রাত জেগে জোনাকিদের কুচকাওয়াজ দেখতে দেখতে কখনো কখনো সিমির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। ভোর হলে হয়তো জোনাকিরা মিশে যাবে ব্যস্ততার জনসমুদ্রে,চন্দ্রাহত জলের গোপন ভাঁজে ভাঁজে ঢেউয়ের সাথে মিশে হারিয়ে যাবে কোনো নীল জলরাশিতে কিংবা সেখানটায় ঠিক যেখানটায় ঘুমন্ত ঠোঁটের কাছাকাছি স্বপ্ন ঝুলে থাকে আমাদের জাগিয়ে দিতে,তাই না ? সিমির প্রশ্নটা গুঞ্জন তুলে থেমে যায় রায়হানের চোখের অতলে।
রায়হান জানতে চায় - তারপর ?
তারপর রাতের শৃঙ্খল ভেঙে একে একে বেরিয়ে পড়ে চাঁদ,জ্যোৎস্নার মেঘমালা আর অন্ধ পিপীলিকারা। ছুঁয়ে দিতে চায় ভোরের শুকতারাকে।
জ্যোৎস্নায় মেঘমালারাও বুঝি থাকে,আমার শৃঙ্খলভাঙা নারী ! ভারী অদ্ভুত ব্যাপার তো!
এরপর রায়হানের বিমুগ্ধ আঙুলেরা পাতার পর পাতা লিখে চলে সিমির ব্যঞ্জনাময় পংক্তি নৈশভ্রমণের পথ অনুসরণ করে। ওর অধর সিমির চোখের পাতায় এঁকে দেয় স্বপ্নের উপত্যকা,এঁকে দেয় নীল পাখির অস্থির পায়চারী,লিরিকস সিম্ফনি,গড়ে দেয় সাম্রাজ্য। বলে -
প্রিয় নারী,এসো বৃষ্টিতে ভিজি। জেনে রেখো এ বৃষ্টি আমাদের যৌথ অশ্রু নয়। চলো দলিত এ ধারার সাথে করে নেই বোঝাপড়া। শৃঙ্খলিত অবিশ্বাসী নূপুরের ছন্দকে মুক্ত করে দাও আজ। ঘুমাও ব্রহ্মাণ্ডের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, আমার প্রিয়তমা নারী!
সিমির কাছে মনে হতে থাকে চুইয়ে পড়া রোদের মতো রায়হানের কণ্ঠ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। সিমির দু'চোখ বেয়ে ঘুম নামে, ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে কোনো মায়াঘ্রাণে। কিন্তু ও প্রাণপণে জেগে থাকতে চায়। কারণ ঘুমোলেই টুপ করে মানুষটা উড়ে যাবে। সেদিনও ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোবার পরও স্বপ্নে দেখেছে রায়হান ওর পাশে নেই। বাইরে রাতজাগা কুকুরদের তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠা ওকে ভীত করেছে যথেষ্ট। সারা বাড়ি খুঁজে না পেয়ে বাথরুমে উঁকি দেবার পর মনে হয়েছে হয়তো ভেন্টিলেটরের পেছনে ও ঝুলে আছে। ঠিক তাই, উঁকি দেয়া মাত্রই রায়হান ওকে বলেছে -
তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি। বলেই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলো। ব্যাপারটা ভীষণ গোলমেলে লাগলেও সকালে যখন ঘুম ভেঙেছে ওর একবারও মনে হয়নি ঘরের দরজা দিয়ে বের না হয়ে ভেন্টিলেটরে ও কেন ঝুলছিলো! নিশ্চয়ই ও ঠিক কোনো প্রয়োজনেই এমনটা করেছিলো,হুম বলে মাথা নাড়ে সিমি। এরপর ও সারাদিনই কান খাড়া করে রেখেছে রায়হান কখন ফেরে। এখন বাইরে যেতে হলে দরজায় তালা লাগিয়ে গেলেও আর সমস্যা হবে না। দরজা বন্ধ থাকলেও ভেন্টিলেটরের ফাঁক গলিয়ে ও ঠিক বাসায় ঢুকতে পারবে।
এরপর সিমি সারাদিন বুকের মধ্যিখানে একটি আশাফুলের কুঁড়ি নিয়ে ঘোরে। সময়ের সাথে সাথে ওর ছায়ার দৈর্ঘ্য বাড়ে। নিওরোন গোলকে উদ্বিগ্নতা,আবেগ সংশয়ের ঘনঘটা আর মিষ্টি অলৌকিক সুরের অনুরণন থেকে। কী চায় সিমি ?ও জানে না। শুধু বুঝতে পারে একটু আগেও দিনের আলো ছিলো কচি লেবুর গন্ধ ছড়িয়ে। গোধূলি এলো বলে! এসো তুমি,ঝরা পাতার শব্দ থেকে ফুল ফোঁটার শব্দ পর্যন্ত অফুরান সম্ভাবনা নিয়ে আমায় আলিঙ্গন করো - বলে সিমি ওর দু'হাত প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করে। শেষ বিকেলের রোদ একটু একটু করে হারিয়ে যায় কুয়াশার ফনায়। ওপারেই সমুদ্র। সমুদ্র মানেই সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নেমে যাওয়া,অতলে অবগাহন তোমার সাথে,রায়হান!
