somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোরবানির ঈদ নিয়ে একটি কষ্ট এবং একটি স্বপ্নের কথা

০৭ ই নভেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সালটা ১৯৯২। আমি তখন ঢাকার কাকরাইল-এর একটি স্কুল এ ক্লাস টু তে পড়ি । সে বছরের কোরবানি ঈদের স্মৃতি দিয়ে আমার এ লেখাটা শুরু করছি। আমার পরিচিত অনেকে বলেন, ঈদ জিনিসটা যে কী তা বোঝার জন্য ছোটদের দিকে তাকাতে হয়, কথাটা আমিও বিশ্বাস করি। ছেলেবেলার প্রতিটি ঈদে সারাটা দিন অকারণেই মনটা খুশিতে ভরে থাকতো, ঈদের অনুভূতিটাকে মনে হত আমাদের পরিচিত সব অনুভূতি থেকে আলাদা, একটু পর পর মনে পড়ত ‘আজকে ঈদ...আজকে ঈদ!’ এখনো ভেবে হাসি পায়, কোন এক ঈদের দিনে আব্বু-আম্মুর কিছু একটা নিয়ে ছোট্ট একটা ঝগড়া দেখে কীযে অবাক হয়েছিলাম! শুধু মনে হচ্ছিলো, ঈদের দিনেও মানুষ ঝগড়া করে! এটা কিভাবে সম্ভব! যাই হোক, ১৯৯২ সালের কোরবানি ঈদের এমন এক দিনে সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল, ‘আজকে ঈদ’-এটা মনে পরতেই ভি-ষ-ণ খুশি মনে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য গিয়ে ঢুকলাম বাথরুমে। কেবল ব্রাশ-এ পেস্টটা লাগিয়েছি, অমনি মালেকা খালা (আমাদের বাসার সাংসারিক দায়িত্ব যিনি পালন করতেন) চিৎকার করে আমাকে ডাকা শুরু করলেন, ‘জয়ী...তাড়াতাড়ি আসো...দেইখ্যা যাও, তোমাগো গরু কোরবানি হইতেছে!’ ‘আমাদের গরু কোরবানি দেয়া শুরু হয়ে যাচ্ছে!’ আমিতো কোনমতে ব্রাশটা হাতে নিয়েই ঝেড়ে বারান্দার দিকে দৌড় লাগালাম। তখন আমরা থাকি শহীদবাগ এলাকায়। আমাদের বাসাটা ঠিক কততলা ছিল তা এখন আর আমার মনে নেই, কিন্তু আমরা থাকতাম দোতালায়, আর আমাদের বাসার বারান্দাটা রাস্তামুখো হওয়ায় বারান্দা থেকেই কোরবানির পুরো প্রক্রিয়াটা ভালমতো দেখা যাচ্ছিল। তো আমি ব্রাশ হাতে বারান্দায় দাড়িয়ে কোরবানির মতো মহা আনন্দের একটা ব্যাপার দেখার জন্য ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে সবকিছু লক্ষ্য করতে লাগলাম। তখন আমি এতটাই ছোট এবং বোকা, যে আমি ধরেই নিয়েইছিলাম কোরবানি হচ্ছে খুব খুশির একটা ব্যাপার। যদিও আমি জানতাম যে এই ঈদ-এ অনেক গরুর মাংস পাওয়া যায়, কিন্তু সেই মাংসের জন্য গরুটাকে যে কেটে টুকরো করতে হয়, তা আমার স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মগজে তখনো ঢোকেনি। যাহোক, আমি দেখলাম আমাদের ময়লা হয়ে যাওয়া সাদা রঙের গরুটাকে কিছু লোক মিলে হাত-পা বেঁধে মাটিতে ফেলে দিল; গরুটার সেযে কী বিকট চিৎকার...আহারে! তখনো আমি বুঝতে পারিনি যে গরুটা ভয়ে এবং বেঁচে থাকার তাগিদে এমন করছিল, তখনো বুঝিনি যে গরুটাকে ওই লোকগুলো কেটে টুকরো করে ফেলতে যাচ্ছে! আমি অবাক হয়ে ভাবছি, ‘ওমা! গরুটা এমন চিৎকার করছে, তারপরও লোকগুলো গরুটাকে বেঁধে মাটিতে ফেলে ঠেসে ধরে আছে কেন!’ এই পৃথিবীর সব আশ্চর্য এসে আমার চোখে ধরা দিল যখন আমি দেখলাম... একটা লোক সেই গরুটার মুখ উঁচু করে গলার চামড়া টানটান করে ধরে তাতে তার হাতে ধরে থাকা লম্বা-ধারাল ছুরির মতো দেখতে একটা জিনিস ঘষে ঘষে ঢুকিয়ে দিতে থাকল... মুহূর্তের মধ্যে সেই ছুরিটা গরুটার গলার নরম চামড়া চিরে দু’ভাগ করে ফেলল... আর ক্রমাগত খিঁচুনি দিতে থাকা শরীরটার কাটা গলা থেকে ফিনকি দিয়ে টাটকা রক্ত বের হতে লাগলো!! আমি এখনো ভুলতে পারিনা, কী ভয়ঙ্কর বিস্ময় নিয়ে আমি দেখছিলাম হাত-পা বাঁধা গলা দু’ভাগ হয়ে যাওয়া একটা দুর্বল অসহায় নির্বোধ প্রাণীর অবর্ণনীয় মৃত্যুযন্ত্রণা! ঠিক কতক্ষণ পর ওই দুর্ভাগা পশুটার সৌভাগ্য হয়েছিলো মরে যেতে পারার, আমি জানিনা। কারণ, ওই দৃশ্য দেখে আমি ছুটে গিয়ে নিজেকে আটকিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের ছোট্ট বাথরুমে...তারপর বেসিনের কল ছেড়ে দিয়েছিলাম যাতে কেউ আমার কান্না শুনতে না পায়...আর কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমের মেঝেতে হাঁটু ভেঙ্গে বসে কী গভীর আকুতিই না জানিয়েছিলাম আল্লাহ্‌র কাছে...বলেছিলাম, ‘প্লীজ আল্লাহ্‌, এই গরুটাকে তুমি বেহেশতে নিয়ে যেয়ো...প্লিজ!!’ ... আহ! কী আশ্চর্য! উনিশ বছর আগের সেই দিনের কথা মনে করে এখনো দেখি চোখে পানি চলে আসছে!

