somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- দশ)

১১ ই অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৪:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছয়

বহির্ষ্মতীতে দেবগণ ও অপ্সরাদের দিনগুলো বেশ সানন্দেই অতিবাহিত হতে থাকে, তাদের আহার-বিহার-নিদ্রায় কোনো অসুবিধা হয় না, নৃপতি বেণ এবং অন্যান্য মানুষেরা তাদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেন না। বেণের গৃহে নিত্যদিনই তাদের জন্য নানারকম আহার ও পানীয়ের আয়োজন থাকে, এছাড়াও অন্যান্য মানুষের গৃহ থেকেও নিত্যদিন তাদের জন্য কোনো না কোনো আহার সামগ্রী ও পানীয় আসে। কোনো কোনো দিন তারা প্রভাতে বেরিয়ে পড়েন, পাহাড়-অরণ্য ভ্রমণ করেন, আশপাশের ঋষিদের আশ্রমে গিয়ে সমাজ কিংবা শাস্ত্রীয় বিষয়ে আলোচনা করেন, অন্যান্য মানুষের গৃহেও আতিথ্য গ্রহণ করেন, তারপর বেণের গৃহে ফিরে আসেন সন্ধ্যার আগে। কোনো কোনো দিন ফেরেন না, না ফেরার সংবাদ বেণের কাছে পাঠিয়ে তারা কোনো ঋষির আশ্রম কিংবা বিশিষ্ট কোনো মানুষের গৃহে রাত্রিযাপন করেন।

ঋষি অত্রি আর অপ্সরা সুরোত্তমা ব্যতিত অন্য তিনজন দেব আর দুজন অপ্সরা অঙ্গ’র সঙ্গে বেরিয়ে উপস্থিত হন ব্রহ্মাবর্তের একজন প্রখ্যাত নারী ঋষি দেবায়ণীর আশ্রমে; ঋষি অত্রির শরীরটা হঠাৎ খারাপ হওয়ায় তিনি গৃহে বিশ্রাম নিচ্ছেন আর সুরোত্তমা বেরিয়েছেন বেণের সঙ্গে। সুরোত্তমা সেই যে নৃপতি-অভিষেকের রাত্রে বেণের বাহুডোরে বাঁধা পড়েছেন, তারপর একটি দিনও বেণের থেকে দূরে থাকেননি! বেণ নিজেই সুরোত্তমাকে অশ্বে আরোহণ করিয়ে নানা স্থান ভ্রমণ করিয়ে আনেন। ব্রহ্মাবর্তের উত্তর-পূর্ব দিকে ঋষি দেবায়ণীর আশ্রমের অবস্থান, বহির্ষ্মতী থেকে সরস্বতী নদীর পার ধরে তিন ক্রোশ পথ উত্তরে গিয়ে তারপর সরস্বতীর পার ছেড়ে যেতে হয় পূর্বদিকে, যদি ঝড়-বৃষ্টির মতো কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ নেমে না আসে তাহলে বেণের গৃহ থেকে প্রভাতকালে যাত্রা করে অপরাহ্ণের মধ্যেই আশ্রমে পৌঁছানো যায়। মনোরম এক ঝরনার কাছে দেবায়ণীর আশ্রমটি, বারোমাস এই ঝরনায় জল থাকে, এমনকি গ্রীষ্মকালেও, যদিও জলধারা তখন কিছুটা ক্ষীণ হয়ে যায়। যেহেতু প্রায় সারা দিনের পথ, তাই ফেরার উপায় নেই, দেবগণ বেণকে জানিয়ে এসেছেন যে তারা কয়েকটা দিন থাকবেন তপস্বিনী দেবায়ণীর আশ্রমে, তার আশ্রমের আশপাশের অন্যান্য ঋষিদের আশ্রম এবং বসতি ঘুরে দেখে তারপর তারা বহির্ষ্মতীতে ফিরবেন।

