সময়টা খুব বেশি দিন আগের না। এইতো গত শতকের শুরুর দিকের। টাইফয়েড বা মামুলি ইনফেকশন হলেই রোগী শেষ। এমনকি বাঘা বাঘা ডাক্তারদেরও কিছুই করার থাকত না, শুধু প্রতিক্ষা করা ছাড়া। আর প্লেগ বা কলেরার কথা নাহয় বাদই দিলাম। গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর উজার করে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হত শত্রুরূপী ব্যাক্টেরিয়াগুলো। ১৯২৮ সালে এই ব্যাক্টেরিয়াগুলোর সাথে যুদ্ধ করার জন্য ফ্লেমিং সাহেব মানুষের হাতে তুলে দিলেন খুবই কার্যকরী এক অস্ত্র। Antibiotic. সেই থেকে শুরু। বিশ্বাসের সাথে এই antibiotic রক্ষা করে যাচ্ছে কোটি প্রাণ।
তবে ইদানিং প্রায়শই শুনতে পাচ্ছি অনেকেই বলছেন "খবরদার, ভুলেও antibiotic নিও না। রোগী কষ্ট পাক কিংবা মরেই যাক, কোন সমস্যা নাই। তবু antibiotic নেয়া যাবে না।" কী এমন হল যে এতো কার্যকর একটা ওষুধের সম্পর্কে এমন সাবধানবাণী শুনতে হচ্ছে??
সত্যি কথাটা বলি? পুরোটাই একটা ভুল ধারণা। সেই সাথে আছে আমাদের কিছু অবহেলা, কিছু অসচেতনতা, সীমাহীন লোভ। বাস্তবে antibiotic হল Pharmaceutical science এর চমৎকার একটা আয়োজন, খুব সুন্দর করে design করা একটা ওষুধের শ্রেণী। খুবই নিরাপদ আর সহনশীল। বুঝতে পারছি, অনেকেই এরই মধ্যে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলেছেন। কিন্তু নিজের বুদ্ধির উপর আস্থা নিয়ে একবার ভেবে দেখেন। আমরা মুড়ি-মুড়কির মত যে antidepressent, sedative, relaxant বা অন্যান্য যে psychotic ওষুধগুলো খাচ্ছি সেগুলোর মাত্রা কত? ১, ২, ৫ বা সর্বোচ্চ ১০ মিগ্রা। আর antibiotic তো শুরুই হয় ১২৫ মিগ্রা থেকে। 1 g, 2 g cephalosporin তো এখন হরহামেশাই ব্যাবহার হচ্ছে, এমনকি 4.5 g মাত্রার antibiotic ও প্রচলিত আছে। মানে ৪ চা চামচেরও বেশি। এতো অধিক মাত্রার ওষুধ খেয়েও কেউ মারা গেছেন?? অথচ মাত্র 30 mg psychotic ওষুধ খেয়ে দেখেন, কী অবস্থাটা হয় আপনার!! এ থেকেই বোঝা যায় antibiotic শুনলেই ভয়ে লাফিয়ে উঠার কোন কারণ নাই।
হ্যাঁ, antibiotic ওষুধগুলো এভাবেই তৈরী করা হয় যেন এগুলো শুধু invader ব্যাক্টেরিয়াকেই প্রতিহত করে host মানুষকে নয়। যেমন, পেনিসিলিন আর সেফালোস্পোরিন attack করে ব্যাক্টেরিয়ার কোষপ্রাচীরকে। মানুষের কোন কোষপ্রাচীরই নাই, তো attack করবে টা কোথায়?? Azithromycin এর মত macrolide গুলো attack করে ব্যাক্টেরিয়ার রাইবোজমাল সাবইউনিট 50 S কে। আমাদের, মানে মানুষের, এই সাবইউনিট টা হচ্ছে 60 S. So, এখানেও ক্ষতির সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।
আবার বেশিরভাগ antibiotic হচ্ছে natural product. অর্থাৎ হয় সরাসরি প্রাকৃতিক বা এর থেকে active part টা বেছে নিয়ে সেটাকে বিভিন্নভাবে modify করে কৃত্রিমভাবে তৈরী করা হয়। (pharmaceutical science এ এটাকে natural prroduct ই বলে)। শুরুটা কিন্তু সেই প্রকৃতি থেকেই হয়। তাই synthetic জিনিসের প্রতি যাদের allergy আছে, তারাও antibiotic এর নিরাপত্তা বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
অনেক বিজ্ঞাপণ করলাম। পড়ে মনে হবে "আরে antibiotic তো দেখি মহান"। তবে কেনো এতো ভয়??? হ্যাঁ, ভয়ের কারণ আছে। পুরো পৃথিবী জুড়েই একটা ভয় নিয়ে সাস্থ্যবিদরা চিন্তিত। সেটা হচ্ছে antibiotic resistance. ব্যাক্টেরিয়া অতি ক্ষুদ্র হলেও এগুলো কিন্তু প্রাণ। এদেরও আছে নিজেকে রক্ষা করার ব্যাবস্থা। এগুলো ধিরে ধিরে antibioticএর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ধরেন আপনার শরীরে কিছু ব্যাক্টেরিয়া attack করল। এরপর এরা আপনার শরীরে বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করবে। আপনার শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যাবস্থাই যথেষ্ট এদের মেরে ফেলতে। তবে কোনভাবে এদের পরিমান