somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেঁকা চাউনি

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




কদিন আগে আমার এক বন্ধু সুখ বিষয় নিয়ে কবিতা লিখে ফেলছে। বন্ধু জানাইতেছে, সুখের খোঁজে মন তার ব্যাকুল। তারপর ব্যাকুল মনকে শান্ত করতে বলতেছে, সুখ সে তো এক মানসিক অনুভূতি। তারপরে প্রমাণ হিসেবে পথে প্রান্তরে ফুটপাতের লোকেরা যে কত্তগুলা অসুখি, সেই গল্প অশান্ত মনকে শান্ত করতে বলতে শুরু করে দিছে।

কবিতার পরের চ্যাপ্টারে আছে বিত্তঅলা লোকেদের কথা। বিত্তঅলা লোকেরা তাদের বিত্ত দিয়ে সকল বিলাস নিজেদের বাড়িতে জমা করে রাখছে। কিন্তু তবু তারা সুখে নাই।

পরিশেষে বন্ধু আমার ‘সুখ সেতো নয় নির্ভর, অর্থবিত্তের কাছে’- এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে ঠান্ডা হয়েছে।

তো বন্ধুর এই কাব্য আমাকে নস্টালজিক করে ফেলল। ক্লাস ফোরে আমাদের বাংলা বইয়ে একটা গল্প ছিল। সেই গল্পর কথা আমার মনে পড়ে গেল। গল্পর নাম ‘সুখি মানুষ।’ সেই গল্পে রাজ্যর রাজার অচিন এক অসুখ হয়ে যায়। কবিরাজ ব্যবস্থাপত্রে বলে দেয়- সুখি লোকের জামা জোগাড় করে পিন্দে ফেলতে হবে। পিন্দে ফেললেই অসুখ সেরে যাবে।রাজা তখন সুখি লোক খুঁজে বের করে তার গা থেকে জামা খুলে আনতে পেয়াদা লোকেদের পাঠায়ে দেয়।

কিন্তু হায়! সুখি লোক পাবে কই! যারেই জিগানো হয়- সেই সুখি লোক না। কেউ সুখি নয়। অবশেষে জঙ্গলে গিয়ে এক লোকেরে পাওয়া গেল। সেই লোকের বিরাট বুকের পাটা। সেই বুকের পাটায় টোকা দিয়ে ওই লোকে নিজেরে সুখি লোক বলে দাবী করে ফেলল। পেয়াদা লোকেরা বেজায় খুশী। রাজ্যর পথে প্রান্তরে জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে তাদের পাও ব্যথা হয়ে গেছিল।

কিন্তু তখনই খুবই প্রকটভাবে নতুন সমস্যা আবির্ভূত হলো। এই লোকে উদাম হয়ে চলাফেরা করে। তার কোনও জামা-টামা নাই। ফলে কবিরাজের ব্যবস্থাপত্রর ওষুধ- সুখি লোকের জামা নামক ওষুধ আর পাওয়া গেল না।

এখন কথা হলো, এই গল্পর মরাল বলতেছে, সুখি লোক লোকালয়ে থাকতে পারে না। যদি সুখি লোক বলে কেউ থাকতে থাকে, তাহলে তারে থাকতে হবে গিয়ে জঙ্গলে।

আরেক কথা হলো, সুখি লোকেরে থাকতে হয় উদাম হয়ে। কাপড়জামা থাকাথাকির কোনও নিয়ম নীতি সুখি লোকের নাই।

গল্পর সেই সুখি লোকেও বলাবলিতে অহংকার মিশায়ে বলে দিছিল, তার কাপড়জামা নাই, চুরি হওয়ার মতো কোনও সম্পদ নাই - এই কারণেই নাকি সে সুখি।সম্পদশালী হলেই লোকেদের চুরির ভয়। তখন চুরির চিন্তা তার সুখ কেড়ে নেয়। সম্পদ সে গড়তেও যায় না। সে সৎ ও পরিশ্রমী লোক। জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কাটে। সেই কাঠ বাজারে বেচে বেচে তার খাওয়াখাদ্য আর পায়জামা কেনে। এই কাঠ কেটে বেচে ফেলার ঘটনাটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।