দেবায়ণী আটাশ বৎসরের অনিন্দ্যসুন্দরী প্রথিতযশা তপস্বিনী, ব্রহ্মাবর্ত তো বটেই, স্বর্গেও তার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি পৌঁছে গেছে। অব্রাহ্মণ হয়েও শাস্ত্রীয় জ্ঞানে তিনি অতি উচ্চমার্গে পৌঁছে গেছেন, তর্কযুদ্ধে অনেক খ্যাতিমান ঋষিও তার কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন এবং তাকে সুপণ্ডিত হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন। অবশ্য শুরুতে পণ্ডিত হিসেবে পুরুষ ঋষিরা তাকে স্বীকৃতি দিতে চাননি, বরং নারী হিসেবে তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন যথেষ্ঠ। একের পর এক তর্কযুদ্ধে ঋষিদের হারিয়ে তবেই তাকে নিজের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়ে নিজেকে উচ্চতর মার্গে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। অবশ্য শুধু খ্যাতি নয়, তার সম্পর্কে কিছু দুর্নামও রটেছে এজন্য যে কোনো কোনো শাস্ত্রীয় বিধান এবং প্রচলিত কিছু আচারানুষ্ঠান তিনি বিনা প্রশ্নে মেনে নেন না, এসব বিষয়ে তিনি অন্ধের মতো বিশ্বাস না করে সংশয় প্রকাশ করেন, প্রশ্ন তোলেন। কোনো কোনো ঋষি তার প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দিতে না পারলেও শাস্ত্রীয় বিধান এবং প্রচলিত রীতি যে অভ্রান্ত সেই ব্যাপারে অনড় থাকেন। যুক্তি দিতে না পারলেও নিজের হার স্বীকার করেন না, ঢাল হিবেবে কেবল শাস্ত্রীয় বাক্য ব্যবহার করেন। এইসব ঋষি-ই দেবায়ণী সম্পর্কে অনেক দুর্নাম রটিয়েছেন ব্রহ্মাবর্তের মানব এবং স্বর্গের দেবতাদের মাঝে। আজকের এই অতিথি দেবতা এবং অপ্সরাগণ দেবায়ণীর খ্যাতি এবং দুর্নামের কথা স্বর্গে বসেই শুনেছেন, আর ব্রহ্মাবর্তে আসার পর তাদের মনে হয় দেবায়ণীর আশ্রমের এত কাছে যখন এসেই পড়েছেন তখন একবার দেখা করেই যাবেন। সে-জন্যই আজ এসেছেন।

দেবগণ ও অপ্সরাদের আগমনে দেবায়ণী এবং অন্য আশ্রম কন্যারা যারপরনাই আনন্দিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে চরণ ধোয়ার জল দেন; জল, ফল ও পায়েস দিয়ে আপ্যায়ন করেন। তারপর তারা স্নানাহার সেরে বিশ্রাম করেন। এখন রাতের আঁধার নেমেছে, শাল্মলী তুলো যেমনি বাতাসে ভেসে আসে তেমনি উত্তরের শ্বেত-পর্বতের দিক থেকে ভেসে আসছে শুভ্র মেঘ, ঠান্ডা পড়েছে বেশ। মাঝখানে জ্বলন্ত মৃৎ-প্রদীপ রেখে আশ্রমের অলিন্দে উপবেশন করেন সকলে, নানা বিষয়ে আলাপ চলতে থাকে। কল্পক বলেন, ‘তপস্বিনী, আপনারা এখানে কতজন আছেন?’

‘আমি এবং আরো ছয়টি কন্যা আছে।’

‘আপনাদের আশ্রমটি বড়ই মনোরম, এখনকার প্রকৃতিও মায়াময়! কিন্তু এখানে আসবার পথে কিরাতদের বসতি দেখেছি, শুনেছি অদূরে নিষাদদের বসতিও আছে, ওরা আপনাদের বিরক্ত করে না, তপশ্চর্যায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে না?’

