somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার ‘দেবদ্রোহ’ উপন্যাসের ক্যানভাসে যে-ভাবে এঁকেছি সরস্বতীকে

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার ‘দেবদ্রোহ’ উপন্যাসের ক্যানভাসে যে-ভাবে এঁকেছি সরস্বতীকে

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের এক আদিবাসী বুদ্ধিজীবী ফেসবুকে হিন্দুধর্মের বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে নিয়ে একটি পোস্ট করেছেন, পোস্টটি সরাসরি তুলে দিচ্ছি- ‘পিতার সাথে কন্যার যৌন সম্পর্কের প্রতীক এই সরস্বতী। শিক্ষায়তনে সরস্বতী পূজা করা নিষিদ্ধ হোক।’

লক্ষ্য করলাম যে এই পোস্টটি নিয়ে বেশ বিতর্ক হচ্ছে, এই পোস্ট এবং বিতর্ক দেখে আমার মনে হলো- আমি যেহেতু বেশ কয়েক বছর যাবৎ পুরাণ নিয়ে পড়াশোনা করছি; পুরাণের আখ্যান, সমাজ, চরিত্র এবং সম্পর্কগুলি অলৌকিকভাবে না দেখে লৌকিক মননে ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছি, আর তারই নির্যাস হিসেবে বর্তমানে ‘দেবদ্রোহ’ নামে যে উপন্যাসটি লিখছি; যে-উপন্যাসে সরস্বতী চরিত্রটি থাকছে, সুতরাং সরস্বতীকে নিয়ে কিছু লিখি।

আদিবাসী বুদ্ধিজীবী তার ফেসবুক পোস্টে দুটি বাক্য লিখেছেন, আমি আগে তার প্রথম বাক্যটি নিয়ে বলি, তিনি লিখেছেন- ‘পিতার সাথে কন্যার যৌন সম্পর্কের প্রতীক এই সরস্বতী’। পিতা বলতে তিনি ব্রহ্মাকে বুঝিয়েছেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে ব্রহ্মা কে? হাজার হাজার বছর আগে (জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্স মুলার মনে করেন আর্যরা ভারতে এসেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ শতাব্দী নাগাদ, যা আমি প্রত্যাখান করেছি। বস্তুতপক্ষে আর্যরা এসেছিল আরো কয়েক হাজার বছর আগে) আর্যদের যে দলটি ভারতবর্ষের শিবালিক পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে তাদের নেতা ছিলেন ব্রহ্মা, এজন্যই বলা হয় ব্রহ্মা আদি পিতা। বস্তুত ব্রহ্মা একটি পদ, এক ব্রহ্মার মৃত্যু হলে বা ঘটনাক্রমে অপসারিত হলে আরেকজন ব্রহ্মা পদে বসতেন। ব্রহ্মার সাতজন উপদেষ্টা ছিল, যাদেরকে সপ্তর্ষীমণ্ডলী বলা হত, এঁরা সমাজ পরিচালনায় ব্রহ্মাকে পরামর্শ দিতেন বা সহযোগিতা করতেন। পরবর্তীকালের ব্রহ্মাগণ আরো কিছু পদ সৃষ্টি করেছিলেন যেমন- বিষ্ণু, অগ্নি, ইন্দ্র, নারদ, প্রজাপতি, সরস্বতী ইত্যাদি।

