দুর্নীতি। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ। তবে এই মুহুর্তে আলোচনার প্রেক্ষাপট ভিনড়ব। এত দিন দুর্নীতির আগাগোড়া-ডালপালা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন আলোচিত হচ্ছে দুর্নীতি দমনের প্রসঙ্গ। বর্তমান তত্ত্বাবধায় সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ বিষয়ে দেশের ও বহির্বিশ্বের সর্বোচ্চ মনোযোগের কেন্দ্র হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক। এর চেয়ারম্যান সাবেক সেনা প্রধান লে: জে: (অব হাসান মশহুদ চৌধুরীর মত তড়িৎকর্মা ও সাহসী ব্যক্তির কল্যাণে দুদক এরই মধ্যে ডজন ডজন বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ-আমলা ও ব্যবসায়ীকে জেলে পুরতে সক্ষম হয়েছে; যদিও শীর্ষ রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার এবং শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকারের অস্থির মনোভাব দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে নানা রকম প্রশেড়বর জন্ম দিয়েছে তারপরও জনগণ এখনও সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে মৌন হলেও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দশকের দুর্নীতির কারণে অতিষ্ঠ ও ত্যক্ত বিরক্ত জনগণ এখন যেকোন মূল্যে দুর্নীতির এই চক্র ভেঙ্গে ফেলতে মরিয়া। সরকারের রাজনৈতিক উচ্চাশা, পরাশক্তিগুলোর সাথে সম্পর্ক, তেল- গ্যাস-কয়লা-বন্দর-ট্রানজিট-বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের অস্বচ্ছ মনোভাব, মানবাধিকার, ভবিষ্যৎ রাজনীতি, নির্বাচন, জাতীয় উনড়বয়ন, ক্রমবর্ধমান বাজার দর ইত্যাদি নিয়ে জনমনে নানা রকম শংকা ও প্রশড়ব থাকলেও ফালু-মামুন-নাসিম গংদের উচিত শিক্ষা হচ্ছে ভেবে জনগণ এখন আনন্দিত। দুদক-যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে শুধু যে দুর্নীতিবাজ ধরা পড়েছে তা নয় বরং সাথে সাথে দুর্নীতির অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনাও জনসমক্ষে প্রকাশ পাচ্ছে। যার সর্বশেষ নজির হচ্ছে সরকারের প্রধান বন সংরক্ষকের আটকপরবর্তী রূপকথার মত ঘটনাবলী। একজন সরকারী কর্মকর্তা, যার বেতন সর্বোচ্চ বিশ পঁচিশ হাজার টাকা তার বালিশের ভেতর সতের লক্ষ টাকা, ড্রামের ভিতর এক কোটি টাকা ব্যাংকের লকারে তিনশ’ ভরি সোনা উত্তরা কাফরুল গুলশানে বাড়ি- ফ্লাট, দেশের বিভিনড়ব যায়গায় ২৫০ বিঘা জমি, শ্বশুরের কোটি টাকার কাঠ জনগণকে হতবাক করে দিয়েছে। এর আগে আমরা অবাক হয়ে দেখেছি ত্রাণের টিন মাটির নীচে, বনের হরিণ বাগান বাড়িতে আর তিন কোটি টাকার গাড়ি ডাস্টবিনে। দুর্নীতির ফিরিস্তি দেয়া এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমরা খানিকটা গভীরে আলোচনা করতে চাই। খুঁজে বের করতে চাই দুর্নীতির আসল উৎস। তবে তার আগে কয়েকটি ভিনড়ব রকম দুর্নীতির কথা আলোচনা না করলেই নয়।
১.
