বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম ১৯৭১ থেকে সব ইতিহাস খুব ভাল করেই জানে। এই যুদ্ধের ইতিহাস দিয়েই আমাদের পরিবার গড়া ও আবদ্ধ । কোন বাংলাদেশী পরিবার কি আছে দেশটি পাকিস্তান থেকে আলাদা হিসাবে একটি নতুন জাতি জন্ম দিতে যে আবেগ, দুর্ভিক্ষ, খুন এবং রক্ত স্পর্শ করে নি? কোনো দেশভাগের পর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সফল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গড়ে ওঠা, "মুক্তিযোদ্ধা" ও মুক্তি বাহিনীর গল্প, "মুক্তিযোদ্ধার জন্য বাংলা"এসব গল্পই তো আমাদের মাথা উঁচু করে দাড় করিয়েছে।
১৯৭১-এ আমার মা আমাকে বলেছিল, হারিয়ে যাওয়া সজ্জনদের খুঁজে পেতে তুমি তোমার পরিবারের কাউকে বড় কোনো পাবলিক পার্কে পাঠিয়ে অনুসন্ধান করবে যেখানে শুয়ে আছে তারা, পাকিস্তানি সেনারা যাঁদেরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
অবিরাম হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন সত্ত্বেও, তিনি এখনও বলেন, এখনো বাতাসে সেই অনুভূতি ভাসে যে, তোমার কিছু করার ছিল। "প্রত্যেকেরই জানা ছিল স্বাধীনতা ছিল শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার।"
এক জিনিস, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে শুনতে আমরা যতটা উৎসাহী, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে যে কারণে পরাজিত হয়েছিল তা ছিল ধর্ষণ - এ সম্পর্কে শুনতে ততটা না।
অনেক শিক্ষাবিদ বলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রথম ধর্ষণকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সর্ব্বোচ্চ কমাণ্ড থেকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে সচেতনভাবে প্রয়োগ করা হয়।
তবুও উদ্ভিন্ন, যারা যুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বলা হয়েছিল, আখ্যান থেকে অনুপস্থিত ছিল যে গল্প তা তাদের জানানো হয় নি।
মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধের সমর্থক হিসেবে নারীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়, ধর্ষণ ক্যাম্প এবং যুদ্ধ শিশুদের গল্প মূলত উপেক্ষা করা হয়।
কিন্তু আমরা সেসব যতো শক্ত হিসেবেই মনে করার চেষ্টা করি না কেন, ইতিহাস পুনর্লিখিত করা যাবে না জানি. যেখানে সত্য বিদ্যমান, এবং শেষ পর্যন্ত তা বেরিয়ে আসে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, পণ্ডিতগণ যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, এবং নারীবাদীরা যেসব সত্য উদ্ঘাটনের দাবি জানান, তা যেন সব লজ্জা ধীরে ধীরে পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই অংশ থেকে বেরিয়ে আসছে।
আমি যতবারই বাংলাদেশে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি ততবারই, প্রতিটি সময়, সাধারণত পুরুষ আত্মীয়, আমাকে আড়ালে সরিয়ে নিয়ে সেসব গল্প সম্পর্কে বলে "স্তুপের পর স্তুপ, এবং ধর্ষণের শিকার মেয়েদের লাশের স্তুপ" তুমি যদি কোনো সেতুর নিচে গণকবর খুঁজে পেতে চাও. "অনেক নারী পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হয় কিভাবে!" আমার চাচা তার কন্ঠ ফিস্ ফিস্ করে আমাকে বলেন, "তুমি, কল্পনা করতে পারবে না, মা।"
