চার্লস ডিকেন্সকে একজন ক্লাসিক এবং ব্রিটিশ লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ তিনি অসংখ্য ভালো ও আকর্ষণীয় লেখা লিখেছেন।
লেখক সম্পর্কে কিছু তথ্য-
জন্ম: ফেব্রুয়ারি ৭, ১৮১২
মৃত্যু : জুন ৯,১৮৭০
প্রধান সাহিত্যকর্ম: অলিভার টুইস্ট, এ ক্রিসমাস কার্ল, নিকোলাস নিকোলবাই,আ টেইল অব টু সিটিজ,গ্রেট এক্সপেকটেসেন
আ টেইল অব টু সিটিজ চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস।ফরাসি বিপ্লব পূর্ব নৃশংসতা ও বিপ্লব পরবর্তী সামাজিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে রচিত এর পটভূমি।ফরাসি বিপ্লব পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ,সম্প্রসারণবাদ,শোষণ ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়।তবে পটভূমির সূচি ‘সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বে’র আবেদন কতটুকুন পূরণ হয়েছে সেটা দেখার বিষয়।এছাড়াও সেই সময়ে(১৯৭৪ সনে)রাষ্ট্রের উত্থান ও বিকাশে এবং বৃহত্তর জনমানুষের আশা-আকাঙ্খার সম্পূরণে সুবিশাল এই বিপ্লবের অবদান কতটুকুন ছিল এটাও দেখার বিষয়।চার্লস ডিকেন্সের এই উপন্যাসটিতে সরাসরি ‘সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বে’র সহবস্থান ঘটে নি।যদি সহবস্থান ঘটত তবে এতো সঙ্ঘাত,হানাহানি,মারামারি ঘটত না।
চার্লস ডিকেন্সের আ টেইল অব টু সিটিজ বইটির মূল ঐতিহাসিক দৃশ্য ও ঘটনাগুলো কারলায়ের ফরাসী বিপ্লবের ওপর লিখিত বই থেকে গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে বাস্তিল পতন ও বৃদ্ধ ফাউলনের হত্যাকাণ্ডের আখ্যান কারলায়ের গ্রন্থ থেকে সরাসরি নিয়েছেন তিনি।পুরো উপন্যাসটি জুড়ে ফরাসী বিপ্লবের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ব্যাপ্ত হয়ে আছে যেখানে মূল গল্প ডা.ম্যানেট,লুসি,চারলস ডারনে ও সিডনি কার্টনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে।পটভূমির প্রতি দৃষ্টি দিলে আমরা শুধু মাত্র বিশৃঙ্খলার আঁচ পাবো কিন্তু এই আঁচের মাঝেও ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে গেছে মূল চরিত্রগুলো।শৈল্পিক ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী যার যবনিকা ঘটেছে লন্ডন এবং প্যারিসে।
‘সে ছিল প্রশংসনীয় এক সময়,সে ছিল বিশ্রী এক সম্য,সে ছিল বুদ্ধিমত্তার এক যুগ, সে ছিল বোকামির এক যুগ, সে ছিল বিশ্বাসের এক যুগারম্ভ, সে ছিল অবিশ্বাসের এক যুগারম্ভ…………’.।উপন্যাসের শুরুতে এভাবেই ডিকেন্স তাঁর মনের অসমতা প্রকাশ করেছেন।অসমতা প্রকাশ করার পেছনে তাঁর যথার্থ কারণও রয়েছে আর তা হল দুটি শহরের অভ্যন্তরীণ পার্থক্য।‘ফ্রান্স কাগজের টাকা তৈরি করছিল এবং বিক্রি করছিল, খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের নির্দেশিত পথে কিছু মানবীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদনা করে সে নিজেকে সন্তুষ্ট করছিল, যেমন একজন তরুণের হাত কেটে নেয়ার আদেশ দেয়া,তার জিহবা সাঁড়াশি দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা এবং তাঁর শরীর জীবন্ত দগ্ধ করা’। অপরপক্ষে,ইংল্যান্ড প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করার তেমন কোনও নমুনা দেখা যাচ্ছিল না। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত লোকদের সিঁদ কেটে ভয়ানক চুরি করা ও রাজপথে ডাকাতি করার মত ঘটনাগুলো প্রতি রাতেই রাজধানীতে ঘটত;চোরেরা আদালতের বৈঠকখানার মহান লর্ডের গলা থেকে হিরে কেটে ফেলত’।১৭৭৫ সালের এ সকল ঘটনা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে প্রতিনিয়ত ঘটে চলে ছিল তবে লেখক ডিকেন্সের আ টেইল অব টু সিটিজ উপন্যাসটি ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে কতিপয় ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা যা ফরাসি বিপ্লবের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
