somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভিন্ন ভাবনা : বাংলাদেশে বাংলা ভিন্ন অপরাপর ভাষা সমূহের প্রতি উদাসীনতা বজায় রেখে কী ভাষা শহীদদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব?

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


"ছাং ক্রেংছাদা ইক্হংগো
দালা প্রেংয়াগা আচাক মারেং কলা
নি নি ঞা ঞা লিকহো তুংহে..."


(চাক গানের অংশ বিশেষ; ভাবানুবাদঃ চৈত্র মাসে জুম কাটি/দালা গ্রামের চাক,মারমা,মুসলমান/আমরা সবাই সমান কাজ করি/জ্যৈষ্ঠ মাসে ধান রোপন করি/ চারা বড় হলে/ আমরা সবাই খুশিতে আত্মহারা...।)
......................................................................................................
"ওন্টে পাচ্চো পাইরি পুদবাকী
ওন গাল্লে কাড়কা চাব্-ই"

(কুরুখ ভাষার একটি ধাঁধাঁ; ভাবানুবাদঃ একটা বুড়ি সকাল সন্ধ্যায়
একগালে দাঁতন চিবায়। উত্তরঃ চুলা)
.......................................................................................................
"খেংগরং বেইয়া দিম্ দিম্ দিম্
তরে না দিলে কারে দিম
লগে সমায্যা গরি নিম
দিম্ দিম্ দাদা দিম্ দিম্ দিম্ দিম্।"

[চাকমা ছড়া;ভাবানুবাদঃ খেংগরং বাজায় দিম্ দিম্ দিম্/ তোকে না দিলে কাকে দিম/সঙ্গে সাথী কারে নিম/দিম দিম (দেবো দেবো) দাদা দিম দিম দিম (দেবো দেবো দেবো)]
.......................................................................................................
"রাঙা খাড়ি কালা পেল
বিসুম গেলে ও চিগোন বইন
ম'-এ ন' দিচ্ গেল্।"

(তনচঙ্গ্যা গানের অংশ বিশেষ। ভাবানুবাদঃ রাঙা খাদি কালো পাড়/ ও লক্ষ্মী হাঁচি পেলে/ দিও না গাল।)
.......................................................................................................
"জালিক গিথাং ফালানি দংআ থাংখা খলাচি
বারাশাড়ি রানাদে রেবো নোনো আন্তিচি।"

(মান্দিদের আচিক ভাষায় শেরেনজিং পালার দুটি লাইন;ভাবানুবাদঃ মরিচ বেঁচে তিরিশ টাকা আছে আমার কাছে/ভালো শাড়ি কিনে দেব চল যাই বাজারে)
..............................................................................................................................................................................................................

