somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উঠানের গন্ধ

২৩ শে মার্চ, ২০১০ দুপুর ১২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আবু আল সাঈদ

জ্যোৎস্নার আলোতে কলাগাছটার পাশে এসে দাঁড়ায় রাজেন। গঞ্জে পা রেখেই রাজেন বুঝতে পেরেছে অনেক কিছু বদলেছে। পাঁচ ইঞ্চি গাঁথুনির দেয়াল, উপরে টিনের চাল, এ রকম অনেক ঘর উঠেছে হাটের বটগাছের নিচে। নিধু ময়রা ওপার যায়নি। বড় দারোগা রমজান সাহেব গ্রামে এসে বলেছে, খবরদার নিধুর গায়ে হাত দিবা না কেউ। ও চইলা গেলে মিষ্টি খাইবা কই থিকা।

মুসলমানরা তো মিষ্টির কারবার জানে না। তার দোকানটা যে রকম সে রকমই আছে। সেই কবেকার বাঁশের বেড়া। ভেতরটা বিকেলের আলোতেও প্রায় অন্ধকার। অন্ধকারে গোটাতিনেক রসগোল্লার কড়াই আছে। ঠিক আগের মতোই।

নতুন দুটো সেলুন বসেছে। ট্রানজিস্টরে গান হচ্ছে।
খাসি-ছাগলের বাজারটাতে লম্বা ছাউনি উঠেছে।
কেবল নিবারণ শীল তার ছোট কাঠের বাক্সটা নিয়ে ছাতিম গাছটার নিচেই বসা। বিবর্ণ আয়নাটা একটা বাঁশ পুঁতে ঝুলিয়ে রেখেছে। নিবারণ শীলের চেহারাটা শুধু বদলে গেছে।

অনেক কিছু বদলেছে, তবে অচেনা হয়ে যায়নি।
গঞ্জ-হাট ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াপারে এসেছে, পাটনি কৈলাস নেই। তাকে মেরে ফেলেছে দাঙ্গাবাজরা। দাড়িওয়ালা একজন মাথায় টুপি পরে পারাপার করছে। রাজেনের চেনাজানা নয়।

অনেককেই চিনেছে সে, তাকে কেউ চিনতে পারেনি। এমনিতেই উষ্কখুষ্ক পাকা চুল, মুখটা ভেঙে গেছে নিউমোনিয়ায়। তার চেয়ে বড় কথা, পথ তো আর কম নয়, প্রথমে শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে বনগাঁও। সেখান থেকে বেনাপোল, তারপর লক্কর-ঝক্কর বাসে খুলনা, স্টিমার ধরে বরিশাল। বরিশাল নেমে রহমতগঞ্জ। গতরে এখনও যেটুকু জোশ ছিল তা পথে পথে ক্ষয় হয়ে গেছে।

পথ চিনতে ভুল করেনি। কলাগাছটার সামনে এসে দাঁড়াতেই নাকে সেই গন্ধ পেল।
উঠানের গন্ধ।

জ্যোৎস্নার আলোতে সবকিছুই দেখা যায়। উঠানটা গোবর লেপা। ভালো লাগল রাজেনের। ঘরটার সামনে দরজাটার পাল্লা ছুটে গিয়েছিল রায়টের বছরই। না কেউ ভাঙেনি। এমনিতেই দুটি কব্জা ছুটে পড়েছিল। দরজার সামনে সিমেন্ট করা তিন ধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ের দু’পাশে বসার জন্য ছোট্ট দেয়াল।
সন্ধ্যায় বাবা ওখানে বসে হুঁকো টানতেন আর কাশতেন।