ফরাসি বিপ্লব
আমার মতে ভালোবাসা,প্রতিশোধ এবং বিশৃঙ্খলাকে প্রধান উপজীব্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে পুরো উপন্যাসটিকে বিশ্লেষণ করা যায়।অধিকাংশ উপন্যাস ভালোবাসা কেন্দ্রিক হয়ে থাকে আর এই ভালোবাসার সাথে প্রতিশোধকে জুড়িয়ে দিয়ে ডিকেন্স যে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন তার দৃষ্টান্ত বিরল।উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, লুসির প্রতি অপ্রতিরোধ্য ও গভীর প্রেম সিডনি কার্টনকে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করেছে এবং এই আত্মত্যাগ পুরো উপন্যাসটিকে এক অদ্ভুত গুরুত্বপূর্ণ দ্যোতনা দিয়েছে।চার্লস ডারনে ও সিডনি কার্টন উভয়েই লুসির প্রতি গভীর প্রেমে আসক্ত হলেও চার্লস ডারনে লুসিকে জয় করে নেয় শুধুমাত্র তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী দিয়ে। টেস অব দ্যা ডি’আরভারবিল উপন্যাসটিতে একই ত্রিভুজ প্রেমের আঁচ পাওয়া গেলেও বিপ্লবের আঁচ কিন্তু মোটেও মেলেনি।অন্যদিকে প্রতিশোধের মাত্রার কথা যদি বিবেচনা করা হয় তবে আ টেইল অব টু সিটিজ উপন্যাসকে আমি এগিয়ে রাখব কারণ এই প্রতিশোধ শেষমেশ বিপ্লবেই রূপ ধারণ করে। ম্যাকবেথ নাটকে শেক্সপিয়ার প্রতিশোধকে আবার ভিন্ন মাত্রায় রূপ দিয়েছেন,সেখানে মৃত্যুই প্রতিশোধের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করেছে কিন্তু আ টেইল অব টু সিটিজ এ মৃত্যুর কারণটা ছিল প্রেম ভিত্তিক সাথে বিপ্লব ভিত্তিক ও বটে।সামাজিক শ্রেণি প্রভেদ ছিল মূল বিপ্লবের অংশ বিশেষ যেমন- অভিজাত বংশের প্রতি সমাজের সাধারণ মানুষদের ক্ষোভ।অন্যান্যদের মধ্যে মুসিয়ে দেফারজে ও তাঁর স্ত্রী মাদাম দেফারজে দুইজনই অভিজাত বংশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয় এবং সাধারণ জনগণদের সংঘবদ্ধ করে। তৎকালীন ফ্রান্সের অন্যতম সমস্যা ছিল খাদ্যসংকট তথা অর্থনৈতিক সংকট। উপরন্তু বিপ্লবের অল্প কিছুপূর্বে দুর্ভিক্ষ এবং অর্থনৈতিক সংকট ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশেই মারাত্মক আকার ধারণ করে। ফলে বৈদেশিক সাহায্য থেকেও বঞ্চিত এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে ফ্রান্সের রাজতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। উপন্যাসটির শেষের দিকে প্যারিসের কৃষিজীবি শ্রেণির প্রভাবে বাস্তিল দুর্গে ঝড়ের সৃষ্টি হয়।এ ঝড়ের ফলে ফরাসি বিপ্লব আরেক এক ধাপ এগিয়ে যায়।
ফ্রান্সের বাস্তিল দূর্গ জ্বলছে-
আ টেইল অব টু সিটিজ উপন্যাসটি থেকে আর যাই কিছু হোক না কেনও একই সাথে অনেকগুলি বিষয় সম্পর্কে জানা সম্ভব যা অন্যান্য উপন্যাস থেকে এক ধাপ এগিয়ে আছে বলে আমি মনে করি।সুতরাং যাহারা এখনো এ উপন্যাসটি পরেন নি আজই পড়ে ফেলতে পারেন চার্লস ডিকেন্সের এই কালজয়ী সৃষ্টিটি।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:১০