কিন্তু একজন বাংলাদেশী পণ্ডিত ঠিক সে কাজটাই করতে চেয়েছেন. আসলে, একটি দেশ হিসাবে আমরা তাঁর কাছে কৃতগগতা জানাতে গিয়েছিলাম, তিনি হচ্ছেন বীণা ডি'কস্তা যিনি সে সময়ে অষ্ট্রেলিয়া যান এবং এমন একজন ডাক্তার খুঁজে বের করে আনেন যার নাম জিওফ্রে ডেভিস। আন্তর্জাতিক পরিকল্পিত পেরেন্টহুড ফেডারেশন (IPPF) এবং জাতিসংঘের ঢাকায় আনা অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার, জিওফ্রে ডেভিস, যিনি বাংলাদেশী ধর্ষিতা নারীদের বিলম্বিত গর্ভপাত সম্পাদন করেছিলেন, এবং '৭১-এর যুদ্ধ শিশুদের বড় দাগে আন্তর্জাতিক দত্তক গ্রহণ সুবিধার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
ডঃ ডেভিস সঙ্গে ডি কোস্টা এর কথোপকথন ইদানিংকালে বাংলাদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, এবং এগুলোর পাঠকমূল্যও অনেক. পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের ধর্ষণ ক্যাম্পে সংঘটিত অকথ্য নির্যাতনের সেসব কাহিনী, নারীদেরকে গাছে বেঁধে গণধর্ষণ, স্তন ছুরি-চাকু দিয়ে কেটে ফেলা, গভীরভাবে ক্ষত-বিক্ষত করা, এরকম আরো হাজারো উপাক্ষ্যাণ সংযুক্ত হচ্ছে বিস্তারিতভাবে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা, ২০০,০০০-৪০০,০০০ ধর্ষিত নারীদের সংখ্যা স্বাভাবিক পরিসংখ্যান ধরে, ডাঃ ডেভিসকে যখন সঠিক হিসাবের কথা জিজ্ঞাসা করা হলো, ডঃ ডেভিস তখন বলেছেন, ওই হিসেব যারা করেছে তারা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম করে দেখিয়েছে। ... সম্ভবত সংখ্যার দিক থেকে পাকবাহিনী যা করেছে তার তুলনায় উল্লেখিত ধর্ষিতার সংখ্যা বেশ রক্ষণাত্বক।
তারা কিভাবে শহর দখল করেছে তার বর্ণনা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। তারা পদাতিক বাহিনীকে পেছনে রেখে গোলন্দাজ বাহিনীকে দিয়ে হাসপাতাল এবং স্কুলে গোলাবর্ষণ করেছে। এবং এতে করে শহরে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তারপর পদাতিক যান এবং নারী দলবদ্ধভাবে অগ্রসর হয়েছে. এছাড়া নিতান্ত শিশুদের থেকে যৌনসক্ষমদেরকে আলাদা করে, আঙিনার ভেতর কিছু প্রহরীর অধীনে মহিলাদেরকে জড়ো মওযুত করে রাখা হতো বাহিনীর বাকি সদস্যদের জন্য। মহিলারা যেভাবে বলেছে তন্মধ্যে কিছু ছিল ভয়াবহ ... সৈন্যদেরকে প্রহরীর অধীনে থাকা আঙিনায় গমনাগমনের সুযোগ রাখা এবং একের পর এক অবিরাম ধর্ষিত হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই [ধর্ষণ] ক্যাম্পেই মারা যান। পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে বাতাসে একটা অবিশ্বাসও ভেসে বেড়াতো, কারণ কেউ যে এটা সত্যিই ঘটতে দেখেছে সেরকম তো নয়! কিন্তু ঘটনার আলামতগুলোই প্রমাণ করে যে সবকিছুই পরিষ্কারভাবে ঘটেছে।
শেখ মুজিব সমাজে তাদের আত্মীকরণের সাহায্য করার জন্য "বীরাঙ্গনা" হিসাবে ঘোষণা করেন যাতে ধর্ষণ এড়িয়ে পুনর্বাসন করা যায়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা মূলত কাজ করে নি। এসব লাঞ্ছিত ও পাকিস্তানের সৈন্য দ্বারা সংপৃক্ত হওয়ার পর ওই নারীরা সম্পূর্ণভাবে সমাজ দ্বারা একঘরে করা হয়। অনেক তাদের স্বামী, আত্মহত্যা করে হত্যা, বা তাদের অর্ধেক পাকিস্তানের শিশুদের নিজেদের সাথেই হত্যা করা হয়। কিছু মহিলার পাকিস্তানের ধর্ষণ ক্যাম্পে বন্দী হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে যেতে তাই ভয় ছিল। তারা পাকিস্তানি বন্দীদের সাথেও অনেকে চলে যেতে চেয়েছে, কেউবা পাকিস্তান চলে যেতে তাদের নিতে পাকিস্তানি নারী পাচারকারীদের তালাশও করেছে।