উঠানের এদিকে-সেদিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ তার নজর পড়ে তুলসী বেদীটা এখনও আছে। অস্পষ্ট আলোতে তুলসী গাছটাও দেখা যাচ্ছে। সে তো মুসলমানের কাছেই ভিটাটা বিক্রি করে দিয়ে গেছে। তাহলে! পাকিস্তানে এখন রায়ট নেই। শেখ সাহেবের ৬ দফার আন্দোলন হচ্ছে প্রতিদিনই। বিহারিরা ঘরে ঢুকে গেছে।

মুসলিম লীগের লোকজনও নাকি গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে আত্নীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে গা-ঢাকা দিচ্ছে। শেখ সাহেবকে আগরতলা মামলায় জেলে ভরে রাখলে কী হবে, মাতুব্বরি এখন বাঙালিদের হাতে। বেশ কয়েকদিন ধরে বরিশালের খবর নিয়েছে সে।

ব্যারাকপুর থেকে সপ্তাহে দু’তিনদিন কলকাতা শহরে এসে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে জিজ্ঞেস করেছে। ওকে পাত্তা দেয়নি পত্রিকার দারোয়ান আর অন্য লোকজন। অনেক কাকুতি-মিনতি করে কিছু কিছু করে জেনেছে। ভাগ্যিস রিপোর্টার অরবিন্দের নজরে পড়েছিল সে আনন্দবাজারের গেটে।

তাকে নিজ দেশ বরিশালের কথা খুলে বলার সুযোগ পেয়েছে। ছেলেটা খুবই ভালো। অনেক কিছু বলেছে ওকে, অনেক সংবাদ। বলেছে, ছিচল্লিশের দি গ্রেট ক্যালকাটা রায়ট মাথায় নিয়ে সাতচল্লিশে দেশবিভাগ হয়েছে। এ দেশের মানচিত্রটা ভাগ ভাগ করে আঁকা যতটা সহজ, ভাঙা মানুষের ছবিগুলো আঁকা কি ততটা সহজ?

রাজেন বলেছে, বাবা তা তো আমি জানি। আমার তো যৌবনটা কেটেছে বরিশালের গ্রামে। এপার-ওপারে কত মানুষ কত পরিবারকে উপড়ে ফেলল ওরা। অরবিন্দ বললে, দেশবিভাগের ইতিহাস কতজনেই তো লিখছে, কিন্তু এসব মানচিত্রভাঙা মানুষ সম্পর্কে আর কতটাই বা লেখা হয়েছে? কতটাই বা জানি।

এই যেমন আজ প্রায় তেইশ বছর পরও আপনার রক্তে টান উঠেছে, বরিশাল যাবেন। আমার তো মনে হয়, না যেতে পারলে জীবনে কী যেন থেকে গেল। যান, ঘুরে আসুন। সাতচল্লিশের পর ওখানে বায়ান্নতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জেগেছে।

তারপর শেখ মুজিবের ছয়দফা আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়েছে। আর এখন ঊনসত্তরে বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছে, মিলিটারি, গুলি, বেয়নেট জাতীয়তাবোধের সামনে কিছু না। হিন্দু-মুসলমান ওখানে এখন বড় কথা নয়, এখন বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। যান আপনি কাকা বাবু। আমার বাবা যেতে পারেননি।

ওই দুঃখ নিয়েই মরে গেছেন। ছেলেমেয়ে, পুতের বউ, নাতি কাউকে কিছু না বলে, তার সঞ্চিত ধন তিনশ রুপি নিয়ে রওনা দিয়েছে এপারের দিকে। একটা পোঁটলা, তাতে একটা গামছা, একটা বিছানার চাদর, একটা লুঙ্গি। আর পরনে শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। একটু ছেঁড়া হলেও মন্দ ছিল না।

কিন্তু পথে পথে এ ক’দিন রাজ্যের যত ময়লা ধুলোবালি লেগেছে ওতে। পথে একটুও খারাপ লাগেনি রাজেনের। বয়স তো কম হয়নি। বহুমূত্র রোগ চল্লিশ বছর বয়স থেকে। হালে প্রেসারের অষুধ ধরেছে। একটু কান্তি ছাড়া আর কোনও অসুবিধা হয়নি তার।

