শশাংকের নৃপতিশাসন,বখতিয়ারের শাসন ,ঔপনিবেষিক শাসন এর নিরন্তরতায় যে ভারতীয় উপমহাদেশে আজ বহুরাষ্ট্রে বিভক্ত সে রাষ্ট্রর মানুষগুলো যেমন লড়াই করতে শিখেছে তেমনি নিজস্ব জাতিবোধের জটিল তত্ত্বকেও রপ্ত করেছে নিপুণভাবে ।এ রাষ্ট্রের মানুষগুলো রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পেরেছে কোনটি সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে আবার কোনটি ভুমিভিত্তিক জাতিয়তার ভিত্তিতে আবার কোনটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে ।এসব জাতীয়তা তাদের আবেগি করে তোলে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কিংবা জাতিসত্ত্বার প্রশ্নে।শত নিগ্রহ,শত বঞ্চনার বিপরীতে মানুষদের ভূলিয়ে রাখা যায় জাতীয়তাবাদী আবেগ দ্বারা।সাধারনভাবে ভারতীয়,বাঙালি ,পাকিস্থানি এসকল জাতির বিপরীতে অন্য জাতির ধারনাকে স্বীকার করার পেছনে তারা খুবই কৃপন।অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠের নিপীড়ন যে শুধু ধর্মের জায়গা নয় জাতিগত সম্প্রদায়ের জায়গা থেকেও হতে পারে তা তা আমরা হিসাবে রাখি না অথবা ইচ্ছা করে ভুলে যাই। জাতিগত নিপীড়নে ভারতের ভূমিকা কি তা আর নাই বললাম শুধুমাত্র বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে কতটা জাতিগত নিপীড়ন ঘটে তাই বলে শেষ করা যাবে না।
ভাষা, স্বকীয়তা,সমৃদ্ধি এবং অধিকারের প্রশ্নে কিভাবে সেটেলার –রাষ্ট্রযন্ত্র পাহাড়ে নিপীড়ন চালাচ্ছে তাকে আজকের বাঙালিরা এক তুরিতে উড়িয়ে দেন সার্বভৌমত্বের ,বাঙালিত্বের আবেগ দ্বারা।এই আবেগগুলোকে লালন করতে মধ্যবিত্ত শ্রেনী অপেক্ষায় থাকেন।ক্রিকেট উত্তেজনায় গালে পতাকা আকা ,স্বদেশী গানে ১৬ ডিসেম্বরের উদযাপন ,গ্রামীনফোন বাংলালিংকওয়ালাদের বাণিজ্যীক গন্ধযুক্ত জাতীয়তাবাদী বিজ্ঞাপন,রমনার পান্তা ইলিশ ভুলিয়ে রাখে পাহাড়ীদের উপর রাষ্ট্রযন্ত্রের দমনপীড়ন যে নিপীড়ন বস্তুভিটা উচ্ছেদ করতেও পিছপা হয় না এমনকি খুন,ধর্ষণ,ছিনতাই করতেও পিছপা হয় না ।
বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেনীতে পাহাড়ীদের নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি হলো-তারা যেহেতু অস্ত্র তুলে নিয়েছে তাই তাদের উপর এমন নজরদারি রাখা স্বাভাবিক,তাদের আদিবাসী স্বীকৃতির দাবিও বাড়াবাড়ি।এসব ধ্যানধারনাগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শাসকরা সিদ্ধহস্ত।
শাসকদের নিপীড়নকে পাশ কাটাতে শাসকরাই আমাদের উন্নয়ন,আবেগ,সংস্কৃতির গল্প শোনায় যেখানে আত্নপরিচয়কে ভূলিয়ে দেবার সকল আয়োজন, নির্যাতন চলে অবিরত। পাকিস্থানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি তাদের অত্যাচারের প্রেক্ষিতে অথচ সেই একই অত্যাচার অন্য জাতির উপর চাপাতে আমাদের একবারও বাধে না।