তো, ওই লোকে জঙ্গলে একলা একলা থাকে। জীবনধারণের যে সামাজিক নিয়ম আছে, তার বেলায় সেগুলা নাই। সে মানেও না। বউ বাচ্চা বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন তার নাই। জঙ্গলে যে অহংকার নিয়ে থাকাথাকি করে তাতে বোঝা যায় ওগুলার ঠ্যাকাও তার নাই। তার মানে এই লোক চরম অসামাজিক। সামাজিক হলে সমাজের মধ্যে থেকে নতুন সম্পর্ক বানাবার প্রচেষ্টা থাকত। সে প্রচেষ্টা তার নাই। জামা তো পরেই না। পাকস্থলী আর পায়জামা ছাড়া তার কোনও ভাবনা নাই। তাই তার চাকরি বাকরিরও দরকার নাই। সৎ ও পরিশ্রমী এই লোকে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন জঙ্গলে গিয়ে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন গাছেদের কেটে কেটে বাজারে নিয়ে অবলীলায় বেচে দিয়ে খাদ্য ও পায়জামা কিনে ফেলে।

এখন দেখেন খুব পরিকল্পিতভাবে গল্পর এই সুখি লোকটারে কোমলমতি শিশুদের আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ওই গল্প পাঠ করে কোমলমতি শিশুরা সত্যিকার সুখি লোক হতে চাইবে, তারা সম্পদ গড়তে চাইবে না, দালান-কোঠা বাড়ি-গাড়ি তাদের লাগবে না, তারা জঙ্গলে গিয়ে কুঁড়েঘরে বসবাস করতে মনে মনে প্রস্তুত হবে- এইটাই কি পাঠ্য বইয়ের অভিপ্রায়?

তো এই যে ছোটকাল থেকে আমাদেরকে সম্পদশালী না হতে কেন শিক্ষা করা হলো! দেশে বেকার সমস্যা তো এমনে এমনে বাড়ে নাই, তাই না? কি বলেন?

তবে যুগ পাল্টে গেছে। আগের সেই যুগ আর নাই। সুখি লোক এখন আর জঙ্গলে থাকতে যায় না। কেমনে যাবে! আমাজনে দাবানলের যে অভিজ্ঞতা, জঙ্গলে কি মরতে যাবে? বাড়ির কাছে আরশি নগর সুন্দরবনে গেলেও ঝামেলা আছে। সুন্দরবনের গাছপালা কেটে ফেলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাইতেছে। তো গাছ না থাকলে সুখি লোকে কি কেটে বেচে বেচে খাদ্য আর পায়জামা কিনবে? তাছাড়া এখনকার শহরগুলাও তো একপ্রকার জঙ্গলই। জানোয়ারের চেয়েও অধিক হিংস্রতায় শহরের লোকগুলা অনায়াসে জংলীদেরও স্বচ্ছন্দে পরাজিত করতে পারে।

এই শহরে তাই ওই সুখি লোকের আদর্শ নিয়ে মোটামুটি একটা প্রজন্ম দাঁড়ায়ে গেছে। সমাজে বসবাস করলেও সামাজিকতার ধার এরা ধারে না। সম্পর্কর কোনও দায়বদ্ধতা নাই। ওসি প্রদীপ তার নিজের বোনের জমি নিয়ে ফেলছে। ভাগ্নেকে নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে চালান করে দিছে। সেদিন শুনি এক দম্পতি তাদের ছেলেমেয়ের নামে মামলা করে দিছে। উচ্চশিক্ষিত আর উচ্চপদে চাকরি করা ছেলেমেয়ে মিলে বাপ-মাকে সম্পদের জন্যে নাকি নিত্য মারধোর করে। মারধোর করে একটা সাততলা বাড়ি নাকি এর মধ্যে তারা নিয়ে ফেলছে। এখন তাদের আরও লাগবে।