‘তা কেন করবে! আমরা তো ওদের কোনো ক্ষতি করি না, ওরাও আমাদের ক্ষতি করে না। ওরা ওদের মতো থাকে, আমরা আমাদের মতো। বরং কখনো কখনো ওরা পশু শিকার করতে আশ্রমের কাছে এসে পড়লে আমাদের শাস্ত্র পাঠ কিংবা গীত ওদের কানে গেলে ওরা দাঁড়িয়ে শোনে, আমাদের কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে হেসে শাস্ত্রপাঠ কিংবা গীতের প্রশংসা করে। বেশ কয়েকবার আহারের জন্য আমাদেরকে খরগোশ আর বুনো পায়রা দিয়ে গেছে।’

দেবতা বায়ু বলেন, ‘অনার্যরা কুতসিৎ আর হিংস্র!’

দেবায়ণী করজোড়ে বায়ুর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ক্ষমা করবেন ঋভু, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। আপনার মতো আমারও এই ভ্রান্ত ধারণা ছিল, কিন্তু এখানে আসার পর বুঝেছি যে ওদেরকে কেউ আঘাত করলে তবেই ওরা প্রত্যাঘাত করে। ওরা আগে থেকে কাউকে আঘাত করে না। আর গাত্রবর্ণ কিংবা চ্যাপ্টা নাকের জন্য ওদেরকে কুতসিৎ বলছেন তো? ওরাও আমাদেরই মতো ঈশ্বরের সৃষ্টি, ঈশ্বর ওদেরকেও হৃদয় দিয়েছেন, আর মানুষের প্রকৃত সৌন্ধর্য তো থাকে হৃদয়ে, গাত্রবর্ণে নয়।’

বায়ু আবার বলেন, ‘যাই বলুন, ওদেরকে এড়িয়ে চলাই শ্রেয়, দেবপতি ইন্দ্রের তেমনই নির্দেশ।’

‘বোধ হয় দেবপতি ইন্দ্র কেবল ওদের দিকে বাণ-ই ছুঁড়েছেন, কখনো ওদের পাশে বসে ওদের কথা শোনেননি। তাই ওদের সম্পর্কে তার মনের মধ্যে ঘৃণা আর ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে, আমার বিশ্বাস তিনি ওদের সঙ্গে মিশলে, আমার-ই মতো তার ধারণাও বদলে যাবে।’

দেব এবং অপ্সরাগণ নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চায়ি করেন। একজন আশ্রমকন্যা কাটা ফলের দুটি পাত্র সকলের মাঝখানে নামিয়ে রেখে চলে যায়, চলে যাবার আগ পর্যন্ত কন্যাটিকে তীক্ষ্ণ চোখে নিরীক্ষণ করেন অপ্সরা ও দেবগণ।

কল্পক বলেন, ‘এই কন্যাদের আপনি কোথায় পেলেন তপস্বিনী? এরাও কি শাস্ত্র চর্চা করেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ ঋভু, কন্যারাও শাস্ত্রচর্চা করে। এই কন্যারা নানা কারণে সমাজে ব্রাত্য ছিল। সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কেউ নিজেই গৃহত্যাগ করে চলে এসেছে, আবার কাউকে কাউকে তাদের পিতা বা ভ্রাতা নিজে এসে রেখে গেছেন সমাজের গ্লানি সইতে না পেরে।’
অপ্সরা কমলা বলেন, ‘এই কন্যাটি কি সত্যিকারেই কন্যা, না কি বৃহন্নলা?’

