কুরআন পাকে পর্দার বিধান সম্পর্কিত সাতটি আয়াত নাযিল হয়েছে। চারটি সুরা আহযাব এ এবং তিনটি সুরা নূর এ।
মু'মিনদেরকে বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন (আন নুর; ৩০)।
ইমানদার নারীদেরকে বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুড়, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত বাদী, যৌন কামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারও কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ- সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোড়ে পদচারনা না করে, মু’মিনগণ তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও (আন নুর; ৩১)।
নারীর পর্দ্দা সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ হাদীসে এত বেশি স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে তা নতুন করে প্রমান করা খুব বেশি আবশ্যক নয়। তবে কেউ কেউ কুরআন- হাদীসের ব্যাপারে পছন্দসই এবং গা- বাঁচানো পন্থা অবলম্বন করতে গিয়ে পর্দ্দার সীমারেখা নিয়ে বিতর্ক করে।
পর্দ্দার ফরয/ ওয়াজিব অঙ্গের মধ্যে কেউ কেউ চেহারা অন্তভুক্ত করতে খুব বেশি অনিচ্ছুক। কারন পাছে কেউ না আবার মৌলবাদী বলে গালি দেয়। এই প্রগতিশীল, মহান চিন্তানায়কদের নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছা নেই, কারন যুগে যুগে এরকম মহান, বিচক্ষণ, বুদ্ধিজীবিদের আবির্ভাব ঘটে, কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানীতেই এরা উদ্দেশ্য হাসিল করতে ব্যর্থ হয়।
তবে সাধারণ মানুষ যারা প্রকৃতপক্ষেই কুরআন- সুন্নাহ’র অনুসরন করতে চান তাদের জন্য এই লেখাটি। কুরআন- হাদীসের অসংখ্য উদ্ধৃতি এবং ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ সম্বলিত বিস্তারিত দলীল প্রমাণ ফিকাহ’র কিতাবে রয়েছে। তবে পারিপার্শিক সীমাবদ্ধতার কারনে এখানে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে শুধুমাত্র চেহারা যে পর্দ্দার ফরয বিধানের অন্তর্ভুক্ত তাই দেখানো হল।
ইহরাম অবস্থায় নারীর জন্য নিকাব ও হাতমোজা পড়া নিষিদ্ধ (বুখারী ও মুসলীম)।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম ইমাম তাইমিয়াহ রাহ. বলেন- এ থেকে প্রমান হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ইহরাম সজ্জিতা ছাড়া অন্যান্য নারীদের হাত মোজা ও নিকাব পড়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল।
আয়িশাহ রাদ্বি. বর্ননা করেন- আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ইহরাম সজ্জিতা অবস্থায় উষ্টারোহী আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় আমাদের মুখোমুখী হতে না হতে আমরা উপর হতে চাদর টেনে চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিতাম (আহমাদ, আবু দাঊদ, ইবনি মাজাহ)।
উপরের দু’টি দ্ব্যার্থহীন, স্পষ্ট হাদীস থেকে দেখা যায় যে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপস্থিতিতেই মহিলারা পর্দ্দার ক্ষেত্রে চেহারাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
আর দ্বিতীয় হাদীসে আয়িশাহ রাদ্বি. থেকে- চেহারাসহ শরীর পর্দ্দা করার যে তৎপড়তা বর্ননা হয়েছে তা চেহারা পর্দ্দার ফরয/ ওয়াজিব বিধান এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া বোঝার জন্য যথেষ্ট।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের স্বর্ণযুগে যেখানে চেহারাও পর্দ্দার অন্তর্ভুক্ত ধরা হত সেখানে বর্তমানের নৈতিক স্খলন এর যুগে এর আবশ্যিকতা এবং এর বিরুদ্ধাচরন করা যে নিতান্তই স্বার্থ চরিতার্থ করার অভিপ্রায় তা বলাই বাহুল্য।
আর যারা কুরআন- হাদীসের অনুসরনের নামে তা করে থাকে তাদের সততা ও দ্বীনদারী কোন পর্যায়ের তা- ও বলার অপেক্ষা রাখে না।
লক্ষ্য করবেন, হাদীসগুলোতে শুধুমাত্র মাসআলা বর্ননাই করা হয়নি বরং তা স্পষ্ট বাস্তবায়নের কথাই বলা হয়েছে। যারা আমাল করতে চান তাদের জন্য দলীল হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট, আর যারা ফাঁক- ফোকর খুজে বের করে কুরআন- সুন্নাহ নিয়ে খেল- তামাশা করতে চান তাদেরকে কখনোই বুঝানো যাবে না, এইসব মানুষ নিজের সাথেই নিজে লুকোচুরি খেলছে।
ফিকাহবিদদের অভিমত:
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাইময়িাহ রাহ. বলেন- জিলবাব বলতে চাদরকে বুঝায়। আব্দুল্লাহ ইবনি মাসঊদ রাদ্বি. বলেন- জিলবাব বলতে সাধারণভাবে এমন চাদরকে বুঝায় যা মস্তকসহ সমস্ত শরীরকে আবৃত করে। নারী জাতিকে জিলবাব পড়ার নির্দেশ এ জন্য দেয়া হয়েছে যেন তাদেরকে চিনতে না পারা যায়, আর এ উদ্দেশ্য তখনই অর্জন হবে, যখন তারা মুখ ঢেকে রাখবে (মাজমাঊল ফাতাওয়া, খন্ড ২২)।