একটু ধাতস্থ হয়ে বাথরুম থেকে যখন আমি চোখ ফুলিয়ে বের হলাম, আমার মা তো আমাকে দেখে চিন্তায় অস্থির! সে তো ভেবেই পাচ্ছিল না যে কি দুঃখে তার ছোট্ট মেয়েটা ঈদের দিনেও এমন কেঁদে চোখ ফোলাল। অনেক পীড়াপীড়ির পর যখন আমি বললাম যে একটু আগে জবাই হয়ে যাওয়া গরুটার কথা মনে করে কাঁদছি, তখন বাড়ির সবার সেকী হাসি! আম্মু তখন আমাকে আদর করে বোঝাল যে এটাতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, এই গরুটাই একদিন আমাদের অনেক বড় উপকার করবে, আল্লাহ্‌র জন্য আমরা এ পশুটাকে কোরবানি দিয়েছি, এর কৃতজ্ঞতা হিসেবে আমরা মরে যাওয়ার পর গরুটার লেজ ধরে দাঁড়াবো, আর সে এক লাফে চুলের মতো চিকন পুল সিরাতের পুল আমাদের পার করিয়ে দেবে যাতে আমরা নিচের দোজখের আগুনের মধ্যে না পরে যাই। আমার মা সেদিন হয়ত নেহায়েত সান্তনা দেয়ার জন্য আমাকে এ কথা বলেছিলেন, কিন্তু কথাটা আমি সেই বয়সেই কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না, তাই মনে মনে বলেছিলাম, ‘গরুটাকে আমরা এত কষ্ট দিয়ে মারলাম, আর সে কিনা আমাদের এত উপকার করবে! এটা আমি কক্ষনো বিশ্বাস করিনা!’

আমার ছাব্বিশ বছরের জীবনে দেখা সেটাই ছিল প্রথম এবং শেষ কোরবানি। গত উনিশ বছরে আমার জীবনে এমন কোরবানির ঈদ আর কখনো আসেনি যে ঈদে আমি খুশিতে ঝলমল করেছি। ঈদের আগের রাতে বাসার নিচে কোরবানির জন্য কেনা পশুগুলোকে দেখে প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে, আল্লাহ্‌ কি শুধু মানুষের? এই পশুগুলোর কষ্টে কি আল্লাহ্‌র কিচ্ছু যায়-আসে না! ঈদের দিন সকালে যখন আমার পরিচিত প্রত্যেকটি মানুষ এই পশুগুলোকে হাত-পা বেঁধে মাটিতে আছড়ে ফেলে গলা কেটে তাদের রক্ত আর নাড়ি-ভুঁড়ি দিয়ে আশেপাশের প্রতিটি সিঁড়িঘর-রাস্তা-নর্দমা মাখিয়ে ফেলবে, তখন কি অনেক উপরে বসে থাকা আল্লাহ্‌ খুব খুশি হবে এই ভেবে যে তাঁর বান্দারা তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য কীই না করতে পারে! বহুদিন...বহুবছর আমি ক্রোধে, ক্ষোভে, হতাশায় সৃষ্টিকর্তার কাছে বহু অভিযোগ করেছি...বলেছি, ‘তুমি কেমন আল্লাহ্‌, নিরীহ প্রাণীর রক্ত দেখে খুশি হও! আর যদি এতই তোমার রক্ত দেখতে ইচ্ছা করে, তাহলে কেন তুমি ওদের মৃত্যুযন্ত্রণা কমিয়ে দিতে পারনা! তোমার অসাধ্য তো কিছুই নেই, তারপরও কেন একটা নিরীহ পশুকে আমাদের মাংস খাবার লোভ মেটানোর জন্য এভাবে ছটফট করে মরতে হয়?’ উত্তরে মানুষের কাছ থেকে যা পেয়েছি তা হল - আমি পাগল/ নাস্তিক/ কাফের এবং গাধা। তবে এখন আর আমার সৃষ্টিকর্তার প্রতি কোন অভিযোগ নেই, কারণ আমি তাঁর বলা কথা উপলব্ধি না করতে পেরে এতদিন তাঁকে দোষ দিয়েছি। কি সেই কথা, সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তার আগে আমি আমার নিজের অবস্থানটা একটু ব্যাখ্যা করে নেই। এই লেখাটা যেহেতু আমার নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে না লিখে একটি ব্লগ সাইটে লিখছি, সেহেতু ধরেই নিচ্ছি কিছু মুক্তবুদ্ধির মানুষ আমার এ লেখাটা পড়বেন এবং আমার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করবেন। তাদের বোঝার সুবিধার্থেই আমি আমার বিশ্বাসের জায়গাটা আরেকটু স্পষ্ট করে তুলে ধরছি।