আমি বিভিন্ন প্রবন্ধে এগুলো যখন পড়েছি, তখন একইসাথে অনলাইন উৎসও খুঁজেছি। আমি NBC এর একজন প্রতিবেদকের কাছে এইমর্মে একটা ভিডিও পাই, যে কিনা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধর্ষণক্যাম্পের পাশেই আশ্রয় পেয়েছিলেন, এবং তিনি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে সংপৃক্ত অনেক মেয়েকে দেখেছেন যারা বিতরণ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষমান ছিলেন।
এটা হয়তো আপনার স্মরণ করতে সহায়তা করবে যে, '৭১ সালে নারীর বিরুদ্ধে বড় মাপের সহিংসতা সম্পর্কে কথা বলতে প্রায়ই আমরা তরুণ মেয়েদের সম্পর্কে কথা উঠাই, মনে রাখবেন, যে তোলে কখনও কখনও, মাত্র ১৩ বছর বয়সী বলেও উল্লেখ করে।
আমি পড়াশুনার ব্যাপারটা অব্যাহত রাখতে আমার আবেগ মাধ্যমে লড়াই করেছি, আমি ম্তব্ধ হয়ে আমার চেয়ারেই ফিরে বসে থেকেছি. "আমি এই কাজ করছি কি?" আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছি। "মাটি খুঁড়ে এই সব ভয়াবহতা বের করে আনার কিইবা হেতু?"
আসল ব্যথা ঠিক কোন বিন্দুতে, তা যখন আমি অনুধাবন করতে পারলাম, সেটা লজ্জার, যুদ্ধকে বহন করতে করতে বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশী নারী সব আমাদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া উচিত। কেন তাদেরকে নীরবে তা নিয়ে ভুগতে হবে? তারা সম্ভবত যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বোঝা নিয়ে ভারাক্রান্ত ছিল, এবং সম্মান থেকে ছিল বন্চিত আমাদেরকে তাদের চিনতে হবে। আমাদেরকে তাদের সেই অভিজ্ঞতা ও সম্মান খুঁজে বের করতে হবে।
হ্যাঁ, আমােরে দেশটা একটি "রক্ষণশীল" দেশ বটে। হ্যাঁ, আমরা একটি মুসলিম দেশ। হ্যাঁ, আমরা '৭১ সালের বেদনাদায়ক এবং ভয়ঙ্কর অংশ আমাদের চোখ যতই বন্ধ রাখতে চাই না কেন কিন্তু তাতে আমাদের অস্তিত্ব আমাদের ইতিহাসের একটি বিশাল অংশ অস্বীকার করা হয়, যে করে সে তো অনেক অজুহাতই ব্যবহার করতে পারেন। ডি কোস্টা বলেছেন, আমরা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুগে যাচ্ছি যা "ঐতিহাসিক স্মৃতিভ্রংশ।"
বসনিয়া'র পর, রোম সংবিধি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসাবে ধর্ষণ স্বীকৃত। এই বেঁচে যাওয়ায় এখনও যারা জীবিত আছে, বাংলাদেশকে অবশ্যই তাদের প্রদত্ত সাক্ষ্যকে সম্মান করতে হবে এবং পরিশেষে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে হলেও বাংলাদেশ যে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সেট-আপ করেছে সেখানে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
যে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমাকে এখনও ভেতর থেকে তাড়িত করে তা হচ্ছে, একটি বিশাল ঐতিহাসিক ক্ষত আছে যা নিরাময়ে বাংলাদেশে স্পন্দনশীল নারী আন্দোলন কতদুর পর্যন্ত যেতে পারে? আমরা অবশ্যই অতীতের দিকে ফিরে তাকাবো, যদি আমরা সত্যিই এসব নারীদের জন্য সুবিচারের ব্যবস্থা করতে পারি। আমরা যদি সত্যিই সামনের দিকে অগ্রসর হতে চাই তাহলে ১৯৭১ সালের যৌন সহিংসতার সব বেঁচে যাওয়া নারী, তাদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সূত্র:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১:০৩