বাংলাদেশে মোলা মৌলভীদের সমালোচনা বহুদিনের। বলা হয় তারা কোন উৎপাদনশীল কাজে জড়িত নয়। তারা ভাল কথা বলে, ওয়াজ নছিহত করে, কারণ সেটাই তাদের পেশা। সমালোচকরা বলেন, এসব মোলা মৌলভীর যদি বেতন ভাতা বন্ধ হত অথবা ওয়াজ শেষে হাদিয়া দেয়া না হতো তাহলে তারা সদুপদেশ দেয়া বন্ধ করে দিতো। কিন্তু আমরা দেখি এসব মোলা মৌলভীর তথাকথিত কর্মহীনতার সমালোচনায় যারা মুখর তারাই দুর্নীতি দমনের উপদেশ দেয়াকে পেশা হিসাবে নিয়েছেন। টি আইবি, সিপিডিসহ বিভিনড়ব এনজিওর যে সব বক্তা উপদেশ দেয়ার মহৎ কর্মটি করছেন তারা সবাই কি অন্য কোন বৈধ পেশায় আয় রোজগার করে দেশের কল্যানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন? নাকি কেউ কেউ বেতন ভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসাবে বর্তমানে এ কাজটি করছেন (যারা অন্যত্র চাকরী করলে অন্য রকম কিছু করতেন)। যারা প্রফেশন হিসাবে উপদেশ দেয়াকে বেছে নিয়েছেন তারা যখন একই প্রফেশনের অন্যকে (যেমন মোলা মৌলভীদের) সমালোচনা করেন তখন তা নীতির পর্যায়ে পড়ে না, দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।
২.
বাংলাদেশে কয়েকজন প্রখ্যাত সিভিল ব্যক্তি আছেন। যারা কখনো সিভিল সোসাইটির হয়ে রাজনীতিবিদদের তুলোধূনো করেন আবার কখনো কখনো নিজেরাই রাজনৈতিক দলের সভাপতি হিসাবে মাঠ গরম করার ব্যর্থ চেষ্টা চালান। তাদের কেউ কেউ তেল গ্যাস রক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি লুণ্ঠনকারী বহুজাতিকের হয়ে দক্ষভাবে মামলা লড়েন এবং রাষ্ট্রের বেচারা আইনজীবিদের সাফল্যের সাথে ধরাশয়ী করেন। তাদেরকে প্রশড়ব করতেও মিডিয়া ভয় পায়। এ ধরনের ব্যক্তিরা যখন নিজেদেরকে সৎ ও দেশ প্রেমিক দাবি করেন তখন কি তা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে না? অবশ্য যখন যে পাত্রে রাখা হয় তখন সেই পাত্রের আকার ধারণ করা যদি কারো নীতি হয় তাহলে তা ভিনড়ব কথা কেননা সেক্ষেত্রে দুর্নীতি সজ্ঞায়িত করা বড় কঠিন।
৩.
বাংলাদেশে সিগারেটের বিজ্ঞাপনের নীচে একটি কথা লেখা থাকে “ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।” ইদানিং লেখা থাকে “ধুমপানে ষ্ট্রোক হয়।” এই কথা দুটো লেখায় সরকার, কারণ সরকার বিশ্বাস করে ধুমপান ক্ষতিকর। ধুমপান ক্ষতিকর হলে স্বাভাবিকভাবেই তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্যের উৎপাদন বিপনন ইত্যাদিও ক্ষতিকর। কিন্তু সিগারেট বিড়ির ব্যবসা বাংলাদেশের একটি বড় ও বৈধ ব্যবসা। সরকার এটা থেকে বড় অঙ্কের ট্যাক্স পায় বলে এটাকে বৈধতা দিয়েছে। তার মানে দাঁড়ায় টাকা দিলে ক্ষতিকর কিছুও বৈধ। এটা নীতি হতে পারে না; এটা দুর্নীতি। অবশ্য পুঁজিবাদে নীতি আর দুর্নীতির মাপকাঠি খুবই আপেক্ষিক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক লাভালাভ নীতির মাপকাঠি স্থির করে। পশ্চিমা দেশগুলোতে পতিতালয় ও মদের ব্যবসা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ বিষয়ে একটু পরেই আসছি।
৪.