আর তখনই ব্যাপারটা ঘটে। একটা চাপা নিঃশ্বাস টের পায় সিমি ওর আশেপাশে। চোখ বন্ধ থাকায় ওর ইন্দ্রিয়ের তীব্রতা যেন কোনো গভীর গহ্বর ঠেলে উঠে আসে। ঘর জুড়ে অদ্ভুত ইউক্যালিপ্টাস হাওয়ার ছড়াছড়ি। ফিসফিসিয়ে রায়হান বলে -
আলো জ্বেলো না। পরস্পরের বাহুতে মাথা রেখে আজ চলো নক্ষত্ররাজির নকশীকাঁথা বুনি। কান পাতো,সমুদ্রের স্বর শুনতে পাবে। ঘুমিয়ে পড়ো না।
সিমি কিছু বলতে উদ্যত হলেও রায়হান ওর ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বলে - উহু,কথা বলে এখন মুহূর্তটুকু নষ্ট করো না। রাত্রির অস্তিত্ব অনুভব করো।
রায়হানের কথা শুনতে শুনতে সিমির কেমন তন্দ্রাভাব হয়। এলোমেলো পায়ে আলোআঁধারি কামরার একমাত্র বিশাল জানলার গ্লাসটি খুলে দিয়ে রায়হান বলে -
যে একরত্তি নিঃসঙ্গ হাহাকার কিছুক্ষণ আগেও লুটোপুটি খাচ্ছিলো ল্যাম্পপোস্টের তলায়, ও এখন বাড়ি চলে যাচ্ছে। ওকে আর ডেকো না,কেমন ?
রায়হান,বাঁশির আওয়াজ পাচ্ছো ?
হুম,কান পেতে শোনো ঘুমন্ত নগরীর গান!
আমাকে রেখে চলে যাবে নাতো ? সিমি ওর বাহু শক্ত করে ধরে রাখে কাঁধে মাথা হেলিয়ে
পাখি হবে সিমি ?
টুপটাপ করে পড়া শিশিরফোঁটার মতো শব্দ করে রায়হান কথা বলে যায়। সিমি বোঝে না ও কি বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরেই রায়হান কিছু বলে যাচ্ছে। শিশিরফোঁটাগুলো ঘরের এপ্রান্ত- ওপ্রান্ত জুড়ে খেলা করছে,দেয়াল জুড়ে রেখে যাচ্ছে তাদের জলজ পদছাপ। হিমেল আবরণে ডুব দিচ্ছে সিমিকে নিয়ে।
সিমি,তোমাকে নক্ষত্রটিপ এনে দেবো। চোখ খোলো। সিমি, সিমি... করে কেউ যেন ওকে ডেকেই যাচ্ছে।
সিমি চোখ খুললে দেখতে পায় রাত্রি জ্বলে-পুড়ে চোখের সামনে উজ্জ্বল আকাশ। একি ছাদ কি করে হাওয়ায় মিলালো! পুরো আকাশটা একসময় সিমির দু'চোখ গ্রাস করে নিলো স্মৃতিরোদ হয়ে। এর মাঝে জ্বলজ্বলে এক বিন্দু। সূর্য! রায়হানের নক্ষত্রটিপ! সূর্যও তাহলে নক্ষত্র হয়ে যায় বুঝি ? আজও ও চলে গেলো দেয়াল ফুঁড়ে,পাখি হয়ে! সিমিও হাত বাড়ায় পাখির বনজ্যোৎস্না হতে। আহ্! আমাকেও আজ উড়িয়ে দিলে জীবনের না-ছোঁয়া উচ্ছ্বাসে !
সমাপ্ত