এবার সরস্বতী প্রসঙ্গে আসি, সরস্বতী কে? আমি আমার ‘দেবদ্রোহ’ উপন্যাসে যে আখ্যানের জন্ম দিচ্ছি, তাতে দেখিয়েছি- সরস্বতী স্বর্গের (কোনো অলৌকিক ঊর্ধ্বলোক নয়, ভারতের উত্তরাখণ্ডের একটি অঞ্চলকে আমি স্বর্গ হিসেবে দেখাচ্ছি, আরো প্রাচীনকালে স্বর্গ ছিল ইলাবৃতবর্ষে) একটি পদ, যে পদে অধিষ্ঠিত হতেন শাস্ত্র এবং সংগীতে পারদর্শী কোনো গুণবতী নারী; যিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শাস্ত্র-সংগীত শিক্ষা দিতেন ছেলে-মেয়েদেরকে। বিশেষত সরস্বতী মেয়েদেরকে খুব উদ্বুদ্ধ করতেন শাস্ত্র ও সংগীত শিক্ষায়। কেবল স্বর্গই নয়, মর্তের (স্বর্গের চেয়ে কিছুটা নিচের দিকের জনপদ) মেয়েদেরকেও সরস্বতী উদ্বুদ্ধ করতেন বিভিন্ন সময়ে বার্তা পাঠিয়ে। সেই যুগে সরস্বতী হয়ে উঠেছিলেন মেয়েদের আদর্শ। একজন সরস্বতী অবসরে গেলে বা মারা গেলে স্বর্গের সবচেয়ে যোগ্য শাস্ত্রজ্ঞ এবং সংগীতজ্ঞ সেই শূন্য পদে অধিষ্ঠিত হতেন। আমি দেবতাদেরকে মানুষের কল্পনার অলৌকিক ঊর্ধ্বআকাশ থেকে বাস্তবতার ভূখণ্ডে নামিয়ে রক্তে-মাংসে গড়তে চেষ্টা করছি। সেই সমাজে সরস্বতীর এতোটাই প্রভাব ছিল যে মানুষ সেই সময়ের প্রধান এক নদীর নাম রেখেছিলেন সরস্বতী।

জাতীর পিতা যেমনি আমাদের সকলের বায়োলজিক্যাল পিতা নন; তেমনি ব্রহ্মাও দেবতা, মানব, দৈত্য এবং দানব এই চার গোষ্ঠীর সকলের বায়োলজিক্যাল পিতা নন। সঙ্গত কারণেই ব্রহ্মা সরস্বতীর বায়োলজিক্যাল পিতা নন বলেই আমি মনে করি। কেননা ততদিনে পিতা এবং কন্যার যৌন সঙ্গমের প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল, কেননা সেই সময়ে স্বর্গের দেবগোষ্ঠী কিংবা মর্তের মানবগোষ্ঠীর মধ্যে পিতা এবং কন্যার বিবাহ কিংবা যৌনসঙ্গম সম্পর্কিত আর কোনো আখ্যান খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু আরো অতীতে ছিল, অতীতে মাতৃগমনও ছিল। সে-সব প্রথা এই সময়ের আগেই বন্ধ হয়েছিল বলেই আমার মনে হয়। যদিও তখনও ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। কেননা এই সময়ের কিছুকাল পরেও আদি ব্রহ্মার মানসপুত্র স্বায়ম্ভূব মনুর দশম প্রজন্ম পৃথু তার বোন অর্চিকে বিয়ে করেছিলেন। পৃথু এবং অর্চির পিতা ছিলেন নৃপতি বেণ, এই বেণই আমার উপন্যাসের নায়ক।

ব্রহ্মা পদে যারা বসতেন তারা কেউ কেউ হয়তো ভালো ছিলেন, কিন্তু অধিকাংশ ব্রহ্মাই ছিলেন অতি কামাচারী-ব্যাভিচারী। কেবল ব্রহ্মাই নন, আরো অনেক দেবতাই অতি কামাচারী-ব্যাভিচারী এবং উশৃঙ্খল স্বভাবের ছিলেন। এটা হয়তো অন্য কোনো কোনো দেবতারাও ভালো চোখে দেখতেন না, যে কারণে পরের দিকে ব্রহ্মা পদের আর তেমন প্রভাব থাকনি। বিষ্ণু, অগ্নি, ইন্দ্র, বায়ু প্রভৃতি দেবতাগণ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। যদিও এদের মধ্যে আবার ইন্দ্রকে মদ্যপ আর অতি কামাচারী-ব্যাভিচারী হয়ে উঠতে দেখা যায়, যদিও সব ইন্দ্র-ই যে এমন ছিলেন তা বলা যায় না, কোনো কোনো ইন্দ্র নিশ্চয় ভালো ছিলেন। তবে বেশিরভাগ ইন্দ্রই হয়তো ক্ষমতার প্রভাবে ব্যভিচারী হয়ে উঠতেন, এজন্যই ইন্দ্র পদে খুব ঘন ঘন পরিবর্তন হতে দেখা যায়। তবে অনার্যদের আরাধ্যপুরুষ শিব পদে যারা বসতেন, এরা অতি কামাচারী বা ধর্ষক প্রবৃত্তির ছিলেন না, মোটামুটি সবাই একই ধরনের যোগী স্বভাবের ছিলেন। হয়তো একারণেই হিন্দু নারীরা আজও শিবের মতো বর চায়, আর উত্তরের পাহাড় থেকে দক্ষিণের সমুদ্র পর্যন্ত শিবের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি।