ও মেয়া কেডা আমনে? পেছন থেকে কে বলে। রাজেন পেছনের দিকে তাকায়। মরদ বয়সের। খালি গা। তরতাজা। আমারে চেনবেন না। প্রায় বাইশ বছর ধরে খুব কমই বরিশালের কথা বলেছে সে। এখন তো পাক্কা কলকাতার খাচ্ছে দাচ্ছে বলে।

চিনি নাই, হেয়া তো ঠিকই, পরিচয় দেওন লাগবে না? এইহানে মোর ভিডার হোমকে ঘাপটি মাইররা খাড়াইয়া রইছেন, পরিচয় জিগামু না? যুবকটি বলে। তার হাতে
এক গোছা খড় আর একটা কাস্তে। পরিচয় তো আছে একটা বাবা। এই বাড়ি তোমাগো?

তয় কইলাম কী?
তোমার আব্বায় কই?

হ্যারে চেনেন আমনে? হে তো গত অইছে আর চাইর বচ্ছর আগে।
আমার নাম রাজেন সূত্রধর। আমার কাছে থিককাই তোমার আব্বায় এই বাড়িডা কেনছেলে।

ও মোরে আব্বায় মরার সময় কইছেলে, বদন আলী মুই জীবনে একটাই পাপ হরছি, এককানি নাল জমি আর এই ভিডাডা খরিদ হরছি মোডে নব্বই টাহায়। হেরে ঠগাইছি। এয়ার দাম তো পাঁচশর উপরে অইবে। আয়েন আয়েন ঘরে আয়েন। বলে যুবকটি জ্যোৎস্নার আলোতেই রাজেনকে পরখ করতে থাকে। হাসু ও হাসু আরে লেমডা ধরো। মেহমান আইছে। বলে হাঁক দিতে দিতে এগিয়ে যায় বদন।

দরজাটার পাশে আগে থেকেই দাঁড়িয়েছিল হাসু। হঠাৎ করেই উঠানে কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিল। কুপিবাতিটা নিয়ে বেরিয়ে আসে হাসু। মাথায় ঘোমটা। আলোর ওপাশে বলে চেহারাটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। অইতনায় বিছানাডা লাইচ্ছা দেও। হেরপর উপস্থিত মতো খাওনের বন্দোবস্ত হরো।

যাও। বলে বদন। হাসু কুপিবাতিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। বদন সাধারণত উচ্চস্বরে কথা বলে। বুক ভরে দম নিয়ে বাক্য ছাড়ে। আয়েন আমনেরে একটা জিনিস দেহাই। আলোটা নিয়ে তুলসীবেদীর কাছে আসে। রাজেন একদৃষ্টিতে গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

মোরা যদি কইতাম বাবো, মালাউনগো তুলসী গাছটা রাখছেন ক্যা? হে সোর হইররা কইতে, ফজরে নামাজ পড়ে যাওনের আগে ওইডার সামনে খাড়াইয়া একবার মাফ চাই, হেরে যে ঠগাইছি। বাবো মইরা গেছে, মোরা গাছটা কাডি নাই, বাবোর কতা মনে হইররা। বলে বদনী। অর্ধেক কথাও রাজেনের কানে গেছে কীনা কে জানে।

গাছটার খুব কাছে গেল। পাতাগুলোতে হাত বুলাল। মোর কোলো মনে অইতে আছে, আমনে বোধহয় কাইন্দা দেবেন।
দেবেন না, রাজেনের দুচোখ বেয়ে পানি নেমে এসেছে। তোমার বাবা ইনসান আলী পাশের গেরামের মানুষ। তারে আমি চেনতাম, হাডে পরিচয় হইছিল। তারেই কইলা, আমাগো গেরামে তো মানুষ নাই, যারে যে পারে ঠগাইয়া খায়। আমার এককানি জমি আর ভিডাটা আপনে কিননা নেন। হে লগে লগে রাজি।