‘সত্যিকারেই কন্যা, ওর নাম বৃন্দা। শাস্ত্রের বৈষম্যের শিকার হয়ে সে সমাজে ব্রাত্য ছিল, তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই এখানে এসেছে।’

‘শাস্ত্র কখনো বৈষম্য করে না তপস্বিনী, শাস্ত্রের বচন সর্বদাই সত্য।’ দেবতা লেখ বলেন।

‘যৎকিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম বাদে, শাস্ত্রের প্রায় সকল বচনই তো পুরুষদের সৃষ্টি, আর যা কিছু পুরুষদের সৃষ্টি, তা নারীর প্রতি কিছু বৈষম্য আর অন্যায় করে বৈকি।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলেন দেবায়ণী।

দেব এবং অপ্সরাগণ বিস্ময়ে তাকান দেবায়ণীর দিকে, জীবনে প্রথমবারের মতো এমন কথা শুনে তারা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেন না! এমন কথা কোনো মানুষ বলতে পারেন, তাও আবার কোনো নারী!

বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে দেবতা লেখ বলেন, ‘শাস্ত্র কোনো পুরুষের রচনা নয়, শাস্ত্র অপৌরুষেয়। ঈশ্বর অলৌকিক শক্তির দ্বারা ঋষিদের নিকট শাস্ত্রীয় বচন প্রেরণ করেছেন, ঋষিগণ কেবল সেই বচন নিজের মধ্যে ধারণ করে উত্তর প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং এখনো দিচ্ছেন, এভাবেই বংশ পরম্পরায় রক্ষিত হচ্ছে ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্ত্র।’

‘এরকম অনেকেই নিজের সৃষ্টিকে ঈশ্বর প্রদত্ত বলে থাকেন। আমার পরিচিত একজন ভাল গীত রচনা করেন, গাইতেও পারেন চমৎকার, তিনিও বলে থাকেন যে তার গীত ঈশ্বরের দান, তিনি নিমিত্তমাত্র! আমি কিছু শ্লোক এবং গীত রচনা করেছি, আমি জানি যে কোনো ঐশ্বরিক শক্তি আমাকে এই ক্ষমতা প্রদান করেনি, এর জন্য আমাকে দিনের পর দিন গভীর চিন্তা ও অনুশীলন করতে হয়েছে, কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ করতে হয়েছে। দর্শন যাই হোক না কেন, আমাদের পূর্বজ ঋষিদেরকেও গভীর চিন্তা ও অনুশীলনের মাধ্যমেই শাস্ত্র রচনা করতে হয়েছে।’

‘আপনি শাস্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে পাপ করছেন তপস্বিনী।’ বায়ুর কণ্ঠে কিঞ্চিৎ বিরক্তি ঝরে পড়ে।

দেবায়ণী শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলেন, ‘পাপ যদি কিছু করে থাকেন তবে সেইসব পুরুষ ঋষিগণ করেছন, যারা নারীর প্রতি বৈষম্যমুলক শ্লোক রচনা করেছেন এবং মিথ্যা প্রচার করেছেন যে এই সকল শাস্ত্রের বচন ঈশ্বর কর্তৃক অলৌকিক শক্তির দ্বারা তাদের কাছে প্রেরিত হয়েছে।’

‘আপনি নারীর প্রতি বৈষম্যমুলক কোন শ্লোকের কথা বলছেন?’ কল্পক বলেন।

‘বেশকিছু বৈষম্যমূলক শ্লোক আছে, তবে আমি বৃন্দার প্রসঙ্গেই বলছি- শাস্ত্রে আছে- “অধিক লোমবিশিষ্ট কন্যাকে বিবাহ করবে না।” কিংবা “যে কন্যার ভ্রাতা নেই বা পিতা অজ্ঞাত, বিজ্ঞব্যক্তি ধর্মশঙ্কায় তাকে বিবাহ করবে না।” আপনারাই বলুন ঋভু, বৃন্দার শরীরে অধিক লোম গজিয়েছে, কিশোরদের ন্যায় তার গোঁফ, এতে তার দোষ কোথায়? ঈশ্বর তাকে এমনিভাবেই তৈরি করেছেন, এতে তার কোনো হাত নেই। তাহলে শাস্ত্র কি বৃন্দার প্রতি বৈষম্য করেনি? তারও তো বিবাহের অধিকার আছে; কারো স্ত্রী হবার কিংবা সন্তানের মাতা হবার অধিকার আছে। শাস্ত্র তার এই অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। অথচ শাস্ত্রের কারণেই সমাজের কোনো পুরুষ তাকে বিবাহ করতে রাজি হয়নি। আর বৃন্দার পিতা অজ্ঞাত, সে একজন বিধবা মাতার সন্তান, তার পিতার ঔরসে তার মাতার গর্ভে কোনো সন্তান ছিল না, পিতার মৃত্যুর দু-বছর পর তার জন্ম হয়। আমি মনে করি- একজন সন্তানের জন্য তার মাতার পরিচয়ই মূখ্য হওয়া উচিত, পিতার পরিচয় নয়। একজন অকাল বিধবার কি সন্তানের আকাঙ্ক্ষা থাকতে নেই? তাহলে বৃদ্ধ বয়সে তার সেবা-শুশ্রূষা করবে কে?’