প্রথমত, ব্যক্তিগত জীবনে আমি একজন নিরামিষভোজী এবং সক্রিয় বলা ঠিক হবে কিনা জানিনা, তবে একজন সরব পশু অধিকার রক্ষার সমর্থক। পশু অধিকার রক্ষা সম্পর্কিত যা কিছু আমি করার চেষ্টা করি এবং করার স্বপ্ন দেখি, তার কোন কিছুই আমাকে কেউ কখনো বলে বোঝায়নি বা শেখায়নি; বলা যায়, এ ধারণার সবটুকুই আমার বিবেকলব্ধ। শুরুর দিকে আমার উপলব্ধিগুলো ছিল একটু খাপছাড়া, এলোমেলো। কিন্তু যখন আমার এ বোধগুলোকে আমি একটু গুছিয়ে আনতে পারলাম এবং দেখলাম যে এ পৃথিবীতে এমন আরো বহু মানুষ আছে যারা ঠিক আমার মতো করেই চিন্তা করে, স্বপ্ন দেখে; তখন তাদের সাথে একাত্মতা বাড়ানোর জন্য আমি সক্রিয়ভাবে কিছু সংগঠনের সাথে যুক্ত হই, যেমন PETA এবং অভয়ারণ্য। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হলে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়, এই সংগঠনের মানুষগুলো আমাকে সেই মানসিক শক্তির যোগান দেয়। তবে এই মানুষগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে আমার অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। কারণ এদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বিদের মধ্যে নিরামিষভোজী খুব একটা দেখা যায় না, আর পশু-পাখি কেটে খাওয়ার এই চিরাচরিত রীতিটাকে প্রত্যাখ্যান করার কারণে নিজের পরিচিত গণ্ডীর মধ্যেই প্রতিদিন আমি অনেক কথা শুনি, অনেক সমালোচনার শিকার হই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব সমালোচনার মধ্য থেকে আমি মানুষের আচরণগত এমন কিছু দিক দেখি যা আমাকে খুবই বিস্মিত করে। যেমন, আমার কোন আত্মীয় যখন গরুর চর্বি খেয়ে হৃদরোগ বাধিয়ে ফেলেন, তখনো তাঁকে কেউ গরুর মাংস খেতে বারণ করে দুটো কথা কখনো শোনায় না, কিন্তু যখন কেউ শোনে যে আমি মাছমাংস খাইনা এবং তারপরও সম্পূর্ণ সুস্থ সবল জীবনযাপন করছি, তখন রাজ্যের যুক্তি-তর্ক-সমালোচনা আমার দিকে ছুড়ে মারা হয় – কেন আমি পশুর মাংস হালাল হবার পরও খাবনা, তাহলেতো আমি নাস্তিক...গাছপালারও তো জীবন আছে, তাহলে সেগুলো আমি কেন খাই...এদেশে গরিব মানুষই খেতে পায়না, আর আমি কিনা পশু অধিকারের মতো হাস্যকর বিলাসিতা নিয়ে সময় নষ্ট করি...ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার এ লেখাটা আমি এসব তর্ক খণ্ডানোর জন্য লিখতে বসিনি, বসেছিলাম কোরবানি ঈদের পশু কোরবানি নিয়ে। আর তাই আমার নিরামিষভোজন এবং পশু অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত যুক্তি দিয়ে লেখাটা আর বড় করতে চাচ্ছিনা। খুব সংক্ষেপে আমি শুধু আমার দৃষ্টিভঙ্গির অংশটা তুলে ধরছি।

