের চাকা গড়াতে লাগলো এবং মায়ের গর্ভে বাচ্চা বড় হতে লাগলো।
ওর হার্টবিট প্রথম শুনলাম। ধীরে ধীরে ওর আকৃতি গঠন হতে দেখলাম। ছোট্ট মাথা, গুটিশুটি মারা পা। মাঝে মাঝে ওর হাতের আঙ্গুলও স্পষ্ট দেখা যেত। মাঝে মাঝে ও ঘুমিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে মেশিনের দিকে ও ফিরে তাকাতো। এই সময়টা ছিল স্বর্গীয়, এই অনুভূতি ব্যাখ্যাতীত। আল্ট্রাসাউন্ড টেকনোলজি এতটাই ভাল লাগতো যে ইচ্ছা করতো যদি সামর্থ্য থাকতো, নিজের বাড়িতে একটা মেশিন কিনে কিছুক্ষন পরপর ওর চেহারা দেখতাম!
একসময়ে ডাক্তার জানালো ছেলে।
ছেলে/মেয়ে বা বংশের প্রদীপ-ফ্রদিপ নিয়ে আমাদের কোন কুসংস্কার নেই। সন্তান হচ্ছে আল্লাহর উপহার, তাঁর আমানত। তিনি খুশি হয়ে যা দিবেন, তাঁকে লালন পালন করাটা আমার দায়িত্ব।
দিন এগুতে লাগলো। এবং একটা সময়ে আমার বাড়িতে বেহেস্তের ফুল ফুটলো। ২০১৫ এর জুন মাসের তিন তারিখে আমার বড় ছেলে রিসালাত ফারজান চৌধুরীর জন্ম হলো। এর চার বছর আগে আমার জন্মদিনের সাত দিন আগে আমার বাবাকে আল্লাহ নিয়ে গিয়েছিলেন। চার বছর পরে আমার জন্মদিনের সাতদিন পরে আবার ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ঐ একটা ছোট্ট মুখ, এক ঘন্টা আগেও যার চেহারা দেখা হয়নি, অথচ প্রথম দেখাতেই মনে হলো পৃথিবীতে ওর চেয়ে সুন্দরতম, আপনতম, পবিত্রসম কোন কিছু নেই। ভুরু কুঁচকে বিরক্তির দৃষ্টিতে আশপাশ দেখছিল। যেন ভাবছিল, "এ আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে এলে?"
ওর সাথে পরিচিত হতে তখন দলে দলে লোক আসছে। ওর সেদিকে খেয়াল নেই। বেশিরভাগ সময়েই ঘুমিয়ে থাকে, এবং সারা রাত জেগে কাটায়।
ওর কানে আমিই আজান দিলাম। ওর জীবনের প্রথম মুয়াজ্জিন আমি। আমার নিজের জানাজার নামাজটার ইমামতি ও করতে পারবে তো?
প্রথম বাচ্চা, কোন অভিজ্ঞতা নেই। বাসায় আনার পরে কিছুক্ষন পরপর ডাইপার বদলাতে হচ্ছে দেখে দৌড়ে গেলাম আবারও মেডিক্যাল ইমার্জেন্সিতে। নার্স হেসে বলল, "দশবার ডাইপার বদল কোন ব্যাপারই না।"
"কিন্তু ওর বারোবার হয়ে গেছে।"
নার্স হেসে বলল, "পনেরো বার হলেও টেনশনের কিছু নেই।"
ঐটুকু একটা শরীর। কোন কষ্টে কেঁদে উঠলে আমাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। নিজের বাবা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দশগুন বেড়ে গেল যখন নিজে বাবা হলাম। পৃথিবীর সব পিতামাতার প্রতি রইলো অফুরান ভালবাসা!
কি অদ্ভুত আর রহস্যময় এক সম্পর্ক! কাঁদে, ঘুমাতে দেয়না, ঠিক মতন খায় না, নোংরা পরিষ্কার করতে হয় - তারপরেও মনে এতটুকু বিরক্তি আসেনা। উল্টো ঐ মুখ কিছুক্ষন পরপর না দেখলে মনে হয় পৃথিবীটা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে।
শুরু করেছিলাম এই বলে যে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমাদের অবস্থার পরিবর্তন করবেন। এবং এরই শুরুটা হয়েছিল তাঁর সবচেয়ে বড় রহমত উপহারের মাধ্যমে। আমার ছেলের জন্মের পরে মাত্র ছয়মাসের ব্যবধানে আমি দুইটা প্রমোশন পাই, এক বছরের মাথায় তিন নম্বরটা আসে। ওর বয়স দেড় হবার আগেই আমি চতুর্থ প্রমোশন পেয়ে যাই। এমন না যে আমি দুর্দান্ত পারফর্ম করে এই ওই পদক জয় করে দেশব্যাপী হাহাকার বাঁধিয়ে দিয়েছি। ঘটনাগুলো এত নিখুঁত সূক্ষ্মতায় ঘটলো যে শ্রেষ্ঠ কৌশলীর কৌশল দেখে অবাক হয়ে গেলাম! আমার তেমন কিছুই করতে হয়নি, ওগুলোই সোনার থালে সাজিয়ে আমার সামনে হাজির করা হলো। Right person at the right time বলতে যা বোঝায়।
এদিকে ওর মায়েরও প্রথমে চাকরিটা ফুলটাইম হলো, তারপরে কয়েক মাসের মধ্যেই প্রমোশন হলো, এবং মাত্র এক বছরের মাথাতেই সে বিশাল একটা জাম্প নিয়ে নতুন চাকরিতে ঢুকলো।
এরই মধ্যে আমাদের বাড়িতে ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি কেনা হয়ে গেছে। নতুন বাড়িতে ওঠাও শেষ। জীবন মোটামুটি গুছিয়ে নেয়ার জন্য সঠিক ট্র্যাকে চলতে শুরু করে দিয়েছে। ধরে রাখাটা আমাদের দায়িত্ব।
শিশুরা বাবা মায়ের জীবনে কতটা রহমত আর বরকত নিয়ে সেটার দুর্দান্ত উদাহরণ আমার ছেলে। "রিসালাত" শব্দের মানে আল্লাহর সরাসরি বার্তা, যে আমাদের জীবনে আমাদের রবের উপহার হিসেবে এসেছে!
আল্লাহ ওকে রহমত, বরকত, সুখ, স্বাচ্ছন্দে ভরপুর একটি জীবন দিন। পৃথিবীর যাবতীয় অনিষ্ট থেকে তাঁকে রক্ষা করুন। এবং নিজের স্রষ্টার প্রতি অনুগত ও কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
* আল্লাহর রহমত ছোট ছেলে এখনও বাংলা পড়তে পারেনা। নাহলে বড় ভাইকে নিয়ে লেখা এই সুবিশাল লেখা পড়ে প্রথমেই বলতো, "Daddy you didn't write for me!" বড় ভাইকে যা দিতে হবে, ওকে অবশ্যই সেটা দিতে হবে। নাহলে জান তানাবানা! তাই ওর জন্মদিনে ওকে নিয়ে কিছু একটা লেখা ফরজ হয়ে গেল।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২৩ রাত ৩:১৬