বায়ু বলেন, ‘এমনটা হলে সমাজে ব্যভিচার বেড়ে যাবে, সমাজ উচ্ছন্নে যাবে। এমনিতেই বেশ কিছুকাল যাবৎ ব্রহ্মাবর্তে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে; সে-কারণেই ব্রহ্মা, দেবপতি ইন্দ্র এবং বিষ্ণু বীরপুরুষ বেণকে নৃপতি মনোনীত করেছেন; যাতে তিনি সমাজের মানুষকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে পারেন। এমনিতেই ব্রহ্মাবর্তের মানুষ একটু বেশি ব্যভিচার ও অপরাধ প্রবণ!’

দেবায়ণী মৃদু হাসেন, ‘হা হা হা……!’

বায়ু বিরক্ত স্বরে বলেন, ‘আপনি হাসছেন তপস্বিনী!’
‘হাসির কথা বললে হাসবো না তো কী করব বলুন!’
‘আমি তো হাসির কথা বলিনি, যা সত্য তাই বলেছি।’

দেবায়ণী বলেন, ‘ব্যভিচার কি এখন নেই বলছেন? শাস্ত্রে নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও অনেক আর্যপুরুষ একাধিক বিবাহ করেন, এমনকি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কেও লিপ্ত হন। পুরুষের বহুগামিতায় ব্যভিচার হয় না, আর একজন বিধবা সন্তান কামনায় একজন পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ করে সন্তান উৎপাদন করলেই ব্যভিচার হয়! আর শুধু কী ব্রহ্মাবর্তের মানুষই ব্যভিচার আর অপরাধ প্রবণ? স্বর্গের দেবতারা নন? দেবগণ ষড়যন্ত্র করে হিরণ্যকশিপু আর তার ভাই হিরণ্যক্ষ্যকে হত্যা করেছে, এ অপরাধ নয়? বিষ্ণু সমুদ্র মন্থনের সময় দানবদের সঙ্গে ছলনা করেছেন, এ অপরাধ নয়? দেবতারা ষড়যন্ত্র করে দৈত্য এবং দানবদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছেন, এ অপরাধ নয়? আর ব্যভিচারের কথা বলছেন? কী স্বর্গ, কী ব্রহ্মাবর্ত, আর কী পাতাল, কোথায় নারী নিরাপদ? শুধু ব্রহ্মাবর্তের ঘাড়ে দোষ চাপালেই তো দেবগণের ব্যভিচারের কথা বাতাসে মিলিয়ে যায় না। এর আগে যিনি ব্রহ্মা ছিলেন, তিনি কাম তাড়িত হয়ে বাককে ধর্ষণ করেছিলেন, পালিয়েও ব্রহ্মার হাত থেকে রক্ষা পাননি বাক। পরে বাক সরস্বতীর পদ লাভ করেছিলেন। আর ইন্দ্র? ইন্দ্র বদলায়, কিন্তু চরিত্র বদলায় না! যিনি-ই ইন্দ্রের সিংহাসনে বসেন তিনিই হয়ে ওঠেন ব্যভিচারী, এ কথা দিবালোকের মতো সত্য! এরপরও কী বলবেন যে, কেবল ব্রহ্মাবর্তের মানুষই ব্যভিচার এবং অপরাধপ্রবণ?’