এই পৃথিবীতে চিন্তা করার ক্ষমতা, বিবেকবোধ, ভাষা প্রকাশ, জ্ঞান আহরণ ও চর্চা সর্বোপরি বুদ্ধিমত্তার সুস্পষ্ট প্রকাশ যে প্রাণীটির মধ্যে ঘটেছে, সে প্রাণীটি হচ্ছে মানুষ। আমার কাছে বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে একটি ক্ষমতা, আর অনেক বড় ক্ষমতার সাথে জড়িত থাকে অনেক বড় দায়িত্ব। যা কিছু আমার চাইতে কম বুদ্ধিসম্পন্ন বা আমার দখলকৃত, তার সবই আমার ভোগের বস্তু, এমন মনোভাব দিয়ে বুদ্ধিমত্তা প্রকাশিত হয়না, প্রকাশিত হয় স্বার্থপরতা। নিজের অধিনস্ত সকল কিছুকে যথাসম্ভব কম অপচয়ের মাধ্যমে ভালবেসে রক্ষা করার মধ্যেই বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ। যেহেতু আমি একজন মানুষ, সেহেতু জন্মসূত্রেই কিছু বুদ্ধি আমার রয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, বেঁচে থাকার জন্য একজন মানুষের প্রতিবেলায় ৪ স্নেহঃ ২ শর্করাঃ ২ আমিষ খাদ্যের প্রয়োজন হয়। মানুষ যেহেতু জৈবিক প্রাণী, জৈবিক খাদ্য ছাড়া বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাই বেঁচে থাকার তাগিদে আমি প্রতিদিনই কিছু লতা-গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের প্রাণ ধ্বংস করি। এই লতাজাতীয় উদ্ভিদই আমার আমিশ-শর্করা-ভিটামিন-স্নেহ ইত্যাদি উপাদানের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট। তারপরও উচ্চমানের আমিষ হিসেবে আমি দুধ এবং ডিম খেয়ে থাকি। যদি এই খাদ্যের ওপর নির্ভর করে আমি এবং বর্তমান পৃথিবীর ৪০ কোটি মানুষ সুস্থ-সবল ভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তাহলে এ কথা বলা ভুল হবেনা যে মাছ বা মাংস আমাদের ভোজনরসে ভিন্নতা আনার জন্য প্রয়োজন, জীবনধারন বা বেঁচে থাকার জন্য নয়। আর যেহেতু আমি খাওয়ার জন্য বাঁচি না, সেহেতু আমার কাছে প্রতিটি সৃষ্টিকে যথাসম্ভব রক্ষা করে চলার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা নিহিত বলে মনে হয়, ধ্বংস করার মধ্যে নয়।

ফিরে আসি কোরবানি প্রসঙ্গে। একটু আগেই বলেছি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমার চিরাচরিত অভিযোগগুলো এখন আর নেই, কারণ আমি সবসময় ধর্ম বিষয়টিকে আমার আশেপাশের মানুষের চোখ দিয়ে দেখেছি, নিজের চোখ দিয়ে কখনো দেখার চেষ্টা করিনি। কোরবানি নামক প্রক্রিয়াটার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা আসলে আমাদের কাছে কি চাচ্ছেন, তা আমি কখনো বোঝার চেষ্টা করিনি। আমার লেখাটির এ পর্যায়ে আমি যে কথাগুলো এখন বলতে যাচ্ছি, তার পুরোটাই আমার উপলব্ধিপ্রাপ্ত, আমার একান্ত মতামত। আমি বলতে চাচ্ছিনা যে আপনাকে আমার সাথে একমত হয়ে এভাবেই চলতে হবে, তবে আমি আশা করব আপনি আমার এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সম্মান রেখে আমার উপলব্ধিগুলো একবার হলেও একটু বোঝার চেষ্টা করবেন।