একটা নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যাবস্থা আর কুলিয়ে উঠতে পারেনা এবং আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তারের পরামর্শে ভাল একটা antibiotic নিলেন। ব্যাক্টেরিয়ার পরিমান কমতে থাকল এবং সেই নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নেমে গেলে আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। সুস্থ হয়ে গেছেন মনে করে কোর্স শেষ হবার আগেই ওষুধ বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু মনে রাখবেন সব ব্যাক্টেরিয়া কিন্তু মারা যায়নি, এদের সংখ্যাটা কমে গেছে শুধু। বেঁচে যাওয়া ব্যাক্টেরিয়াগুলো ঐ antibioticএর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করে যা তাদের পরবর্তি প্রজন্মকে ঐ antibiotic থেকে রক্ষা করে। এর ফলে প্রতিরোধী নতুন ব্যাক্টেরিয়াগুলো যখন আপনাকে attack করবে তখন আপনি আগের সেই কার্যক্ষম antibiotic নিলেও সেটা আর কাজ করবেনা। সুতরাং ভুলটা কিন্তু antibiotic এর না, ভুলটা আমাদের।
আবার আমাদের অনেকেরই চাওয়াটা হচ্ছে অসুখ হলে দ্রুত,খুব দ্রুত, অতি দ্রুত সেটা সারিয়ে তুলতে হবে। যেনো সকালে অসুখ হলে বিকেলের মধ্যে সেরে যায়। এভাবেই ডাক্তারকে বলা হয়। ডাক্তারও উচ্চ মাত্রার আধুনিক প্রজন্মের antibiotic দেন। ওষুধ কোম্পানীগুলোর প্রতি তাদেরও দায়বদ্ধতা থাকে। আবার রোগীও চায় তাকে দামী ওষুধ দিতে হবে। আমি অনেককেই তাচ্ছিল্য করে বলতে শুনেছি "ওমুক ডাক্তার? সেতো কোনও ডাক্তারই না। ওষুধ দেয় মাত্র একটা-দুটা।" যেনো প্রেসকৃপশন প্যাডের পাতা ভরে ওষুধ লিখলেই সে বড় ডাক্তার হয়ে যায়। এভাবেই যেখানে ৮ টাকা দামের ফ্লুক্লক্সাসিলিনই যথেষ্ট ছিল, সেখানে ৩০০ টাকার সেফট্রিয়াক্সোন ইঞ্জেকশন দিয়েও ইনফেকশন ঠেকানো যাচ্ছেনা। এখানেও ভুলটা কিন্তু আমাদেরই।
সবশেষে বলি, antibiotic যতই নিরাপদ হোক না কেনো, এগুলো কিন্তু রাসায়নিক যৌগ। পার্শ্বপতিকৃয়া সব ওষুধেরই আছে। আবার অন্যান্য ওষুধের মত antibiotic গুলোকেও কাজ শেষে শরীর থেকে বের করে দিতে হয়। আর এর জন্য liver কে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। তবে সেটা কিন্তু প্যারাসিটামল যা আমরা শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বেড়ে গেলেই টপাটপ খেয়ে ফেলি সেটার জন্যও প্রযোজ্য, শুধুই antibiotic এর জন্য নয়।
আরেকটা কথা বলে ফেলি। অনেকেই দেখি প্রচলিত ওষুধকে কেমন যেনো বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতে পছন্দ করেন। যেনো এইগুলো কোন ওষুধের জাতের মধ্যেই পড়ে না। ওষুধ মানেই হচ্ছে হার্বাল, ইউনানী, আয়ুর্বেদিক বা হোমিওপ্যাথী ওষুধ। এগুলোর কোন পার্শ্বপতিকৃয়া নাই। দয়া করে এই আদিম ধারণাটা বদলান। এগুলো অবশ্যই বেশ ভালো মানের ওষুধ। এগুলো থেকেই উপাদানগুলো কেবল পৃথক করে প্রচলিত ওষুধ তৈরী করা হয়। আর এর জন্য নতুন একটা ওষুধ তৈরী করতে বড় বড় ওষুধ কোম্পানীগুলোকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করতে হয়। অনেক শ্রম দিয়ে, অনেক পরীক্ষা, অনেক নিরিক্ষার পরই কেবল একটা ওষুধ বাজারে ছাড়া হয়। তার আগে নয়।
আর এই লেখাটা মেডিক্যাল বা ফার্মাসিউটিক্যাল সংশ্লিষ্টদের জন্য নয়। সুতরাং, সস্তা জ্ঞান বিলাচ্ছি এই অভিযোগ করবেন না প্লিজ। ওষুধ, বিশেষত antibiotic সম্পর্কে গণমানুষের ভীতি বা ভুল যে ধারণা, সেটাকে বদলানোর জন্যেই এই চেষ্টাটুকু।
সবাই ভালো থাকবেন, অনেক ভালো থাকবেন। ওষুধ থেকে দূরে থাকবেন যতটা পারা যায়। তবে অসুখ হলে তো ওষুধ খেতেই হবে। "মরে যাব, তবু antibiotic নিব না" দয়া করে এই ধারণাটা রাখবেন না। আর হ্যাঁ, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ মত, নিয়ম মাফিক এবং পুরো কোর্স।
জগতের সবার সুসাস্থ্য কামনা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১:৫৫