তো সম্পর্কর দায়বদ্ধতার মতো জীবনধারণের যে সামাজিক নিয়ম আছে, এদের বেলায় সেগুলা নাই। এমনকি রাষ্ট্রের আইনের ধারও এরা ধারে না।

ফলে প্রাকৃতিক জঙ্গলে গিয়ে বসবাস করবার ঠ্যাকা এখনকার সুখি লোকেদের নাই।তারা শহরেই বসবাস করে। তবে উদাম হয়ে বসবাস করে না। নানানরকম পোশাক আশাক তারা পরিধান করে।শহরে বসবাস করতে করতে আইয়ুব বাচ্চু গান গাওয়া লোকেদের খুঁজতে থাকে। আইয়ুব বাচ্চু গেয়ে দিছে, 'আসলে কেউ সুখি নয়।' এই গান গাইতে থাকা লোকেদের পাওয়া গেলে নিজের পুরান-ধুরান শার্ট, টি শার্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি ইত্যাদি বেচাবিক্রি করা যাবে। এখন মুক্তবাজার অর্থনীতি তো কিছুই ফেলনা না। আবার কিছুই মাগনা না।

খালি রাষ্ট্রীয় সম্পদ মাগনা। সেই যুগে সৎ ও পরিশ্রমী লোকেরা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জঙ্গলের গাছপালা কেটে কেটে বেচে বেচে খাদ্য আর পায়জামা কিনে ফেলত। কদিন আগে দেখি ঢাকার ফ্লাইওভারের তলে যে সড়ক দ্বীপ আছে, বেড়াগুলা নাই। নিশ্চয়ই কোনও সুখি লোকে সেটা খুলে নিয়ে বেচে দিয়ে খাদ্য ও পায়জামা কিনে ফেলছে।

আমাদের বুড়িগঙ্গা নদীটার তো দুই পার ভরে ভরে বাড়িঘর থেকে শুরু করে দোকানপাট কলকারখানার মেলা বানায়ে ফেলছিল। বানাতে বানাতে প্রমত্তা বুড়িগঙ্গারে চিপা ড্রেন বানায়ে ফেলছিল। রাষ্ট্র এখন কিছু কিছু উদ্ধার করতে শুরু করছে। কিন্তু বুড়িগঙ্গা যে রাষ্ট্রের সম্পদ এইটা বাড়িঘর, দোকানপাট আর কলকারখানার সুখি লোকেরা মানতে রাজি না। কেননা আসলে তারা প্রকৃত সুখি লোক না।

কিন্তু রাষ্ট্রর উর্দি পরা লোকেদের দেখে তারা প্রকৃত সৎ, পরিশ্রমী ও সুখি লোক হয়ে যায়। তারা তখন নায়ক জাফর ইকবালের গান গাওয়া লোক হয়ে যায়। জাফর ইকবাল গেয়ে দিছে, 'সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী।' কেননা আসলে তারা প্রকৃত সুখি লোক না। প্রকৃত সুখি লোক হলে তারা আইয়ুব বাচ্চুর গান ধরত, 'আসলে কেউ সুখি নয়।'

তবে হতাশ হওয়ার কিছু নাই। হতাশ হওয়া কোনও কাজের কথা না। আমার মতো আশাবাদী লোক হতে হবে। সুখি লোক যে এক্কেরে নাই- ঘটনা এমন না। আছে।আমিও এই শহরেই আছি। আমিও উদাম থাকি না। কারও যদি সুখি লোকের জামা লাগে তাহলে আওয়াজ দিবেন। ভাবনার কারণ নাই। সুলভ মূল্যে দিব। পিন্দে পিন্দে পুরান করে ফেলছি তো। কত আর রাখব! চক্ষুলজ্জা বলে একটা কথা আছে না!

এখন কথা হলো, এরম একটা গল্প স্কুলের শিশুপাঠ্য বইয়ে কেন দেয়া হয়েছিল?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×