দেশের পার্বত্য অঞ্চলে যে মানুষগুলো অবিরত সেনাশাসন আর দমনপীড়নের মধ্যে রয়েছে তাদের অন্তর্নিহিত অবস্থা কি তা যেমন রাষ্ট্র আমাদের জানতে দেয় না আমরাও তেমনি অজানা থাকি সেইসাথে শাসকদের শেখানো কথাগুলোই যুক্তি হিসাবে ধার করি।
শুধুমাত্র একটি কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে গিয়েই ৫৪০০ একর আবাদি জমিসহ ৪০০০ বর্গমেইল এলাকা পানিতে তলিয়ে দেয়া হয়েছে।অথচ পাকিস্থান সরকার এ জন্য পাহাড়িদের যে ক্ষতিপূরনের আশ্বাস দিয়েছিলো তা অধিকাংশের ভাগ্যতে জুটে নি।হাজার হাজার জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করা হয়েছে এই তথাকথিত উন্নয়নের নামে।
জামালপুর ,ময়মনসিংহ,শেরপুর প্রভৃতি অঞ্চলে যে গারো অধিবাসী আছে তাদের অল্প কিছুমাত্র এখন সেখানে বসবাস করে।এই সীমান্তবর্তী মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করে বিতারিত করেছে পাকিস্থানি সরকার।সমতলের আদিবাসীদের ভূমি দখল,উচ্ছেদ করে বিতাড়িত করে জমি দখল সহজে চর্চিত কৌশল।সমগ্র আদিবাসী সত্ত্বাকে অস্বীকার করে দেশ স্বাধীন হবার পর বাঙালিদের সাথে মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ৭২ এর সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তা স্থাপনের মাধ্যমে যেটি ছিলো জাতিগত আত্নপরিচয়ের ক্ষেত্রে বড় আঘাত।পাহাড়ি জনগনের উপর যেমন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে তেমনি পরিকল্পিত সেটেলার এনে উচ্ছেদ অভিযানও চলেছে রীতিমতো।
সামরিক শাসক জিয়া এবং এরশাদের আমলেই ৪ লাখ বাঙালিকে সেখানে আবাদি পরিচয়ের আড়ালে বসতি গড়তে দেয়া হয়েছে।একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৭৯ সালে পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি জনগণ ছিলো ২.০৫% মাত্র………………!!!!
অথচ,১৯৮১ সালে এক বান্দরবান জেলাতে পাহাড়ি জনগণ ছিলো ৮৯,০০০ প্রায় ।বাঙালি জনগণ ছিলো প্রায় ৭৩ হাজার।১৯৯১ সালে এসে বাঙালির সংখ্য দাড়ায় ১ লাখ ২২ হাজার মতো।
খাগড়াছড়ি জেলাতে বাঙালি ছিলো ৯৩ হাজাড়েড় কাছাকাছি সেখানে ১৯৯১ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৫ হাজার।
রাঙামাটি জেলাতেও ১৯৮১ সালের ১ লাখ বাঙালি ১৯৯১ এ এসে ১ লাখ ৭২ হাজারে দাড়ায়।
পাহাড়ে, সমতলে সমান হারে চলে বাঙালিদের বাড়িঘর ,মসজিদ,মাদ্রাসা নির্মাণ।পাহাড়ীদের জমিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিলিবণ্টন করা হয় জিয়ার আমলে,পাহাড়ে মানুষদের উপর সামরিক কায়দায় দমন পীড়ন চলে অব্যাহতভাবে।সম্পদ দখল,জমি দখল,বসতি স্থাপন পোক্ত করার প্রক্রিয়ায় আজ পাহাড়ে বাঙালির পরিমাণ ৪৯% যা ১৯৭৯ সালে ছিল২.০৫%!!!