হের কাছে জমাইন্যা টাহা যা আছেলে বেবাক দেছে। হে ভালো মানুষ আছেলে, তয় যে এত ভালো মানুষ আছেলে হেয়া জানতাম না মেয়া। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে রাজেন।

আর রাজেনের মনে আছে, আবুল মাঝির নৌকায় গভীর রাতে গ্রাম ছাড়ার সময় বাবা আর একবার পোঁটলা-পুঁটলি বাক্স-পেটরা গুনে গুনে দেখছিল। মা শুধু মিন মিন করে বলেছিল, শ্বশুর মশায় যে সিন্দুরের কৌটা দিয়েছিল, সেটা কি এনেছে নাকি আনেনি, মনে করতে পারছে না। বাবা বলেছেন থোও ওডা, বাঁইচ্যা থাকলে কত কৌট্টা কেনা যাইবে। বলে বাবাও কিন্তু একটু চিন্তিত হয়েছিলেন।

নেন, ঘডিতে পানি আছে, হাত-মুখ ধুইয়া লয়েন। মুই পানি ডালি বদন পানি ঢেলে দেয়, রাজেন হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। রাজেনের খুবই দুশ্চিন্তা ছিল, তাকে দেখে ওরা কী না কী বলে। তার গ্রামের জন্য ভিটাবাড়ির জন্য যে টান উঠত না মাঝে মধ্যে তা নয়, তবে সে জন্য কলকাতার সবকিছু ছেড়ে চলে আসার কোনও প্রয়োজন আছে বলে সে কখনও ভাবেনি। দুর্গা মাকে ভাগিরথীতে ডুবিয়ে বাড়ি ফিরে কান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল রাজেন।

স্বপ্ন দ্যাখে, বাইশ বছর আগে ছেড়ে আসা তার বাড়ি থেকে কপালে জ্বলজ্বলে লাল সিন্দুর দেয়া তরতাজা একটা বউ উঠানে নেমে এসে বলে, তুমি আমাকে ছেড়ে ভুলে থাকছ কী করে গো, আমি যে তোমার অপেক্ষায় আছি সেই কবে থেকে। আসো না কেন গো? ঘুম ভেঙে গিয়েছিল রাজেনের। উঠে বসে অনেকক্ষণ চিন্তা করেছে, এটা শুধু স্বপ্ন নয়। তাকে তার মাটি ডাকছে। কাউকে স্বপ্নের কথা বলেনি সে। তিন-তিনটা মাস তাকে অপো করতে হয়েছে বরিশাল চলে আসার জন্য।

তিন মাস ধরে সে প্র্যাকটিস করছিল, এখানে এসে সে বলবে, আমাকে মা করে দেনে, মরার আগে নিজের গ্রামটাকে দেখতে বড় ইচ্ছে হচ্ছিল আমার। তাই এসেছি। আমি এক্ষুণি আবার ফিরে যাচ্ছি।
তুলসী গাছটাই তাকে সব কুণ্ঠা দ্বিধা থেকে মুক্তি দিল।

অন্ধকারে অতটা ঠাহর করতে না পারলেও, রাজেন বুঝতে পেরেছিল, বাড়ির কিছুই বদল হয়নি। সবকিছু তার খুবই চেনা। জীবনের পঞ্চাশটি বছর এখানে কেটেছে। এ বাড়ির এমন কী আছে যা তার অচেনা এবং তাকে চেনে না?

