somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রণেশ ঠাকুর, ‍তুমি পালাও, আরো দুঃসময় আসছে

১৯ শে মে, ২০২০ বিকাল ৫:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি এসি ঘরে বসে সংবাদপত্রের খবর পড়ে কিংবা টিভির খবর দেখে, সেই খবরের সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখি না। প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াই, জীবন ও জনপদ দেখি, যে জনপদ নিয়ে লিখি সেখানে বারবার গিয়ে সেখানকার মানুষের হৃদয় ও জনপদের হাওয়াটা বুঝতে চেষ্টা করি, জীবন ছেকে রসদ নিয়ে এসে তারপর লিখতে বসি। লক-ডাউনের আগে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম উপন্যাসের তথ্য সংগ্রহের জন্য, একটা বাইসাইকেল ভাড়া নিয়ে চষে বেড়িয়েছি গ্রামের পর গ্রাম। মানুষের সাথে কথা বলে এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে আমি কি বাংলাদেশে আছি, নাকি এটা আফগানিস্তানের তালেবান শাসিত কোনো জনপদ? খুব সতর্কতার সাথে বেছে বেছে মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করেছি-আপনাদের এখানে বাউলগান হয়?
উত্তর পেয়েছি-‘না।’
‘কেন আপনারা গান-টান শোনেন না?’
‘না। হইতে দেয় না।’
‘কারা হইতে দেয় না?’
‘মাওলানারা।’
‘এদিকে ওয়াজ হয়?’
‘হা খুব। শীতকালে তো শুধু ওয়াজই হয়।’
বেশকিছু মানুষের কণ্ঠে এই একই কথা ধ্বনিত হয়েছে। এখানে গ্রামের পর গ্রামে গত দুই-তিন দশকে কোনো বাউল কিংবা শিল্পীর পা পড়েনি, সেখানে একতারা কিংবা দোতারার সুর বাজেনি। বাউলের জায়গা দখল করে নিয়েছে ওয়াজীরা। সেখানে তরুণরা ছোট ছোট হোটেলে কিংবা মুদি দোকানে ওয়াজ শোনে লাউড স্পিকারে, হাতের মোবাইলে ওয়াজ শোনে। চৈত্রের দুপুরের রোদে সাইকেল চালিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাঝে মাঝে আমার কান্না পেত-আহারে হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ, শাহ আব্দুল করিম, রামকানাই দাশ, সুষমা দাসের প্রাণের ভাটির জনপদ; যে জনপদের মাঠে-ঘাটে শোনা যেত বাউলের সুর, সেই জনপদের আজ এ কী দশা!
একবার ভাবুন, একটা জনপদের মানুষ বছরের পর বছর গান শোনে না, সিনেমা দ্যাখে না, বই পড়ে না, যাত্রা-নাটক দ্যাখে না, অনেকে টেলিভিশনও দ্যাখে না, কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে তারা নেই; উপরন্তু ওয়াজীদের উগ্র বয়ান তাদেরকে হিংস্র করে তুলেছে! এইসব মানুষেরা মানুষ খুন করবে না তো কারা করবে?
এই দশা শুধু সুনামগঞ্জের নয়, সারা বাংলাদেশের; সুনামগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, ফেনী, নোয়াখালী অঞ্চলে হয়ত একটু বেশি; কিন্তু বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র এখন এটাই, এটাই বর্তমানের প্রকৃত বাংলাদেশ। একবার স্কুল ছুটির সময় বাসে আসার পথে চট্টগ্রামের পটিয়ায় অসংখ্য হিজাব-বোরখা পরা ছাত্রীদের দেখে মনে হয়েছিল পটিয়া বুঝি বাংলাদেশে থেকে বিচ্ছিন্ন!
বাংলাদেশের সাংস্কৃতি বিপর্যয় ঘটে গেছে, আরো ঘটবে। আমি শাহ আরেফিনের আস্তানা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, বাংলার সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ে এই সুফিরাও কি কম ভূমিকা রেখেছে? তাইতো এইসব সুফিদের নামে আজ এতো কিছু হয়। যাদুকাটা নদীতে শাহ আরেফিনের নামে সেতু হচ্ছে। অনেক মডারেট মুসলিম ভাবে সুফিরা শান্তিবাদী ছিলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম প্রচার করেছেন। এরা হয় অজ্ঞ, নয়তো ধুরন্ধর। বেশিরভাগ সুফিই তো এসেছিল মুহাম্মদ ঘোরীর মতো যোদ্ধাদের সঙ্গে, তারা কেউ ভারতবর্ষের মানুষদের ধর্মান্তরে এবং লুটপাটে মদত দিয়েছে যোদ্ধাদের, কেউ কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেছে। সিলেটের শাহজালাল, সুনামগঞ্জের শাহ আরেফিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া শাহ সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ (রহ.) ওরফে শাহ পীর অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে, যুদ্ধজয় এবং লুটপাটের পর তারা শান্তিবাদী সেজেছেন। এরা কেবল জনপদের ধর্ম বদলাননি, বদলে দিয়েছেন বাঙালী মুসলমানের জীবনাচার, খাদ্যাভাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি। এদের হাতে বাংলার ব্যাপক সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে।
আগে বাউলরা গ্রামে গ্রামে গান করে বেড়াতেন, গান গেয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন, কিন্তু এখন আর তারা আগের মত বায়না পান না। কারণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জায়গা ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে আর সম্প্রসারিত হয়েছে ওয়াজের অপসংস্কৃতি। একসময় তৃণমুলে যারা গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, গত দশ-পনের বছর যাবৎ তাদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে, জীবিকার জন্য তাদেরকে অন্য পেশায় যুক্ত হতে হয়েছে।

