somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- তেইশ)

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ষোল

সন্ধ্যার পর মশালের আলোয় বিচারসভা বসে নৃপতি বেণের সভাগৃহে; নৃপতি বেণ, প্রধান পুরোহিত উদয়গিরি এবং অন্যান্য কয়েকজন ব্রাহ্মণ উপবেশন করেন সভাগৃহে; আর সভাগৃহের বাইরে আঙিনায় চামড়ার আসনে উপবেশন করে ক্ষত্রিয় প্রৌঢ় প্রমোদ এবং তার কন্যা অলোপা, তাদের পাশেই কুড়ি বৎসরের ক্ষত্রিয় যুবক ধনুশ, একটু দূরে আঠারো বৎসরের ব্রাহ্মণ যুবক কেশব, তাদের পিছনে কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ ও মধ্যবয়সী ক্ষত্রিয়। আর পাথরের দেয়ালের ওপাশে বেশ কিছু উৎসাহী নারী-পুরুষ ভিড় করে বিচারকার্য দেখার জন্য।
অসুস্থবোধ করায় বিচারসভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি মনু। তাই মনুর অনুপস্থিতিতে বিচারকার্য শুরু করার জন্য প্রধান পুরোহিত উদয়গিরির উদ্দেশে বেণ বলেন, ‘পুরোহিত মশাই, বিচারকার্য শুরু করা যায়, কি বলেন?’

উদয়গিরি নিমেষের জন্য দৃষ্টি বুলান অলোপা, কেশব এবং ধনুশের মুখে। তারপর বলেন, ‘নিশ্চয়, বিচার শুরু করুন নৃপতি।’
বেণ অলোপার মুখে দৃষ্টি রেখে বলেন, ‘অলোপা, তোমার সঙ্গে কী ঘটেছে, তা আমাদের বলো।’
অলোপা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, বেণ বলেন, ‘কেঁদো না অলোপা, তুমি নির্ভয়ে বলো।’
অলোপা পনের-ষোল বছরের কিশোরী, চোখ মুছে মুখ তুলে বেণের দিকে তাকায় সে, বেণ আবার বলেন, ‘বলো অলোপা।’

অলোপা মুখ খোলে, ‘আমি ফল কুড়িয়ে অরণ্য থেকে ফিরছিলাম। ঝরনার কাছে এসে ফলের ঝুড়ি নামিয়ে রেখে হাত-মুখ ধুয়ে জল পান করছিলাম। তখন কেশব ভ্রাতা হঠাৎ কোথা থেকে এসে আমার পিছনে দাঁড়ায়, তারপর আমাকে….আমাকে খারাপ প্রস্তাব দেয়। আমি সম্মত না হলে জোর করে আমার হাত ধরে টেনে ঝোপ-ঝাড়ের দিকে নিয়ে যেতে থাকে।’

‘মিথ্যে কথা, আমি ওর হাত ধরিনি।’ প্রতিবাদ করে কেশব।
বেণ বলেন, ‘তোমার কথা পরে শুনবো কেশব, আগে ওকে বলতে দাও।’
‘না, ও মিথ্যে বলছে।’

বেণ কঠোর স্বরে বলেন, ‘তুমি কথা বলার সুযোগ পাবে কেশব, আমরা আগে অলোপার কথা শুনতে চাই। বলো অলোপা।’

অলোপা আবার বলতে শুরু করে, ‘আমি আমার হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি। তখন কেশব ভ্রাতা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার মুখে চুমু খেয়েছে, তারপর আমাকে ভূমিতে ফেলে….।’ এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে অলোপা।
কয়েক নিমেষ সকলেই নীরব থাকে। তারপর বেণ ধনুশের উদ্দেশে বলেন, ‘তুমি ওখানে কী করছিলে ধনুশ?’

