যদি কেউ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মৃত্যু ঘটাতে পরিকল্পনা করে কিংবা আমাদের কূটনীতিক ও সামরিক ব্যক্তিরা মধ্যপ্রাচ্যে এবং মুসলিম বিশ্বজুড়ে যা কিছু অর্জনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন তা একেবারে ধ্বংস করে দিতে চায়, ইনোসেন্স অব মুসলিমস চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করাই এ জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
এটিকে কেন্দ্র করে যতই সহিংস প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে, ততই এর ফলাফল বাড়ছে। যেমনÑ যুক্তরাষ্ট্র-আফগানিস্তান যৌথ সামরিক অপারেশন এবং মিসরকে মার্কিন সাহায্য দেয়ার বিষয়ে আলোচনা স্থগিত করা, ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদার দ্রুত অবনতি এবং ‘আরব বসন্তে’ মার্কিন সমর্থন মৌলবাদী যে ইসলামি আন্দোলন প্রতিহত করবে আশা করা হয়েছিল, তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব, ইত্যাদি। ওবামা প্রশাসন ইসলামি উত্থানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং ‘মধ্যপন্থী’দের মদদ দেয়ার যে চেষ্টা চালিয়ে আসছে, তা এখন একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।
ইনোসেন্স অব মুসলিমস নির্মাতাদের মতলব কী, তা ব্যাখ্যা করা খুবই দরকার। মিডিয়ায় এ নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেখা গেছে। মুসলিমবিরোধী স্টিভ কেইন বলেছেন, বিশেষ করে মুসলমানদের এর ভিডিও দেখানো ছিল উদ্দেশ্য। কেইন আশা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম মৌলবাদীদের এই সিনেমা দিয়ে এমনভাবে তাড়িয়ে দেয়া যাবে, যেমন করে ধোঁয়া দিয়ে তাড়ানো হয় পোকামাকড়। ওরা নাকি মার্কিন বাহিনীর কমান্ডে হামলা চালাতে গোপন ‘সেল’ বানিয়েছে। অন্য দিকে কেউ কেউ বলেছেন, ছবিটির প্রযোজক ও প্রচারকদের প্রত্যাশা, এবার মুসলমানদের মানসিকতায় ‘রূপান্তর’ ঘটবে। তবে এসব অভিমতের কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়।
ছায়াছবিটির উল্লিখিত ভিডিও এতটাই অরুচিকর এবং এত বেশি ইচ্ছাকৃত অবমাননাকর যে, এর মাধ্যমে কারো চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনার কথা বিশ্বাসই করা যায় না। আর যদি গোপন সেল থাকে ইসলামপন্থীদের, ইউটিউব ভিডিও দিয়ে তাদের পোকামাকড়ের মতো ধোঁয়া-তাড়ানো সম্ভব নয়। এই চলচ্চিত্রের আসল মতলব বুঝতে হলে কারা এর পেছনে আছে, তা ভালোভাবে জানা চাই।
এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যমণি হিসেবে যার নাম এসেছে, সে হচ্ছে ৫৬ বছরের নাকুলা বাসেলে। লোকটা মিসরীয় অভিবাসী। তবে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) দেয়া সাক্ষাৎকারে নিজের নাম বলেছে ‘স্যাম ব্যাসিল’ এবং নিজেকে মনে করে ‘ইসরাইলি-আমেরিকান।’ পেশায় ক্যালিফোর্নিয়ার রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী। মিসরের সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান এবং কারাদণ্ড ভোগ করা অপরাধী। মিডিয়া রিপোর্টে জানা যায়, এ লোকই ইনোসেন্স অব মুসলিমস ছবি বানানোর হোতা। ওর নিজের বক্তব্য হলো, ছবি তৈরির সব জোগাড়যন্ত্র করাই ছিল তার কাজ। নাকুলাকে ‘সৃজনশীল পরিচালক’ বলা যায় না। সিনেমাটির আইডিয়া তৈরির পর্যায়ের লোক বলে তাকে মনে হয় না। ব্যাংক জালিয়াতির দায়ে সে জেল খেটে বেরিয়ে এসেছে ছবিটির কাজ শুরুর মাসখানেক আগে। তাকে অন্য কেউ এ কাজের জন্য রিক্রুট করার সম্ভাবনাই বেশি। আর যে এ কাজ করেছে, সে লোক নাটের গুরু এবং ছবিটি তৈরির চালিকাশক্তি। সে ব্যক্তিটি কে?
রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, ‘মিডিয়া ফর ক্রাইস্ট’ সংগঠন ছায়াছবি তৈরির অনুমতি নিয়েছিল। জোসেফ আবদেল মসিহ এর পরিচালক। ওরা আরবি ভাষায় খ্রিষ্ট ধর্মবিষয়ক প্রোগ্রাম স্পন্সর করে থাকে। এদের একটি প্রোগ্রামের নাম ‘দি ওয়ে’। এতে পামেলা গেলার ও রবার্ট স্পন্সরের মতো ইসলামবিদ্বেষীদের তুলে ধরা হয়। এই গেলার-স্পেয়ার জুটি নিউ ইয়র্কের ‘গ্রাউন্ড জিরো’তে মসজিদ প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদ জানিয়ে জাতীয় পর্যায়ে অর্জন করেছে কুখ্যাতি। আর জোসেফ আবদেল মসিহ তাদের সমাবেশে বক্তৃতা দিয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে গেলারের ব্লগে ইনোসেন্স-এর মতো ছবি বানানোর আইডিয়া উল্লেখ করা হয়েছিল। এটি পোস্ট করা হয়েছিল এ শিরোনামে : ‘মুহাম্মদ সম্পর্কে একটি চলচ্চিত্র : যে আইডিয়ার সময় হয়েছে।’ আলি সিনা নামে এক ব্যক্তি আগে মুসলমান ছিল। গেলার-স্পেয়ার জুটির ‘স্টপ দি ইসলামাইজেশন অব নেশন্স’ (বিভিন্ন জাতির ইসলামীকরণ থামাও) নামে সংগঠনের বোর্ড মেম্বারদের একজন আলি সিনা। সে গেলারের ব্লগ পাঠকদের উদ্বুদ্ধ করেছে তার ছবি বানানোর উদ্যোগে সমর্থন দেয়ার জন্য।
তার ভাষা ছিল : ‘এই ছায়াছবিতে দেখানো হয়েছে, মুহাম্মাদ হামলাবাজ, লুটেরা, গণহত্যাকারী, ধর্ষক, ঘাতক ও অন্যান্য অপরাধেও জড়িত। এর ভিডিও’র প্রতিটি দৃশ্যের নিচের দিকে ডান কোণে একটি ছোট সাবটাইটেল। এতে কাহিনীগুলোর সূত্রের উল্লেখ আছে। ছবিটি সম্পূর্ণ বাস্তবভিত্তিক। যেখানেই সম্ভব কুরআন, সিরাত ও হাদিস তুলে ধরেছি। এটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় কাহিনী। মুহাম্মদ সম্পর্কে যা সত্য, তা কল্পসাহিত্যের চেয়েও বেশি মর্মান্তিক। পৃথিবী এখনো ইসলামের আসল পরিচয় পায়নি। পৃথিবী যা জানে, তার বাস্তব ভিত্তি নেই। ইসলামকে নরম ও নমনীয় করে দেখানো হয়েছে। সত্য হলো মুহাম্মদ ছিলেন জিম জোন্স, শোকো আসাহারা ও চার্লস ম্যানসনের মতো ‘কাল্ট লিডার’। ওরা সফল হয়নি, মুহাম্মাদ হয়েছিলেন। কারণ, সপ্তম শতাব্দীর আরবে তাকে থামানোর মতো কোনো শক্তি ছিল না।’
সাবেক মুসলিম আলি সিনা আরো বলেছিল, সুসংবাদ হলোÑ আমি বিরাট অঙ্কের দৈবসাহায্যের অঙ্গীকার পেয়েছি। ছবিটি তৈরির দিবাস্বপ্ন দেখে আসছি ১০ বছর ধরে। ওই অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। পাঁচ মাস ধরে আর সব কাজ বাদ দিয়ে ছবিটি বানানোর জন্য পড়াশোনা করেছি, কাহিনী বাছাই করেছি এবং লিখেছি চিত্রনাট্য।