বায়ু কোনো উত্তর খুঁজে পান না, কেননা তিনি নিজেও জানেন যে দেবায়ণী যা বলেছেন মিথ্যে নয়, তিনি বিব্রত দৃষ্টি রাখেন অন্ধকারে। অপ্সরা কমলা বলেন, ‘তপস্বিনীর কথা যৌক্তিক। কি স্বর্গ আর কী ব্রহ্মাবর্ত, সকল পুরুষেরই কামবাতিক অত্যাধিক!’

বায়ু অগ্নিচোখে তাকান কমলার দিকে, কমলা সে-দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলেন, ‘তপস্বিনী, সত্যিই আপনি প্রজ্ঞাবতী, আপনার যুক্তি খণ্ডন করার সাধ্য কারো আছে বলে আমি মনে করি না। আপনার দর্শন পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।’

লেখ বলেন, ‘তপস্বিনী, পরমপুরুষ ঈশ্বর সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?’

দেবায়ণী মৃদু হাসেন, ‘স্বর্গ আর ব্রহ্মাবর্তের শাসক পুরুষ, তাই আপনারা ধরেই নিয়েছেন যে ইশ্বরও পুরুষই হবেন! দেখুন, এই ধরণীর বুকে উৎপন্ন বৃক্ষাদির ফল খেয়ে, শস্যাদি খেয়ে আমরা জীবন ধারণ করি। ধরণী আমাদেরকে সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করে, এজন্যই ধরণীকে আমরা মাতা বসুন্ধরা বলে সম্বোধন করি। অর্থাৎ ধরণীকে আমরা নারীরূপে কল্পনা করি, তেমনি ঈশ্বরও তো একজন নারী হতে পারেন!’

কল্পক যেন আঁৎকে ওঠেন, ‘নারায়ণ, নারায়ণ, এমন কথা মুখে আনা দূরের কথা, ভাবাও পাপ! বিষ্ণুই পরমপুরুষ ঈশ্বরের অবতার।’

‘কোন বিষ্ণু ঈশ্বরের অবতার? এখন যিনি বিষ্ণু পদে অধিষ্টিত আছেন তিনি, নাকি সর্বপ্রথম যজ্ঞ নামে যে ব্যক্তি বিষ্ণু পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি? নাকি বামন নামক যে বিষ্ণু ছলনা করে দানব বলির কাছ থেকে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি? নাকি তার আগে যে বিষ্ণু এক ভোররাতে শরীরে খিঁচুনী তুলে রক্তবমি করতে করতে মারা যান তিনি?’

কল্পক গায়ের চাদরটা টেনে বলেন, ‘যিনিই বিষ্ণু পদ লাভ করেন, তিনি-ই ঈশ্বরের অবতার।’

‘পুরুষের ঔরসে নারীযোনিতে জন্ম নিয়েছেন প্রত্যেক বিষ্ণু, অন্যদের মতো তাদেরও লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, আনন্দ-দুঃখ ছিল বা আছে; বিষ্ণু আমাদেরই মতো রক্তমাংসে গড়া জীব, কখনোই ঈশ্বরের অবতার নন।’

‘সকল দেবতাই স্বীকার করেন যে তিনি ঈশ্বরের অবতার।’
‘দেবতাদের স্বীকারে কিছু আসে যায় না; দৈত্য-দানবরা বিষ্ণুকে ঈশ্বর মানেন না, এই ধরণীতে আরো অনেক জাতি-গোষ্ঠী আছে যারা হয়ত বিষ্ণুর নামই জানে না!’
বৃন্দা আবার এসে বলে, ‘দিদি, আহার প্রস্তুত।’