ধনুশ কান্নারত অলোপার দিকে তাকিয়েছিল, এবার বেণের দিকে তাকিয়ে ভয়ডরহীন কণ্ঠে বলে, ‘আমি ঝরনায় জল আনতে গিয়েছিলাম।’
‘তুমি কী দেখেছ বলো।’
‘আমি ঝরনার কাছাকাছি যেতেই কান্নার শব্দ শুনতে পাই, তাড়াতারি ঝরনার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পাই- কেশব অলোপাকে ভূমিতে ফেলে ওর শরীর থেকে নিবি খোলার চেষ্টা করছে।’

উদয়গিরি বলেন, ‘ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা সাক্ষী দিলে তোমার নরকবাস অবধারিত ধনুশ।’

ধনুশ উদয়গিরির চোখে চোখ রাখে, ‘ক্ষমা করবেন পুরোহিত মশাই, আমি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছি না, নিজের চোখে যা দেখেছি তাই বলছি।’

উদয়গিরি শাসনের চোখে তাকান ধনুশের দিকে, ‘কেশব হয়ত অলোপার হাত ধরে ভুল করেছে। কিন্তু তুমি কেশবকে এলোপাথারি প্রহার করেছ, ওর বুকে-পিঠে লাথি মেরেছ, নাকে-মুখে ঘুষি মেরে ওকে রক্তাক্ত করেছ, তাই তো?’

‘হ্যাঁ, আমি কেশবকে প্রহার করেছি। কিন্তু ও তো শুধু অলোপার হাত ধরেনি, ভূমিতে ফেলে….।’
‘ফের মিথ্যা বলছ পাপাত্মা! ব্রাহ্মণ সন্তানের অঙ্গে আঘাত করে তুমি মহাপাপ করেছ!’

উদয়গিরির গম্ভীর রাগান্বিত কণ্ঠস্বর শুনে আগত ক্ষত্রিয়রা ভয় পেয়ে যায়। বেণও বিস্ময়ে তাকান উদয়গিরির দিকে।

উদয়গিরি আবার বলেন, ‘কেশবকে প্রহারের ফলে তোমার পরকাল বিনষ্ট হলো আজ, পরকালে এই পাপ কার্যের দণ্ড তোমাকে পেতেই হবে। আর ইহকালে আজ এই বিচার সভাতেও তোমাকে দণ্ড ভোগ করতে হবে।’

দেয়ালের ওপাশ থেকে এক নারী কণ্ঠের কান্নার শব্দ ভেসে আসে। উদয়গিরি সে-দিকে তাকিয়ে ধমকে ওঠেন, ‘কে কাঁদে?’
কেউ একজন বলে, ‘ধনুশের মাতা।’
‘দূরে সরিয়ে নাও ওই হতভাগিনীকে যে জন্ম দিয়েছে এমন কুলাঙ্গার সন্তানের।’

বেণের দিকে তাকান তিনি, ‘নৃপতি, ব্রাহ্মণ সন্তানের অঙ্গে হাত তোলার দণ্ড ধনুশকে পেতেই হবে। নইলে দেবরাজ ইন্দ্র আপনার এবং আপনার গোত্রের ওপর ক্ষুন্ন হবেন।’

বেণ বলেন, ‘আমার ভুল হলে ক্ষমা করবেন পুরোহিত মশাই, ধনুশ তো অলোপার সম্মান রক্ষা করেছে।’

‘কোনো অবস্থাতেই একজন ক্ষত্রিয়ের সন্তান ব্রাহ্মণ সন্তানের অঙ্গে আঘাত করতে পারে না। শাস্ত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে- ব্রাহ্মণের গায়ে হাত তোলা মহাপাপ।’

অন্য দু-জন ব্রাহ্মণ প্রায় একসঙ্গে বলেন, ‘মহাপাপ, মহাপাপ।’
আরেকজন ব্রাহ্মণ বলেন, ‘ইহকাল-পরকাল দুই-ই নষ্ট।’
বেণ বলেন, ‘এখন আমরা কী করতে পারি? দুজনকেই দণ্ড দিতে হবে?’