মহা প্রশান্তির দীর্ঘ ঘুমে বহু বছর পর একটা রাত কাটাল রাজেন। সত্তর বছরের রাজেনের ঘুম বাঙল ত্রিশ বছর বয়সের রাজেন হয়ে। নিজেই টাট্টিখানায় গেল বাইরের ঘটিটা নিয়ে। নিজেই পেছনের পুকুরে গিয়ে স্নান সারল।

নিম গাছে উঠতে পারেনি তা না হলে দাঁতনের অভাব হতো না।
কোথায় সানকি ভর্তি ভেজানো চিড়া আর গুড় আর দই? এককাপ চা আর কয়েকটা টোস্ট বিস্কুট সামনে এগিয়ে দিল বদন। ঘুমডা ভালোই অইছে মনে অয়।
হ।

মোর তো এহোন জমিনে যাওয়া লাগে। আমনে কী হরবেন?
আমিও যাব।
তাইলে আয়েন। মুই যাই। আল চওয়া লাগবে।
সংক্ষিপ্ত ভাষণে বদন আলী চলে যায়।

রাজেন একটা ইন্ডিয়ান বিড়ি ধরায়। একটু সুখের ব্যবস্থা। ইচ্ছে করলে আরও একটু গড়িয়ে নিতে পারে। এখানে কোনও যন্ত্র তাকে ডাকবে না। এটা কলকাতা নয়। সে উঠানে নেমে এলো, সেই তুলসীবেদী।

একটা বালতিতে গোবর পানি আর মাটি নিয়ে উঠানে নেমেছে হাসু। উপুর হয়ে উঠান লেপছে।
গেরাম দ্যাখতে যাইবেন না কাকা? হাসু বলে।
যামু তো মা। তয় একলা একলা ডর লাগে।

আইজকাইল আর কী ডর? বলে উঠে দাঁড়ায় হাসু।
থর থর করে কেঁপে ওঠে রাজেন সূত্রধর। এ কে! ঠিকই চিনতে পারছে সে। যাকে স্বপ্নে দেখেছিল, সেই দেবী।
মা! তুমি একটু সোজা হয়ে দাঁড়াও তো মা।

হাসু বালতি ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ক্যান?
আমি তোমারে দেখমু.. তুমি কেডা?

এয়া আমনে কয়েন কী? মুই হাসু। যে আমনেরে ঘরে আনছে হে মোর বাতার। স্বোয়ামী।
জানে। কিন্তুক মুই কোলো তোমারে চিনছি।
অ কয়েন কী আমনে? মোরে কোতায় দ্যাখছেন আমনে?
স্বপ্নে।

কয়েন কী? হাসু রাজেনের কাছে আসে, হাতে গোবরের গোর-মাটির দলা।
রাজেন এবার আরও ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখে হাসুকে। গিলে খাওয়ার মতো দৃষ্টি। হাসুর মনে হয় বুড়ো ওর ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। হাসুর গলা থেকে কেমন একটা ঠাণ্ডা সাপ নেমে যায় পেটের ভেতরে। বিড় বিড় করে হাসু বলে, কই মুই তো আমনেরে কহনো স্বপ্নে দেহি নাই। কিন্তুক মোর জানি কেমন লাগতে আছে।

রাজেন কোনও কথা বলে না। হাসু সম্ভবত নিজেকে সামাল দিতে দ্রুত চলে ঘরের দরজার কাছে। কলসী থেকে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নেয়। ভয়ে ভয়ে সে তাকিয়ে দেখছিল রাজেনের দিকে।
রাজেন কাছে আসে। দাওয়ায় বসে মোড়াটা টেনে।

হাসু মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, স্বপ্নে মোরে কি দেখছেন?
তুমি এই উডানে নাইমমা, মোরে ডাকতে আছো। আর কইতে আছো, তুমি আমাকে ছেড়ে ভুলে থাকছ কী করে গো, আমি যে তোমার অপেক্ষায় আছি সেই কবে থেকে। আসো না কেন গো?