ইনোসেন্স অব মুসলিমস নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিতে আলী সিনা অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে আরো বলেছে, বীজ বপন করেছি। এখন এর পরিচর্যার সময়। আমার দরকার অভিজ্ঞ নির্বাহী প্রযোজকÑ যিনি আমার মূল্যবোধের অংশীদার হবেন। যিনি পেশাদারিত্বের সাথে এবং মিশনারির প্রেরণা নিয়ে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। আমি বড় বাজেটের ছবির কথা ভাবছি না। তবে বিষয়বস্তু যা, তাতে এটি সর্বাধিক দর্শকধন্য ছবিগুলোর একটি হবে। (ডেনমার্কের কার্টুনের কথা আপনাদের মনে আছে?)’
গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই ছবির উসকানিমূলক আইডিয়াটি যা ড্যানিশ কার্টুনের উল্লেখের মধ্যে রয়েছে। আর যখন ছবিটির নির্মাণকাজ চলছিল, তখন এই উসকানির মনোভাব পরিব্যাপ্ত হচ্ছিল সংশ্লিষ্ট সার্কেলগুলোতে। পূর্বোক্ত জোসেফ আবদেল মসিহ এখন বলছে, নাকুলা অভিনেতাদের সাথে তাকেও বোকা বানিয়েছে। তবে জোসেফ স্বীকার করেছে, ‘মিডিয়া ফর ক্রাইস্ট’ (যিশুখ্রিষ্টের জন্য গণমাধ্যম) সংগঠন এই ছবি নির্মাণে সহযোগিতা করেছে। প্রশ্ন জাগে, এমন একটি ছবি বানানো হবে বলে জোসেফ যদি ভাবতে না পারে, তা হলে নাকুলা কোন ধরনের ছবি বানাবে বলে সে আশা করেছিল? গেলার-স্পেয়ার জুটির (ইসলামবিদ্বেষী) তৎপরতায় জোসেফ অংশ নেয়ায় ‘মিডিয়া ইন ক্রাইস্ট’ সংগঠনের আয় বেড়ে যেন আকাশের দিকে ছুটেছে। ২০০৯ সালে এর পরিমাণ ছিল দুই লাখ ডলার। পরের বছর বেড়ে দাঁড়ায় ছয় লাখ ৩৩ হাজার ডলারের বেশি। আর ২০১১-তে ১০ লাখ ১৬ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এত অর্থ এলো কোত্থেকে? আলী সিনার দাবিমাফিক, ফেরেশতারা এটা পাঠিয়েছেন? এ দিকে নাকুলা বলেছে, শতাধিক ইহুদি দাতা তার ছবির খরচ জুগিয়েছে।
মিডিয়ার রিপোর্টাররা অনুসন্ধান করে দেখেছেন, নাকুলা অসত্য পরিচয় দিয়েছে নিজের। তদুপরি, সে শুধু ব্যাংক চেক নিয়ে প্রতারণাই করেনি, মাদক কারবারিও। দক্ষিণপন্থী খ্রিষ্টানদের কাছে সে শহীদের মর্যাদা পাচ্ছে। তবে প্রকৃত বীর হওয়ার সম্ভাবনা আর নেই। ম্যাট ওয়েলচ ধরনের কেউ কেউ মনে করেন, নাকুলা গং সালমান রুশদির পর্যায়ে পৌঁছবে। তবে মাদক পাচারের দায়ে শাস্তি হওয়া নাকুলার ‘প্লাস পয়েন্ট’ বৈকি।