কোরবানি শব্দটির অর্থ হচ্ছেঃ উৎসর্গ, ত্যাগস্বীকার, বিসর্জন, পুণ্যলাভ বা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজের অধিকৃত মহার্ঘ্য কোন বস্তু ত্যাগ করা। কোরবানি কথাটার সবচেয়ে সুন্দর ব্যাবহারটি আমি দেখি যখন কোন যোদ্ধা বা সৈনিক তাঁর মাতৃভূমির জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে। সৃষ্টিকর্তাকে ভালবেসে নিজের জন্য মূল্যবান কোন বস্তুকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে মূলত আমরা তাঁকে যে বার্তাটি প্রেরণ করি তা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমাদের ভালবাসা এতটাই প্রকট, যে যেই মুহূর্তে তিনি চাইবেন আমার জীবন তাঁর প্রতি উৎসর্গ করতে, ঠিক সেই মুহূর্তে এই পৃথিবীর লোভ ছেড়ে তাঁর উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে আমি এক বিন্দু দ্বিধাবোধ করবোনা (হানাফি পণ্ডিত মুফতি মুহাম্মাদ ত্বাকি উসমানী-র ব্যাখ্যা অনুযায়ী)। আমার মতে এটি একটি চমৎকার উপলব্ধি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে সে বার্তাটি প্রেরণের জন্য একটি নিরীহ পশুর জীবন কেড়ে নেয়ার প্রাসঙ্গিকতাটি আমি ঠিক বুঝতে পারিনা। যে কোন মানুষের জন্য সবচাইতে মূল্যবান বস্তু হচ্ছে তার নিজের জীবন। আর নিজেদের এই জীবনটাই যদি আমরা সৃষ্টিকর্তার সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি মানুষের কল্যাণে বা তাঁর নিয়ামতগুলোর কল্যাণে নিয়জিত করি, তারচাইতে মহৎ কোন কোরবানি কি আর হতে পারে! একটি বিশেষ দিনে পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে আমরা যা বলার চেষ্টা করছি, পশুটি কেনার সমপরিমাণ অর্থ কোন বৃহত্তর কল্যাণে দান করে বা সহায়তা করে সেই একই বার্তা কি আমরা তাঁর কাছে প্রেরণ করতে পারিনা? পশু কোরবানির পেছনে মানবিক যে যুক্তিটি কাজ করে তা হচ্ছে, এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের গরিব ও হতদরিদ্র মানুষকে একবেলা মাংস খাবার একটি সুযোগ করে দেয়া। ইসলাম ধর্মের এ দর্শনটি অতি চমৎকার, কিন্তু দারিদ্র দূরীকরণে কি আসলে এই প্রক্রিয়াটি খুব বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে? এদেশে কোরবানির মাংস দান করার মতো কোন গরিব মানুষ ই যেন না থাকে, সেটাই কি আপনার চাওয়া হওয়া উচিৎ নয়? আপনি এবং আপনার আশেপাশের পাঁচজন প্রতিবেশি মিলে যে অর্থ দিয়ে পশু কোরবানি দিচ্ছেন, সে অর্থ সংগঠিত করে যদি কোন গ্রামের দুটি হতদরিদ্র পরিবারকে স্বাবলম্বী করার পেছনে খরচ করেন, তবে নিজের পায়ে দাড়িয়ে সে পরিবার দুটি বছরের প্রতিটি দিনই নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে পারবে, আপনার দান করা মাংসের দিকে তাদেরকে আর তাকিয়ে থাকতে হবেনা। একবার চিন্তা করে দেখুন, যদি আপনার আশেপাশের মানুষ আপনার ভাল বা মহৎ কাজের জন্য আপনাকে মূল্যায়ন করতে পারে, তাহলে মহান সৃষ্টিকর্তা কেন তা করবেন না? তাঁর অবস্থান নিশ্চয়ই সকল সংকীর্ণতার উর্ধে! এরপরও যদি আপনার আমার এ যুক্তিগুলোকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়, তবে নিজপক্ষ সমর্থনে আমি হাদিসের ব্যাখ্যানুযায়ী বলতে পারি, যুলহিজ্জাহ মাসের ১০-১২ তারিখের মধ্যে কোন মুসলমান যদি ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে পশু কোরবানি দিতে অসমর্থ হয়, তবে কোরবানির সমপরিমাণ অর্থ সে ‘সদকা’ হিসেবে দান করতে পারে (Click This Link)। সিডর পরবর্তী কোরবানি ঈদের সময় আমার পরিচিত অনেককেই দেখেছি কোরবানির জন্য ধার্য টাকাটা দক্ষিণাঞ্চলীয় অসহায় মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন তহবিলে সদকা হিসেবে দান করে দিতে। দেশের একটি মহা দুর্যোগের সময় এদেশের মানুষ যদি এভাবে এগিয়ে না যেত, তাহলে কখনই হয়ত আমরা এত অল্প সময়ে এতবড় একটি দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারতাম না!

একটি ব্যাপার লক্ষ্য করুন, পশু কোরবানির ব্যাপারটি কিন্তু ধনী মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে, ফরয নয়। আপনি যদি ব্যক্তিগত জীবনে আপনার জন্য ফরয, এমন ব্যাপারগুলো সম্পর্কে উদাসীন হয়ে ওয়াজিব পূরণকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, তা আসলে ধর্মীয় দিক থেকে কতটা নৈতিক, তা নাহয় আপনিই বিবেচনা করুন। তবে কোরবানি এখন যতটা না ধর্মীয় দায়বোধ থেকে পালন করা হয়, তারচেয়ে অনেক বেশি পালন করা হয় মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হিসেবে। স্বভাবতই, নিজস্ব সংস্কৃতির ব্যাপারে আমরা কম-বেশি রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করে থাকি। কিন্তু আবহমানকাল ধরে চলে আসছে বলেই আমাদের সংস্কৃতি সকল সমালোচনার উর্ধে থাকবে, এমন ভাবা ঠিক নয়। সংস্কৃতির কোন একটি অংশ যদি মানবিকতার প্রশ্নে আপত্তিকর হয়, তবে তা সংশোধন করতে চাওয়ার দাবি কোন স্পর্ধার প্রদর্শন নয়। যদি তাই হত, তবে স্পেন এ ষাঁড়ের লড়াইের মতো স্প্যানিশ সংস্কৃতির গভীরে প্রথিত একটি বিষয়কে পশু অধিকার আন্দোলনকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইন করে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হত না।