পরিবেশটা গুরুগম্ভীর হয়ে ওঠে, তা হালকা করার জন্য দেবায়ণী সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যুক্তি-তর্কের সময় অনেক পাওয়া যাবে। আসুন আগে গরম গরম আহার করে নেওয়া যাক।’

কল্পক বৃন্দার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কী আহার প্রস্তুত করলে বৃন্দা?’
‘আজ্ঞে রুটি, বাছুরের মাংস, সবজী আর ছানা।’
‘বাহ, অতি উত্তম খাদ্য! তবে আর দেরি করা উচিত হবে না।’

দেবগণ এবং অপ্সরারা সারিবদ্ধভাবে অলিন্দে উপবেশন করলে আহার পরিবেশন করতে থাকেন দেবায়ণী এবং বৃন্দা।

দেবায়ণী ছিলেন ব্রহ্মাবর্তের চন্দ্র বংশের এক ক্ষত্রিয় কন্যা, শৈশব থেকেই তিনি এক ব্রাহ্মণের কাছে শাস্ত্র শিখেছেন। তার বিবাহ হয়েছিল, স্বামী ছিল, এক পুত্রসন্তানও ছিল। স্বামী ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। দশ বছর পূর্বে রাক্ষসদের সঙ্গে মানবদের এক যুদ্ধে রাক্ষসরা হেরে গেলেও মানবদের যথেষ্ঠ প্রাণক্ষয় হয়। মানবদের অনেক স্ত্রীকে অকাল বৈধব্য বরণ করতে হয়। সেই যুদ্ধে স্বামীকে হারিয়ে দেবায়ণীও বৈধব্যবরণ করেন, তখন তার বয়স মাত্র আঠার, এক শিশুপুত্রের জননী। স্বামী মারা যাবার পরের গ্রীষ্মেই শিশুপুত্রটি মারা যায় বমি আর পাতলা পায়খানা করতে করতে। দেবায়ণী তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, এই অবস্থায় এক সন্ধ্যায় তিনি তিনজন ব্রাহ্মণ যুবক কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন। মনুর কাছে অভিযোগ করেও কোনো ফল হয়নি, কেননা শাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের বিচার করার বিধান নেই। মনের দুঃখে একদিন ভোরবেলায় সকলের অগোচরে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন দেবায়ণী, পাহাড়-অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ঋষি অর্চকের এই আশ্রমে এসে জল প্রার্থণা করেন। অর্চক ছিলেন বৃদ্ধ ঋষি, একাই থাকতেন। অর্চক দেবায়ণীর তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল আর ক্ষুধা নিবারণের জন্য ফল দেন। তারপর কুশলাদি জিজ্ঞেস করলে দেবায়ণী তার গৃহত্যাগের কথা জানান। অর্চক তার কন্যা হিসেবে আশ্রমে থাকবার কথা বললে দেবায়ণী রাজি হয়ে যান। দেবায়ণী অর্চককে পিতাশ্রী বলে ডাকতেন, আশ্রমের কাজকর্ম করতেন, অর্চকের সেবা-শুশ্রুষা করতেন আর শাস্ত্রীয় শিক্ষা গ্রহণ করতেন। পরে অর্চক আরো দুটি কন্যাকে আশ্রয় দেন আশ্রমে। লোকালয়ে গিয়ে ভিক্ষা এবং অরণ্যের ফল সংগ্রহ করে নিজের এবং তিন কন্যার জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। যখন বয়সের ভারে আর চলতে-ফিরতে পারতেন না, তখন আশ্রমের দায়িত্বভার অর্পণ করেন দেবায়ণীর হাতে। তার মৃত্যুর পর দেবায়ণী আরো চারটি কন্যাকে আশ্রয় দেন। তপশ্চর্যা, আশ্রম পরিচর্যা, আশ্রমের পাশে কিছু ফল ও ফসল উৎপাদন আর মাঝে মাঝে অতিথি সেবা করে সপ্তকন্যার দিন অতিবাহিত হয় এখন।




(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৪:১৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×