ইঁদুর ও শিয়ালের সাথে তুলনীয় এসব ক্ষতিকর প্রাণী ও পরগাছা ইচ্ছা করেই এমন একটি সিনেমা বানাতে নেমেছিল, যা মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এমন ধরনের লোকজনকে ‘বাকস্বাধীনতার বীর’ মনে করা কাণ্ডজ্ঞানহীনতার নিচে। এটা হলো ভিলেনদের হিরো বানানো। আমরা এখনো জানি না, কোত্থেকে এলো এই ছবি তৈরির অর্থ ও অনুপ্রেরণা। তবে এতটুকু জানি : এই ছবি বানানোর পেছনে সক্রিয় ছিল আন্তর্জাতিকভাবে একটি ঘটনা ঘটিয়ে দেয়ার আকাক্সা। সে ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে হেয় এবং আমেরিকাবিদ্বেষী উগ্রপন্থীদের শক্তিশালী করবে। অথচ আবর্জনাতুল্য এই ছায়াছবির হোতারা নিজেদের ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে উপস্থাপন করছে।
এই ইস্যুর সাথে বাকস্বাধীনতার সম্পর্ক নেই। প্রচলিত শর্তের আলোকে ভিডিওটির মূল্যায়নের জন্য প্রেসিডেন্ট অনুরোধ করেছিলেন ইউটিউবকে। তারা এটা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পাশ্চাত্যের ত্বকের নিচে কুৎসিত ক্ষত ছড়িয়ে পড়ছে। এর লক্ষণের প্রথম বহিঃপ্রকাশ হলোÑ নরওয়েতে আন্দ্রে ব্রেইভিকের ভয়াবহ অপরাধ। সে লেবার পার্টির যুব শিবিরে অংশগ্রহণকারীদের হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। সে চেয়েছে, ‘বিভিন্ন জাতির ইসলামীকরণ’ থামাতে। তার অনলাইন ঘোষণাপত্রে, আগে উল্লিখিত গেলার ও স্পেয়ারের উদ্ধৃতি রয়েছে। এদের বক্তব্য ঘৃণাবিদ্বেষ ছড়াতে উসকানি দিয়েছে। গেলার ইংলিশ ডিফেন্স লিগের প্রশংসা করেছেন। এটি মাথান্যাড়া গুণ্ডা ও নব্যনাজিদের অবাঞ্ছিত সমাহার। এরা সহিংস অভিযানে নেমেছে ব্রিটিশ মুসলিমদের সন্ত্রস্ত করে রাখার জন্য। এই গ্রুপের কার্যকলাপে উৎসাহিত হয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশে এমন তৎপরতা বিস্তার লাভ করে ইহুদিবাদী আন্দোলনে শক্তি জোগাচ্ছে। গেলার ও তার সমর্থকেরা দাবি করে, তারা ‘ইসরাইলকে রক্ষা করছে’। আর ইংলিশ ডিফেন্স লিগ তাদের সমাবেশে বিদ্বেষ প্রচার করার সময়ে নিয়মিতভাবেই ইসরাইলি পতাকা ওড়ায়।
ইসলাম আতঙ্ক ছড়ায় যে নেটওয়ার্ক, এর একটি বড় ইস্যু হলো ইহুদি রাষ্ট্রটির প্রতিরক্ষা। সমালোচনা এড়াতে তারা এটা ব্যবহার করে। ওই নেটওয়ার্কের একজন বড় নেতা হলেন, সাবেক নব্যবামপন্থী ও ব্ল্যাক পান্থার গ্রুপের লোক ডেভিড হরোউইৎজ। তার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ইসলামি সব কিছুই জঘন্য অপরাধ।
লেখক : জাস্টিন রেইমন্ডো, মার্কিন গ্রন্থকার, কলামিস্ট ও সম্পাদক
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:৫৩