আমি জানি, পশু কোরবানির বিকল্প হিসেবে হাজারো যুক্তি-তর্ক দিয়ে যা কিছুই আমি বলি না কেন, বেশিরভাগ মানুষই সে যুক্তিগুলোকে অগ্রাহ্য করবেন। কেননা মুসলমান মাত্রই জানেন পবিত্র কোরআনে কোরবানি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে (আল-কোরআনের পারা ৫,২২ এবং ৩৭)। আর কোরআনে বর্ণিত জীবনদর্শন যদি কোন ক্ষেত্রে আধুনিক জীবনদর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, সেক্ষেত্রে নতুন কোন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের ব্যাপারটিকে অনেকেই হয়ত ইসলামপরিপন্থী বলে মনে করবেন। আমি আজকে চিৎকার করে বা এরকম দু’চারটে লেখা লিখে নিজের ভিতরের কষ্ট বা উপলব্ধিগুলোকে হয়ত কারো মধ্যেই ছড়িয়ে দিতে পারব না, কিন্তু মানুষের কোরবানির জন্য কেনা পশুটির প্রতি একটু সদয় হবার বোধটুকু যদি আমি কারো মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারি, তাহলেও আমার ভিতরের ভয়ঙ্কর কষ্টটা অনেকখানি কমে যাবে।

আমার মনে হয়, কোরবানির হাটে গরু কেনার পর অনেকেই মনে মনে ভাবেন, এ ঝামেলাটা কখন শেষ করা যাবে। আর তাই নিজেদের কেনা পশুটাকে ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবার বা মাঝরাস্তায় একটু থামিয়ে পানি পান করানোর দায়িত্বটাও অনেকে এড়িয়ে যান। আমি অসংখ্যবার দেখেছি হাঁটিয়ে নিয়ে যাবার ঝামেলা এড়ানোর জন্য ছোট্ট কোন ভ্যানগাড়িতে পশুটিকে কাত করে শুইয়ে রশি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, অথবা তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর জন্য পশুটিকে ক্রমাগত প্রহারের মাধ্যমে দৌড়াতে বাধ্য করার দৃশ্য। যে প্রাণীটি নিজের জীবন দিয়ে আপনার খাদ্য ও পুণ্য- দুটোরই যোগান দিতে যাচ্ছে, সে পশুটি কি আপনার থেকে আরেকটু সদয় আচরণ পেতে পারেনা? আপনার কিছু মূল্যবান সময়ের বিনিময়ে হলেও পশুটি যদি একটু আরামে আপনার বাড়িতে পৌছাতে পারে, তাতে আপনার পুণ্য তো কমে যাওয়ার কথা নয়, বরং বেড়ে যাবার কথা।

এতো গেল জীবিত অবস্থায় আমরা কোরবানির পশুর সাথে কী করছি সে কথা। কিন্তু পশুটিকে জবাই নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হত্যার ক্ষেত্রে কখনো কি আপনি ভেবে দেখেছেন কিভাবে তার কষ্ট একটু লাঘব করতে পারেন? আপনার পশুর জবাইকর্মে নিয়োগপ্রাপ্ত কসাই লোকটি প্রকৃতই একজন কসাই নাকি একদিনের আয়ের লোভে হঠাৎ বনে যাওয়া কসাই, তাকি আপনি কখনো যাচাই করে দেখেন? আর দেখলেও একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কসাই দ্বারা আপনার পশু কোরবানির প্রয়োজনীয়তা কি আপনি আদৌ অনুভব করেন? আজকের পৃথিবীতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক এবং আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে একজন কসাইয়ের প্রশিক্ষণ এবং পূর্বঅভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দেখে তাকে এ কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। এদেশে এধরনের কিছু আশা করা নেহায়েতই হাস্যকর একটি ব্যাপার বলে মনে হবে বেশিরভাগ মানুষের কাছে।