উদয়গিরি বলেন, ‘শাস্ত্রে ব্রাহ্মণের বিচার নিষিদ্ধ। কোনো ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের বিচার করতে পারে না। তাছাড়া কেশব ছেলে মানুষ, মতিভ্রমে একটা ভুল সে করতে যাচ্ছিল, কিন্তু অলোপার সম্ভ্রমহানি তো করেনি। এ তেমন বৃহৎ কোনো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না, আর ক্ষুদ্র অপরাধ যদি হয়েও থাকে তাহলে সে পরকালে দণ্ড পাবে। ইহকালে তার দণ্ডের কোনো প্রয়োজন নেই। ব্রাহ্মণের বিচার পরকালে স্বয়ং ঈশ্বর করবেন, ইহকালে কোনো ক্ষত্রিয় নয়।’

কয়েক নিমেষের জন্য থেমে বেণ এবং অন্যদের মুখের দিকে তাকান উদয়গিরি, তারপর আবার বলেন, ‘তবে কেশব প্রতিজ্ঞা করবে যে আর কোনোদিন সে কোনো নারীকে অসম্মান করবে না। এটাই তার দণ্ড।’

একজন ব্রাহ্মণ বলেন, ‘প্রতিজ্ঞা করো কেশব, আর কখনো কোনো নারীকে অসম্মান করবে না।’
সঙ্গে সঙ্গে কেশব বলে, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি- কোনোদিন কোনো নারীকে অসম্মান করব না।’
উদয়গিরি বলেন, ‘পাপাত্মা ধনুশকে দণ্ড পেতে হবে। শাস্ত্রে ব্রাহ্মণের শরীরে আঘাত করলে বেত্রাঘাতের কথা বলা আছে।’

বেণ বিব্রত বোধ করেন, নৃপতি হবার এই প্রথম তিনি এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তিনি বুঝতে পারছেন যে কেশব যা করেছে তা অন্যায় কাজ, আর ধনুশ অলোপাকে বাঁচাতে কেশবকে প্রহার করে কোনো অন্যায় করেনি। ধনুশ যা করেছে তা প্রশংসনীয়, কিন্তু তিনি কী করে ধনুশকে বাঁচিয়ে কেশবকে দণ্ড দেবেন? তিনি যে শাস্ত্রের বন্ধনে তিনি বন্দী এক অসহায় নৃপতি! ভেতরে ভেতরে তার কষ্ট হয় ধনুশের জন্য, একটা কন্যার সম্ভ্রম রক্ষার মতো বীরোচিত কাজ করেও এখন সে দণ্ডের মুখে!

অন্য ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলোচনা শেষে উদয়গিরি ধনুশের দণ্ড হিসেবে বিশটি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করে দেন, বাধ্য হয়ে বেণকেও এই দণ্ডাদেশ সমর্থন করতে হয় এবং দণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দিতে হয়। যে-কোনো অপরাধের দণ্ড কার্যকর ক্ষত্রিয়রাই করে, ব্রহ্মাবর্তের অপরাধীদের দণ্ড কার্যকরের জন্য কয়েকজন মধ্যবয়সীকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, তারাই সর্বদা দণ্ড কার্যকর করেন। বেণের নির্দেশে দণ্ড কার্যকরকারীরা দু-হাত ধরে ধনুশকে ভূমি থেকে টেনে তোলে, তারপর তার দু-হাত পিছনে নিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধে। ধনুশ ভয় পায় না, কোনো প্রতিবাদও করে না, কেবল নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে আর তার চোখ থেকে গড়িয়ে নামে অশ্রু।

দণ্ড কার্যকরকারীরা ধনুশকে নিয়ে যাত্রা করে দণ্ডপর্বতের উদ্দেশ্যে, কয়েকজন মশাল হাতে আগে আগে হাঁটে, দণ্ড দেখতে উৎসুক মানুষ ছোটে পিছন পিছন। পাশের একটি টিলার নাম-দণ্ডপর্বত। সব ধরনের অপরাধীদের বিচারের দণ্ড সেখানে কার্যকর করা হয়। ধনুশকে নিয়ে যাবার সময় ওর মাতা বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন। ধনুশের মাতার আর্তচিৎকার যেন তীরের মতো বিদ্ধ হয় বেণের হৃদয়ে, তাঁর অন্তর কেঁদে ওঠে!



(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:১২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×