আদিবাসী বুদ্ধিজীবীর ফেসবুক পোস্ট পড়লে মনে হয় যেন- সরস্বতী স্বেচ্ছায় ব্রহ্মার সঙ্গে সঙ্গম করেছেন, ঘটনা তা ছিল না। তখন যিনি সরস্বতী পদে ছিলেন তার নাম ছিল বাক্। এই বাক্ বা সরস্বতীকে ব্রহ্মা কামনা করেছিলেন, কিন্তু সরস্বতী রাজি তো হনইনি উপরন্তু পালিয়েছিলেন। কিন্তু পালিয়েও সরস্বতী রক্ষা পাননি, ব্রহ্মা তাকে ধর্ষণ করেছিলেন। কোনো নারী যদি ধর্ষণের শিকার হন, তার দায় কি সেই নারীর? আদিবাসী বুদ্ধিজীবি ‘পিতার সাথে কন্যার যৌন সম্পর্কের প্রতীক এই সরস্বতী’ এই কথা বলে কেবল সরস্বতীকেই অপমান করেননি, ধর্ষণের শিকার সকল নারীকেই অপমান করেছেন। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের দুই লক্ষ মা-বোনকে ধর্ষণ করেছিল পাকিস্তানী এবং তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা। এর দায় কি আমরা দুই লক্ষ মা-বোনকে দেব, নাকি তাদের প্রতি সমবেদনা জানাবো? আদিবাসী বুদ্ধিজীবী ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে সরস্বতীর বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার নারীদেরকেও যে নিকৃষ্টভাবে অপমান করেছেন, তা বোঝার মতো বোধগম্যতাই হয়তো-বা তার নেই!

বরং এই প্রশ্ন উঠতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হওয়া উচিত কি না? আমি এই প্রশ্নের উত্তরে বলবো- না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো পূজা, ঈদে মিলাদুননবী, মিলাদ মাহফিল এসব হতে পারে না। এমনকি পাঠ্যসূচিতে ধর্ম বইও থাকা উচিত নয়। ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, এর চর্চা ব্যক্তিগতভাবেই থাকা উচিত, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নয়। একজন নাস্তিক তার সন্তানকে ধর্ম বই পড়াতে না-ই চাইতে পারেন, এই না চাওয়ার অধিকার অবশ্যই থাকা উচিত।

এবার সরস্বতী প্রসঙ্গে আমার কথা বলি- দশমশ্রেণিতে পড়ার সময় আমার উদ্যোগে আমাদের পাড়ার কিশোররা মিলে সরস্বতী পূজা করেছিলাম, আমি প্রথম দু-বার নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। তারপর লেখাপড়ার জন্য আমি বাড়ির বাইরে চলে আসি, আমার বিশ্বাস বদলে যায়, আমি আর কখনো সেই সরস্বতী পূজায় উপস্থিত থাকিনি। আজও সেখানে পূজা হয়, আমি আমি যাই না। সরস্বতী আমার কাছে কোনো অলৌকিক দেবী নন, রক্ত মাংসে গড়া দেবতাগোষ্ঠীর গুণবতী নারী ছিলেন সরস্বতীগণ। পূজা নয়; আমরা কি লতা মুঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কিশোরী আমানকর, রুনা লায়নাকে পূজা করবো? নিশ্চয় নয়, তবে শ্রদ্ধায় স্মরণ করবো। সরস্বতী পদে অধিষ্ঠিত সেই নারীদেরকে আমি শ্রদ্ধায় স্মরণ করি, যারা সংগীতকে এগিয়ে দিয়েছিলেন বলেই হয়তো এই গভীররাত্রে আমি কৌশিকী চক্রবর্তীর রাগ বাগেশ্রীতে অবগাহন করে এই লেখা লিখতে পারছি!

ঢাকা
ফেব্রুয়ারি ২০২২




সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:০২
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×