পশু জবাইয়ের প্রক্রিয়াটি নিয়ে পৃথিবীজুড়েই অসংখ্য বিতর্ক রয়েছে। ইসলামপন্থী গবেষকদের দাবী, এ পদ্ধতিটিতে যেহেতু প্রথমেই খুব দ্রুত দেহ এবং মাথার মধ্যে রক্ত বহনকারী শিরাগুলো (caroid arteries, jugular veins, the trachea and the oesophagus) বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, সে কারণে পশুটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে এবং কোন ব্যথা অনুভব করতে পারে না। এই যুক্তিটি এতোই চমকপ্রদ, যে শুনলে মনে হয় মানুষের ক্ষেত্রেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা ব্রাশফায়ার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বদলে জবাই পদ্ধতি কার্যকর করা দরকার। পশু জবাইয়ের পদ্ধতি সমর্থনকারী গবেষকের সংখ্যা খুব কম নয় [R Leonard Hill (1923), Sir Lovatt Evans, Professor Harold Burrow, I M Levingen (1979), Professor F R Bell. Mr. Openshaw, Mr. Hayhurst] তাঁদের মধ্যে Wilhelm Schulze নামক জার্মান পশুচিকিৎসকের ১৯৭৪-৭৮ সালের এক গবেষণামূলক পরীক্ষাকে (Click This Link) পশু জবাইয়ের পক্ষের যুক্তি হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যাবহার করা হয়। Schulze কিছু পশুর মাথার খুলির বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি সেন্সর বসিয়ে দেখিয়েছিলেন, তৎকালীন প্রচলিত ‘Captive Bolt Gun’ ব্যাবহারের চেয়ে ইসলামিক নিয়মে পশু জবাই কতটা কম কস্টকর। আপনি তাঁর রিপোর্টটি পড়লে দেখতে পাবেন, Schulze তাঁর দাবীর সাথে নিম্নোক্ত কথাগুলোও বলেছেন যার উল্লেখ কোথাও খুব একটা দেখা যায় নাঃ
“these initial "scientific findings and the results presented are only a very first contribution and that they "need to be followed as a high priority by further investigations in the continuation of the scientific clarification of the issues of loss of pain and consciousness during slaughter of this kind with and without stunning using the same experimental approach with a representative number of grown cows of various breeds”

মেনে নিলাম, ইসলাম খুব ধারাল যন্ত্রের মাধ্যমে জবাই করার যে পদ্ধতিটির কথা বলে তা সত্যিই সবচেয়ে কম যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু আপনি বা আপনার আশেপাশের ঠিক কতজনের সৌভাগ্য হয় এই তত্ত্বটিকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারার, বলতে পারেন? যুক্তরাজ্যের Farm Animal Welfare Council তাদের দীর্ঘ গবেষণায় (Click This Link) দেখতে পায়, বেশিরভাগক্ষেত্রেই জবাইয়ের পর পশুটি দু’মিনিট পর্যন্ত মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে। এছাড়াও, গলা কেটে ফেলার পর carotid ধমনীর মাথায় অনেকক্ষেত্রেই খুব দ্রুত রক্তের বড় দলা বেঁধে যায় (ballooning নামে প্রচলিত) যা শরীর থেকে দ্রুত রক্ত বের হয়ে যাবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকে প্রলম্বিত করে দেয়। New Statesman এর সাংবাদিক Nick Cohen ও তাঁর লেখায় এ ব্যাপারটি উল্লেখ করেন,
"Occlusions slow blood loss from the carotids and delay the decline in blood pressure that prevents the suffering brain from blacking out. In one group of calves, 62.5 per cent suffered from ballooning. Even if the slaughter-man is a master of his craft and the cut to the neck is clean, blood is carried to the brain by vertebral arteries and it keeps cattle conscious of their pain." (http://www.newstatesman.com/200407050016)

পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যাগুলো এড়ানো যাচ্ছেনা বলেই আজকের বিশ্বের বহু মুসলিমঅধ্যুষিত দেশ কোরবানির পূর্বে আধুনিক ‘Electrical Stunning’ পদ্ধতিকে বৈধতা দানে বাধ্য হচ্ছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর পশু আইনে এখন জবাইয়ের পূর্বে বাধ্যতামূলকভাবে অচেতন করার পদ্ধতি যোগ করা হয়েছে। আধুনিক এ ধরনের কোরবানির পদ্ধতি ব্যাবহারের কথা আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন? আপনার কি মনে হয়না, এই একবিংশ শতাব্দিতে পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতি অবলম্বন এবং তার পেছনে প্রাগৈতিহাসিক যুক্তি দেয়া বন্ধ করে কোরবানি ব্যাপারটিকে মানবিকতার দাবীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার সময় চলে এসেছে? যেভাবে এদেশে কোরবানির প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়, তাতে মাংস কতটা হালাল থাকে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়। কেননা, ইসলাম এক পশুর সামনে আরেক পশু হত্যার পদ্ধতিকে সমর্থন করেনা (http://islam-qa.com/en/ref/153936)। আর সেখানে গণহারে নৃশংসভাবে পশুহত্যা এবং তারপর তাদের রক্ত ও শরীরের উচ্ছিষ্ট অংশ যেখানে সেখানে ফেলে আশেপাশের পরিবেশ দুর্বিষহ করে ফেলার পরও যদি আপনি বলেন আপনার মাংস হালাল, তাহলে আসলেই আর কিছু বলার থাকে না। পশু কোরবানি যদি আপনার জন্য নেহায়েতই একটি আনুষ্ঠানিকতার নাম না হয়, যদি সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মূল্যবান বস্তু হিসেবেই আপনি কুরবানি দিয়ে থাকেন, তবে সেই পশুটির প্রতি অবশ্যই আপনার ভালবাসা থাকতে হবে। আর ভালবাসা জন্মানো কোন পশুর জন্য সবচেয়ে কম যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুপন্থাটি বেছে নেয়ার জন্য বিবেকের দিক থেকেই আপনার তাগিদ অনুভব করার কথা। আমি আশা করব আমার আশেপাশের প্রতিটি মানুষ তাদের বিবেকের তাড়না থেকেই যেন সঠিক পথটি চিনে নিতে পারেন।