এই রহম শুদ্ধ কতা তো আমি কই না। বলে হাসু।
স্বপ্নে তো। আর স্বপ্নডা দেখছি কোথায় বইয়া, কইলকাতা। হেহানে তো বেবাক মাইনষে শুদ্ধ কতাই কয়।
এই রহমই দেখছেন মোরে?
হ।

এই শাড়িডা?
হ। এই রহমই। বলে রাজেন।

হাসু একবার ভেবেছিল ব্লাউজটা গায় দেয়, কিন্তু ওর তো বয়স অনেক। বুড়ো। ওর কাছে আবার এত লজ্জা শরমের কী আছে? মাত্র তিন মাস বিয়ে হয়েছে বদন আলীর সঙ্গে। বদন আলী উজিরপুর গ্রামে হাডুডু খেলা খেলতে গিয়ে হাসুকে দেখে প্রেমে মজে গিয়েছিল। বদনের মা-বাবা ভাইবোন কেউ নেই। নিজেই নিজের বিয়ের কথা বলেছে হাসুর মামার কাছে। তারাও শাদি দিতে বিলম্ব করেনি।

সকালে গা গরম করেছে হাসুর। জ্বর উঠেছে। বদন গেছে গঞ্জে ডাক্তার আনতে। লোকনাথ ডাক্তারের কম্পাউন্ডার আছর আলী ডাক্তার এখন। মিকশ্চারের হাতটা ভালোই ছিল। রাজেনদের বাড়ি সে কয়েকবার এসেছিল লোকনাথ ডাক্তারের সঙ্গে। বাবা বলতেন, ‘পোলাডার চেষ্টা আছে, দেহিস একদিন পাক্কা ডাক্তার অইবে।’ পাক্কা হয়েছে কীনা জানে না রাজেন, তবে লোকনাথ ডাক্তার চলে যাওয়ার পর এ এলাকার ডাক্তার তো তাকেই হতে হবে। উপায় কী?

আছর আলী ডাক্তার আসার আগেই রাজেন হাসুকে উঠানে নামিয়ে মাথায় পানি ঢেলেছে এক বালতি। একটু লবণ দিয়ে করল্লার রস খাইয়ে দিয়েছে। গায়ের কাঁথাটা নিয়ে নিয়েছে। বলেছে, এবার উডানের চাইরপাশে দুইডা চক্কর দেও।

হাসু বিনাবাক্যে তার কথা শুনেছে। চক্কর শেষে সিঁড়ির ওপর এসে বসেছে। বেশ একটু সময় বসে দম নেয়ার সময় প্রচুর ঘামছিল। আছর আলী ঠিক তেমনি বহু পুরনো ফুলপ্যান্ট একটা খাকি শার্ট আর মাথায় সোলার হ্যাট পরে কাঁধে স্টেটিক্সোপ ঝুলিয়ে সাইকেলে এসেছে। পেছনের কেরিয়ারে বদন বসেছে ব্যাগটা নিয়ে।

সাইকেল চালিয়ে ওরা উঠানে ঢুকে গেছে। হাসু তখন মাথার লম্বা চুলে নিজে নিজে চিরুনি চালাচ্ছে।
কী অইল? জ্বর কই? আছর আলী ডাক্তার হতাশ। স্টেটিস্কোপ লাগিয়ে পরীক্ষা করে দ্যাখে গম্ভীর হয়ে। হাতের নাড়ি দ্যাখে। বদইন্যা মোরে খামাহা আনছো হারাডা পোথ।

জ্বর আছেলে। বলল রাজেন সূত্রধর।
আমনে কেডা?