তৃণমুলে এখনো যেসব বাউলশিল্পীরা আছেন, তারা মরমে মরে থাকেন, ভয়ে থাকেন যে কখন তাদের ওপর আক্রমণ হয়। প্রায়ই তাদের ওপর আক্রমণের কথা শোনা যায়, তাদের চুল-দাড়ি কেটে দেবার কথা শোনা যায়, তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেবার কথা শোনা যায়।
দেশের এই অবস্থার জন্য আমাদের আগের প্রজন্মের শহুরে সংস্কৃতিকর্মীরা অনেকটা দায়ী, তারা এইসব নিপীড়ন এবং পরিবর্তন আঁচ করলেও আমলে নেয়নি, কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানায়নি, সরকারের বিরুদ্ধে তাদের উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়নি, বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাবার পরিবর্তে সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছে এবং নানান সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। এইসব নাগরিক ধুরন্ধর শিল্পীরা সরকারী অনুদান-পুরস্কারের পিছনে ছুটেছে, কালেভদ্রে তৃণমুলের কোনো শিল্পীকে ঢাকার মঞ্চে এনে তার শিল্পকলা প্রদর্শনের সুযোগ করে দিয়ে ভেবেছে, তোমার জীবন ধন্য করে দিয়েছি!
আচ্ছা ক’জন তৃণমুলের শিল্পী স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পদক পেয়েছে? তারা সত্যিকারের শিল্পী, রাজনীতি ঘেঁষা এবং রাজনীতিকের হাতের পুতুল নয় বলে তারা বঞ্চিত থাকে। নাগরিক শিল্পীরা নিজেদেরকে তৃণমুলের শিল্পীদের চেয়ে উঁচু শ্রেণির শিল্পী বলে বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করে থাকে।

প্রত্যন্ত গ্রামে গেলেও মসজিদের আজানে কানে তালা লেগে যায়, তারপরও হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রত্যেক উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা করে সরকার, অথচ স্বাধীনতার এতো বছর পরেও উপজেলা পর্যায়ে শিল্পকলা একাডেমী গড়ে ওঠেনি, এসবের বিরুদ্ধে সরব হয় না নাগরিকশিল্পী নামক চাটুকারেরা। অথচ তৃণমুলের শিল্পী ও শিল্প না বাঁচলে, নগরেও যে একটা সময়ে শিল্পী ও শিল্প বাঁচবে না, এই বোধটি তাদের নেই। অপসংস্কৃতি তৃণমুল গ্রাস করার পর তাদের জিহ্বা বাড়িয়ে দেবে নগরের দিকে, কিন্তু তখন সময় ফুরিয়ে যাবে, বাঁচার উপায় থাকবে না।
সুনামগঞ্জে রণেশ ঠাকুরের বাড়ি কারা পুড়িয়ে দিয়েছে তা সকলেই জানে, তারপরও অধিকাংশ সংস্কৃতিকর্মী চুপ করে আছে, কেউ মুখ খুললেও গলাভরা ‘দুবৃত্ত’ শব্দটি ব্যবহার করছে। এই দুবৃত্ত কারা? যে লোকটি বলেছিল-‘আমি প্রেরিত হয়েছি মূর্তি এবং বাদ্যযন্ত্র ধ্বংস করার জন্য’; এরা তার অনুসারী- মুসলমান।
রণেশ ঠাকুর পালাও, যদি লড়াই করার নূন্যতম জায়গা থাকতো তাহলে বলতাম, ‘রণেশ ঠাকুর, দাঁড়াও, লড়াই করো।’ কিন্তু এটা লড়াই করার জায়গা নয়, রেফারি নিরপেক্ষ নয়; এখানে বাঁশি বাজবে সর্বদাই তোমার বিপক্ষে আর আহমদ শফি হুজুরদের পক্ষে। ফলে মাঠের খেলুড়েরা তোমার বাড়ি পোড়াবে, আখড়া পোড়াবে, এমনকি তোমাকে প্রাণেও মারবে। রণেশ ঠাকুর, তুমি তো বাউল মানুষ, অতো ইতিহাস পড়ো না, তোমায় একটা ঘটনা বলি শোনো- আরবে এক সময় ‘ওকাজের মেলা’ নামক একটা মেলা হত। সেই মেলায় সারা আরব থেকে কবি, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, যন্ত্রশিল্পীরা আসতেন, সাতদিন ভরে তারা তাদের কলানৈপুণ্য পদর্শণ করতেন। কবিতার প্রতিযোগিতায় যে কবিতাটি সেরা হতো, সেই কবিতাটি সোনালী পাতে লিখে কাবাঘরে ঝোলানো হতো। সেখানে এতোটাই সম্মানিত ছিলেন শিল্পী-কবিরা।
রণেশ ঠাকুর, সেই সোনালী পাতে লেখা কবিতা এখন কোথায়? কোথায় সেই বিখ্যাত ওকাজের মেলা? রণেশ ঠাকুর, কেবল তোমার ভাটি অঞ্চল নয়, সমগ্র বাংলাদেশের পরিণতি ওই ওকাজের মেলা’র মতোই হতে চলেছে। রণেশ ঠাকুর, তুমি পালাও, আরো দুঃসময় আসছে!

মে, ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০২০ বিকাল ৫:৩৮
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×