একজন সচেতন পশু অধিকারকর্মী হিসেবে আমার কিছু স্বপ্ন আছে। আমি স্বপ্ন দেখি, ঈদের মতো একটি আনন্দের দিনে আমাকে লক্ষ লক্ষ পশুর হত্যাকাণ্ড দেখার ভয়ে আর সারাটাদিন ঘরের চারদেয়ালের মাঝে নিজেকে আটকিয়ে রাখতে হবে না। এদেশের মানুষ তাদের মানবিকতাবোধের কারণে আর অলিতে-গলিতে এভাবে পশু জবাই করবেনা। আমি স্বপ্ন দেখি, এদেশে একদিন এলাকাভিত্তিক কিছু অত্যাধুনিক কসাইখানা (slaughter chamber) থাকবে, যেখানে এক পশুর সামনে আরেক পশুকে হত্যা করা হবে না, কোরবানির প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে অচেতন অবস্থায়, আধুনিক ব্যথামুক্ত পদ্ধতি ব্যাবহারের মাধ্যমে; যেখানে রক্ত এবং পশুর উচ্ছিষ্ট সরিয়ে নেয়ার জন্য থাকবে ভাল নিষ্কাশন ও বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা, কসাইগণ হবে উচ্চপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং দক্ষ, পশুর কোন শিরার অবস্থান কোথায় এবং কোনটি কাটলে সবচেয়ে দ্রুত তার মৃত্যু নিশ্চিত করা যাবে সে জ্ঞানটুকু তাদের থাকবে, আর থাকবে পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণকারি কিছু পরিদর্শক যারা নিশ্চিত করবে পশুটির ব্যথামুক্ত মৃত্যু এবং হালাল মাংসের উৎপাদন। ঈদের দিন সাধারণ মানুষ তার পশুটির জন্য একটি সিরিয়াল নম্বর নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে অপেক্ষা করবে, এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করে এই প্রক্রিয়ায় কোরবানির মাধ্যমে মাংস নিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারবে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে এখন এরকম অত্যাধুনিক slaughter chamber রয়েছে, যেখানে ঠিক এ উপায়ে কোরবানির প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। এ দেশের প্রেক্ষাপটে আমার এ স্বপ্নটি আপনার কাছে অত্যন্ত হাস্যকর এবং অবাস্তব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমৃত্যু আমি এ হাস্যকর স্বপ্নটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাবো।

গতকালকের পত্রিকার একটি ছোট্ট খবর দিয়ে আমার এ দীর্ঘ লেখাটি শেষ করছি। ভারতের প্রখ্যাত ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দের ভাইস চ্যান্সেলর মওলানা আবুল কাসিম নোমানি গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, "হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতির কথা বিবেচনা করে এ শিক্ষাকেন্দ্র আগামীকাল ঈদুল আজহার দিন গরু কোরবানি পরিহার করার আহবান জানাচ্ছে"। (Click This Link) জানিনা খবরটি কে কিভাবে নিচ্ছেন, কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি রইল আমার ভক্তিপূর্ণ শুভেচ্ছা । গরু কোরবানি আমাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের একটি মাধ্যম হতে পারে, কিন্তু হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্য গরু হচ্ছে দেবতা। অপর ধর্মকে হেয় করে বা অন্যের মনে কষ্ট দিয়ে নিজ ধর্মের মাহাত্ন কখনই তুলে ধরা সম্ভব নয়। আর তাই প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাছে পশু অধিকারে ব্যাপারে আরেকটু সংবেদনশীল হওয়ার জন্য আমার অনুরোধ এবং আহ্বান রইল।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১১ সকাল ১১:০৩
৭টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×