শাফিঈ মাজহাবের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল মিনহাজ এ বলা হয়েছে- মুসলীম শাসকবৃন্দের ইসলামী এবং ইমানী দায়িত্ব হচ্ছে নারীদেরকে মুখমন্ডল খোলা রেখে বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে কঠো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। কারন ফিৎনা সৃষ্টি ও যৌন উত্তেজনার মূলে দর্শনই দায়ী (উল্লেখ্য ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের উচিত নিজেদের আওতাভুক্ত নারীদেরকে শরীআতসম্মত পন্থায় পর্দ্দার মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করা)।
ইমাম আযম ইমাম আবু হানিফাহ রাহ. এর মতে- ফিৎনার আশংকা ব্যতীত উক্ত অঙ্গগুলো খোলা জায়েয (বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিৎনার ভয়াবহতায় নিঃসন্দেহে তা- ও নাজায়েয)।
হাত, পা ও মুখমন্ডল খোলা রাখা জায়েয হওয়া সম্পর্কিত হাদীসগুলো বেশিরভাগই তা নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বের, কিছু কিছু হাদীস কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার বর্ননা ( অথবা ইমাম আবু হানীফাহ রাহ. এর ফতোয়ার ভিত্তি), কোনটির সনদ ত্র“টিযুক্ত এবং সর্বোপরি স্বাভাবিকতা, যুক্তি এবং অনিষ্ট প্রতিরোধের পরিপন্থী।
যেমন হাদীসে আছে সাবালিকা মহিলার জন্য কজ্বি পর্যন্ত হাত, পা ও মুখমন্ডল ব্যতীত অন্য কোন অঙ্গ খোলা রাখা উচিত নয় (আবু দাঊদ, ইবনি জারীর, ফাতহুল কাবীর), যা সাধারণ অবস্থার বর্ননা, অর্থাৎ এতটুকু ব্যতীত নারীর সমস্ত শরীর সতরের অন্তর্ভুক্ত, উদ্দেশ্য হল- এগুলা মাহরাম পুরুষ বা নারীর সামনেও খোলা জায়েয নয়। যেমন পুরুষের জন্য নাভী থেকে হাটু পর্যন্ত অন্য কোন পুরুষ বা নারীর সামনে খোলা জায়েয নয়।
অসংখ্য প্রমানের মধ্যে আরও একটি প্রমান হচ্ছে প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ ইবনি কাসীর। এতে সুরা আহযাব এর ৫৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কাসীর রাহ. ইবনি মাসঊদ রাদ্বি. এর মত বর্ননায় বলেছেন জিলবাব বলতে এমন চাদর বুঝায় যা মাথার উপর থেকে পরিধান করা হয়।
তিনি আলী ইবনি আবী ত্বালহাহ এর বর্ননায় ইবনি আব্বাস রাদ্বি. এর মত বর্ননা করেছেন যে- মহিলারা কোন প্রয়োজনে বাইরে বের হলে তারা যেন তাদের মাথার উপর থেকে জিলবাব দিয়ে নিজেদের চেহারা ঢেকে নেয়।
ইমাম ইবনি সিরীণ থেকে বর্ননা করা হয়েছে যে তিনি উবাইদাহ আস সালমানি রাদ্বি. কে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনিও মাথা ও চেহারা ঢাকার কথা বলেন (তাফসীরে ইবনি কাসীর)।
সর্বশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পতœী, অসংখ্য হাদীসের বর্ননাকারী এবং ফতোয়া দানে অভিজ্ঞ উম্মুল মু’মিনীন আয়িশাহ রাদ্বি. এরই একটি প্রত্যক্ষ আমালের বর্ননা দিয়েই লেখা শেষ করব-
বুখারী শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৯৩:
আয়িশাহ রাদ্বি. বর্ননা করেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিয়ম ছিল সফরে কোন বিবিকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য লটারির ব্যবস্থা করতেন। ... ... ...
সাফওয়ান ইবনি মুআত্তাল নামে একজন সাহাবী ছিলেন (যাহার দায়িত্ব ছিল অবতরন ক্ষেত্র থেকে সর্বশেষে সবকিছুর খোঁজ করে যাওয়া)। তিনি আমার নিকটবর্তী আসিলেন এবং দুর থেকে তন্দ্রারত মানুষ আকৃতি দেখে লক্ষ্য করতেই আমাকে চিনে ফেললেন। কারন পর্দ্দার বিধানের পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। তিনি আতঙ্কিত হয়ে ইন্নালিল্লাহ ... পড়লেন। তার সেই পড়ার শব্দে আমার তন্দ্রা ছুটে গেল। আমি তৎক্ষণাৎ আমার ওড়না দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে নিলাম। খোদার কসম, তিনি আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেননি, ইন্নালিল্লাহ ব্যতীত তার কোন শব্দও আমি শুনিনি। ... .... ....
এটি একটি সুদীর্ঘ হাদীসের অংশবিশেষ, কোন সংশয় থাকলে মূল বুখারী শরীফ বা এর যেকোন অনুবাদ দেখার জন্য অনুরোধ করা হল। এখানেও পর্দ্দার বিধানের পূর্বে তার চেহারা দেখার কথা এবং সাহাবী সাফওয়ান রাদ্বি কাছে আসতেই তার কাছ থেকে চেহারা ঢেকে নেওয়ার স্পষ্ট বর্ননা আছে।
আল্লাহ পাক সকল প্রকার কপটতা, স্বার্থবাদীতা পরিহার করে সিরাতুল মুস্তাক্বীম বুঝার, মানার এবং আমাল করার তৌফিক দান করুন, আমীন।
(লেখাটির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. এর লেখা শরীআতের দৃষ্টিতে পর্দ্দার হুকুম বই থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে, হাদীসগুলো মূল বই থেকে মিলিয়ে নেয়া হয়েছে)
ইমাম আবু হানীফাহ রাহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:
Click This Link
سبحان ربّك ربّ العزّة عمّا يصفون و سلام على المرسلين والحمد للّه ربّ العالمين .