স¤প্রতি সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন- বাংলাদেশের গ্যাস ২০১১ সালে শেষ হয়ে যাবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাস পাবার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সরবরাহ লাইনে গ্যাসের চাপ না থাকায় গ্যাস নিতে প্রতিটি গাড়ির অনেক সময় লাগে তাই এই ভোগান্তি। এছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় সিএনজি স্টেশনের সংখ্যাও অপ্রতুল। কেননা লাইনে চাপ না থাকায় সংশিষ্ট প্রকৌশলীরা নতুন মেশিনের অনুমতি দিতে
চান না। এরই মধ্যে একটি মহল বিদেশী কোম্পানীর কাছে গ্যাস বিক্রি করতে নানা তত্ত্ব হাজির করছে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিপদগ্রস্ত করে যারা দেশের সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দিতে চায় তাদের কাজ কর্ম কথা বার্তাও যে সুনীতি নয় তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই।
দুর্নীতিতে ক্ষতি কার? মানুষ দুর্নীতি কেন করে কিংবা দুর্নীতি কিভাবে স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রনে আনা যায় তার আলোচনার পূর্বে দুর্নীতি হলে আমাদের কী কী সমস্যা হয় সে বিষয়ে খানিকটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।
১. দুর্নীতির কারণে সমাজে অসম ও অন্যায্য বন্টন হয়। ফলে দেখা যায় ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত টিন দিয়ে অন্য কেউ ক্লাব ঘর তৈরি করে।
২. দুর্নীতির কারণে হয়রানি বাড়ে। দুর্নীতিবাজরা টাকার জন্য সেবা প্রার্থীকে নানাভাবে নাজেহাল ও অসহযোগিতা করে। প্রত্যেকটি কাজের ব্যয় বেড়ে যায়।
৩. রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তির অধিকারে চলে যায়, ফলে জনগণের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসে।এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের প্রধান টার্গেট খনিজ সম্পদ ও ভূমি।
৪. দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা বাজারে মূল্য স্ফিতির সূচনা করে। পণ্য মূল্য বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষের আপেক্ষিক ক্রয় ক্ষমতা কমে।
৫. দুর্নীতির কারণে সেবা খাতের দক্ষতা এবং সামর্থ্য কমে যায়। জনগণ অত্যাবশ্যকীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি ও তার কারণে সৃষ্ট ধ্বংসোন্মুখ পরিস্থিতি এর জলন্ত উদাহরণ। পানি-গ্যাস-টেলিফোন-সরকারীহাসপাতাল-বিমান ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনগনের বঞ্চনা ও ভোগান্তির মূল কারণ দুর্নীতি।
৬. দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্র বিরাট অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়; ফলে জাতীয় উনড়বয়ন বাধাগ্রস্থ হয়।
৭. দেশের সম্পদ অপচয়ের একটি বড় কারণ দুর্নীতি। সংশিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে রাস্তাঘাট বাঁধ ইত্যাদি নিমড়বমানের উপকরণে তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে অতি অল্প সময়ে ভেঙে যায়। এভাবে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায়, যা পরবর্তীতে জনগণের উপর করের বোঝা বাড়ায়।
৮. দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের বিভিনড়ব গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য ব্যক্তিরা আসীন হয়। যারা তাদের অযোগ্যতার কারণে সমস্ত ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে ফেলে। পিএসসি-র সা¤প্রতিক কর্মকাণ্ড তারই প্রমাণ।
৯. দুর্নীতির মাধ্যমে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সমাজে অসুস্থ প্রতিযোগীতার জন্ম হয়। সমাজে সন্ত্রাস ও মাদকের বিস্তার ঘটে। মানুষের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি একটি বড় বাধা; ফলে সমাজের বিভিনড়ব স্তরে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার প্রবনতা সৃষ্টি হয় যা এক সময় সমাজ কাঠামোকেই নড়বড়ে করে দেয়।
১০. দুর্নীতি একটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক হুমকি।
এভাবে দুর্নীতির হাজারটা কুফল বর্ণনা করা যায় তবে এই অন্যায়ের সব চেয়ে বড় কুফল বোধহয় আত্মসম্মানবোধের ধ্বংস। এটা এমন একটা ক্ষতি যা ব্যক্তি, সমাজ এবং ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়। (চলবে).....
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০০৯ দুপুর ১২:১৯