পাহাড়ে সেটেলার আর বাসিন্দাদের অধিকার সমান্তরাল করার জন্য সেনাবাহিনী,রাষ্ট্র মিলে আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছে ইদানিং। সেখানে যে যুক্তটি বারবার উচ্চারিত হয় তা হলো পাহাড়িরা সেখানে থাকতে পারলে বাঙালিরা কেনো নয়?? অথচ, একবারো বুঝতে চাই না যে সেখানে আদতে বাঙালির অস্তিত্ত্ব ছিলো না বললেই চলে। সেখানে সামরিক বেসামরিক বাহিনী কর্তৃক ধর্ষণ,লুটপাটের অভিযোগ যেমন রয়েছে তেমনি তাদের অবিরত উপস্থিতি যে অস্বস্তিকর এবং স্বাভাবিক জীবন হানিকর সেটাও তারা বারবার বলেছে।স্বাক্ষরিত যে শান্তিচুক্তি নিয়ে এতো কথা বলা হয় সেই চুক্তির ১৭(ক) ধারাতে বলা আছে -
“সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়-সীমা নির্ধারণ করা হইবে না।”
কিন্তু আদতে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে দৃশ্যমান এবং বিশ্বাসযোগ্য কিছু চোখে পড়ে না।সেখানে জিয়া এরশাদের ঘোষনাকৃত “ইমারজেন্সি অর্ডার” এড় মতো সেনাউপস্থিতি এখনো ব্যপকতর।এছাড়াও পুলিশি আগ্রাসন,আনসার ভিডইপির নজরদারি এখনো চলছে যা চুক্তির এই ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।পুরো পার্বত্যঅঞ্চলকে ঘিরে সামরিকায়নের মহোৎসব চলছেই।কিছুদিন আগে দীঘিনালায় বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করা নিয়ে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হলো,চোখ মেললেই সামরিক বাহিনীর রিসোর্ট হোটেল মোটেল ব্যবসা সবমিলিয়ে জমিদখল আর নিয়ন্ত্রন আরোপের প্রাণন্তকর পদক্ষেপ।এসব কিছু রাষ্ট্রীয় মুনাফাখোরদের আখের গোছাতে যেমন কাজে লাগছে অন্যদিকে বাঙালির আধিপত্যবাদও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
এছাড়াও পাহাড়ে যে ভূমিবিরোধ ছিলো সেটি নিষ্পত্তির জন্য এ যাবতকালে ৫ টি কমিশনের কোনটি আলোর মুখ দেখে নি।যে মানুষগুলো দেশ ছেড়ে আবার ফিরে এসেছে এবং বিভিন্ন কারনে বসতভিটা,জমি হারিয়েছে সেসব মানুষের পুনর্বাসন বিঘ্নিত হয়েছে।অথচ চুক্তির ১৪ ধারা আলোকে সিদ্ধান্ত ছিলো-
“ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থানরত উপজাতীয় শরনারথীদের দেশে ফিরাইয়া আনার লক্ষ্যে সরকার ও উপজাতীয় শরনারথী নেটৃবৃন্দের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় ৯ মারচ’৯৭ ইং তারিখে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।সেই চুক্তি অনুযায়ী ২৮ মাড়চ’৯৭ ইং হইতে উপজাতীয় শরণার্থীগণ দেশে প্রত্যাবর্তন শুরু করেন।এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকিবে এবং এই লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির পক্ষ হইতে সম্ভাব্য সব রকম সহযোগীতা করা হইবে। তিন পার্বত্য অঞ্চলে আভন্তরীণ উদবাস্তুদের নির্দিষ্টকরণ করিয়া পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা গ্রহন করিবে।”
এছাড়াও এই ঐক্যমতের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত ছিলো ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা।
খুব স্পর্শকাতর একটি প্রশ্ন হলো ইতিমধ্যে সেটেল হওয়া বাঙালিদের আশ্রয় তাহলে রাষ্ট্র কোঠায় দেবে??-এই প্রশ্নের যে কোন সমাধান নেই তা নয়।যে সমস্ত বাঙালি সেখানে তাদের আবাস গড়ে তুলেছেন তাদেরকে অন্যত্র স্থাপনের মতো জগাখিচুরিমমার্কা কাজ করা যেমন কঠিন আবার তা যথেষ্ট প্রতিরোধ বাঙালিরা করবে সেটাও অনুমেয়। সেক্ষেত্রে সেখানে ভবিষ্যৎ বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া ,পাহাড়ীদের আত্ননিয়ন্ত্রন নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা,ভূমির অধিকার চিহ্নিত করা,জাতিসত্ত্বার মর্যাদা দেয়া এবং পরোক্ষ সেনাশাসন প্রত্যাহার করার বিকল্প নেই।
তবে দৃশ্যত পদক্ষেপ যদিও তেমন নাই বরং এসব বিষয়ে বাংলাদেশের শাসক-জনগনের একটি অংশ-রাষ্ট্রযন্ত্র অবজ্ঞা অবহেলাই করেছে ।
খুব পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে তাকালে দেখা যায় আমরাও পাকিস্থানি কায়দায় পাহাড়ে শাসন অব্যাহত রেখেছি,আমরাও জাতিগত উন্মাদনায় হিতাহিত জ্ঞান ভুলতে বসেছি।সার্বভৌমত্ত্বের আবেগে অধিকারের বঞ্চনাকে অস্বীকার করছি।পার্থক্য কেবল একটাই –পাকিস্থান ধর্মের নামে করেছে আমরা গায়ের জোরে করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:০৬