বদন বিপুল উৎসাহে বলল, আরে চেনেন না ডাক্তার, এ দেহি মোগো সূত্রধর। মোর বাপে যার থিককা এই বাড়ি খরিদ হরছেলে।

আছর আলী ডাক্তার উঠে আসে রাজেনের কাছে, রাজেন দা না? হ। মরার আগে একফির নিজের ভিডাডা দেহার সাধ হইল। রাজেন বলে। হাসু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, না ডাক্তার চাচা, হেয়া না, উনি বলে কইলকাতা বইয়া মোরে স্বপ্নে দেখছে, মুই বলে ওনারে ডাকছি শুদ্ধ কইররা।

কইছি, তোমার জন্যে মুই অপেক্ষা করতে আছি। হেই ভয় ভয়তেই তো মোর গা গরম অইছে। আছর আলী ডাক্তার বলে, দুইননাইর এত মানুষ থাকতে আমনে ওরে স্বপ্নে দেখলেন ক্যা রাজেন দা? জানি না। তয় অরেই স্বপ্ন দেখছি। বুঝি কেমমে? আছর আলী সন্দেহ প্রকাশ করে।

বদন আলী ফাঁপড়ে আছে, তুই তো মোরে কিছু কও নাই বউ? উনি এ্যা কয় কী?
হাসু বলে ডরাইছি কি হাদে? আমনে ঝালকাডির নট্ট কোম্পানির যাত্রাগান দেখতে গেছেলেন কবে?
হেয়া তো মাসতিনেক আগেই অইবে।

হেই সোময় মুই কপালে সিন্দুর দিয়া উডানে আইয়া খাড়াইছালাম, এই কাপুড়ডা পইররা। হাসু বলে।
সিন্দুর পাইছো কই? বদন প্রচণ্ড বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে।

পাইছি। ওই যে মোগো লোহাকাডের পালঙ্কডা হেইডার তলে একটা পয়ার নিচে। কৌট্টডার একটা কান্দা জাইগগা আছেলে। খুন্তি দিয়া মাডি কোড়াইয়া হের পর বাইর হইররা দেহি, ভিতরে এককারে তাজা সিন্দুর। ছোডকাল থিককা শখ আছেলে লাল পাইরের শাড়ি পইররা, কপালে সিন্দুর দিয়া একদিন সাজমু। এইযা তো লাল পাইরেরই শাড়ি। আমনে মেলাইদদা আইননা দেছেলেন মনে নাই?

আছর আলী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, মোর বেরেনে কোনো কিছু ঢোকতেছে না। উনি হিন্দু, তোমরা মোসলমান

গ্রামের অনেকেই বদন আলীর বাড়িতে। মেয়েছেলেরাও কম নয়। সবাই কিছু না কিছু হাতে হাতে নিয়ে এসেছে, নিজের গাছের লাউ, কুমড়া, পটল, পুকুরের মাছ, চাল-ডাল, তেল, মশল্লা। শিশি-বোতলও সঙ্গে এনেছে পানি ফুঁ দিয়ে দেবার জন্য। পঞ্চাশ বছরের কাশির রোগী, ল্যাংড়া, খোঁড়া অনেকেই বাড়ির উঠানে, বাড়ির সামনে, এখানে ওখানে।

হাসু নতুন শাড়ি পেয়েছে গোটা পাঁচেক। বাতাসা সেরদুয়েক, ঝোলা গুড়ের হাঁড়িও কয়েকটা। আতপ চালও কয়েক সের, আরও কিছু কিছু। রাজেন সূত্রধর নতুন গেঞ্জি, ধুতি, ফতোয়া সব মিলিয়ে ডজনখানেক।

অনেক চেষ্টা হয়েছে রাজেন সূত্রধরকে গ্রামে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু তিনি চলে যাবেন। আমনে থাহেন কাকাবাবু। এহন তো আর আগের দিন নাই। বলেছিল হাসু আর বদন আলী। এই বাড়িতেই থাহেন। রাজেন সূত্রধর বলেছে, এই বাড়ি, এই গেরাম তো আমারই। এহন যে যাইতে আছি মেয়া, হেয়া অইল শ্বশুরবাড়ি। আবুল মাঝির পুত্র কাবুল মাঝির নৌকায় গিয়ে উঠেছিলেন ধুতি আর ফতোয়া পরে, কপালে চন্দনের টিপ।




৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×