মায়ের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ৫২'র ভাষা আন্দোলনে বীর শহীদদের আত্মদান বাঙালি জাতির এক অনন্য গর্বের বিষয়। পৃথিবীর বুকে আমরা বাঙালিরা এক ভিন্ন নজীর হাজির করেছি মাতৃভাষার জন্য রাজপথে রক্ত ঢেলে ( অবশ্য ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ ভারতের বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে সুদেষ্ণা সিংহ শহীদ হয়ে মাতৃভাষার প্রতি মানুষের অকৃত্রিম মমত্ববোধকে আবারো আমাদের সামনে তুলে ধরেন)। আমরা গবির্ত সেই বীর শহীদদের অসামান্য আত্মদানে। তাদের অসামান্য আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের মায়ের ভাষাকে ঘিরে আজকে এক স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক। একজন বাঙালি হিসেবে এ আমার বুক ফুলানো এক ব্যাপার। মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য বীর শহীদদের সেদিনের আত্মত্যাগ আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। ১৯৯৯ সালে আমাদের বাঙালির মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে অনুমোদন দেয় ইউনেস্কো। বাঙালির একুশ আজ সবার। স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এ আমার বিরাট অহংকার। কেননা মাতৃভাষার প্রতি মানুষের নাড়ির বন্ধন কতটা মজবুত, কতটা গভীর হতে পারে তা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারেরা নিজেদের তাজা রক্ত বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি সেই অকুতোভয় বীর শহীদের। এই বীর শহীদসহ বাংলার সংগ্রামী জনতা সেদিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন নিজের মায়ের ভাষা একটি জাতির কত বড় এক ধন। ৫২ সেই উত্তাল সময়ের পথ ধরে ৭১এ বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম। লাখো শহীদ, আর অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এলো নতুন ভূখণ্ড; বাংলা ভাষা-ভাষীদের নিজেদের রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। আমরা পেলাম আমাদের নিজস্ব সংবিধান। আমাদের সংবিধানে আমাদের অনেক প্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটল। আবার অনেক কিছুই থেকে গেল দৃশ্যময়তার আড়ালে। সেই আড়াল এই স্বাধীন ভুখন্ডের প্রায় ৪৫টি ভিন্ন ভিন্ন জাতিসমূহের অস্তিত্বকেই গ্রাস করে নিল। বাঙালি জাতির বাঙালিত্বের সাংবিধানিক দৃশ্যময়তার পাশে কোন ঠাইই মিলল না এই ভূখণ্ডের বৈচিত্রময় চাকমা, মারমা, ককবরক, লালেং, মৈতৈ, ঠার, কুরুখ, সান্তাল, আচিক, হাজং, রাখাইন, খুমি, ম্রো, মাহাতো, মুণ্ডা, খাসিয়া, সিং, বিনধ, পাহাড়িয়া, পাঙ্খো, লুসাই, চাক, তনচঙ্গ্যা, লাইমি, রাজবংশী প্রভৃতি ভাষা-ভাষী মানুষের আপন আপন মায়ের ভাষার কথা; আপন আপন জাতিগত অস্তিত্বের কথা। বহুজাতিক বা বহু ভাষাভাষীর রাষ্ট্রে বরাবরই সংখ্যার বিবেচনায় প্রান্তিক ভাষা সমূহ কোণঠাসা অবস্থায় থাকে। সেখানে বৃহত্তর জাতির ভাষা বা তাদের সুবিধা মতন অন্য কোন ভাষা প্রধান হয়ে উঠবার এবং জোরপূর্বক একভাষিকতা চাপানোর একটা অসৎ প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়। বুর্জোয়া জাতি রাষ্ট্র সমূহে এই প্রবনতা অত্যন্ত প্রকট হলেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়ও তার অনুপস্থিতি দেখতে পাইনি। কেননা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও রুশ ভাষার জৌলুস আর বিস্তারের বিপরীতে লেট, এস্তোনিয়াসহ অন্যান্য ভাষার অবস্থা ছিল ম্রিয়মান। কিন্তু নিজ মায়ের ভাষার জন্য ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী বাঙালি জাতির বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এর অবস্থা ভিন্নতর হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। আমরা বাঙালিরা প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ স্তর পর্যন্ত নিজেদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলেও অপরারাপর জাতিসমূহের আপন আপন ভাষায় প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার ব্যবস্থাতো দূরের কথা, তাদের ভাষা সমূহের কোন স্বীকৃতিই আমরা দিতে পারিনি সাংবিধানিক ভাবে। প্রান্তিক জাতি সমূহের আপন বর্ণমালায় আপন আপন ভাষা চর্চার কোন পদক্ষেপই রাষ্ট্রীয় ভাবে নিতে পারিনি স্বাধীনতার এতবছরেও। পারিনি সেই ভাষা সমূহের বিকাশের জন্য নুন্যতম কোন ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু মায়ের ভাষার অস্তিত্বকে সমুন্নত রাখার যে চেতনাকে ধারণ করে আমাদের সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারেরা বুক চিতিয়ে রাজপথে অসামান্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন সেই শহীদের আত্মত্যাগের ধারাবাহিকতার বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই বাংলাদেশে অপরাপর ভাষা সমূহের দুরবস্থা কী কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে? আমরা কী পেরেছি আমাদের ভাষা শহীদদের প্রতি যথাযথভাবে শ্রদ্ধা জানাতে? একই জনপদের অন্য জাতির মায়ের ভাষার প্রতি উদাসীনতা বজায় রেখে আমাদের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর তরিকাটা কী সঠিক হতে পারে? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল জাতির সকল মানুষের আপন আপন মায়ের ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সার্বিক বিকাশের পথকে সংহত করার মধ্য দিয়েই কী আমাদের ভাষা শহীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে না?
১৪টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×