somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনরক্ষাকারী হতে পারে লাইফ জ্যাকেট

১১ ই জুন, ২০২৫ সকাল ৮:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কানাডার অন্টারিও প্রদেশের স্টার্জন লেকে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের সবার জন্য একটা সতর্কবার্তা। ৮ জুন তিনজন মানুষ একটি ক্যানুয় উঠেছিলেন। হঠাৎ তা উল্টে যায়। একজন কোনোমতে তীরে ফিরতে পেরেছেন। বাকি দুজনের নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়েছে ঠান্ডা পানি থেকে। কানাডায় হালকা নৌযান ক্যানু ডুবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট সাইফুজ্জামান ও তার বন্ধু টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব মারা যান। কানাডার সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে ক্যানু আরোহীরা লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করেননি।

এর মাত্র কয়েক দিন আগে, ২ জুন সকালে, ব্রিটিশ কলম্বিয়ার কেলোনার ওকানাগান লেক থেকে উদ্ধার করা হয় আরেক বাংলাদেশি তরুণ, শাশ্বত সৌম্যর মরদেহ। যিনি ছিলেন বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সর্বোচ্চ মেধাবী ছাত্র (সিজিপিএ ৪.০০), পরে শিক্ষকতা করেছেন বুয়েট ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন আমেরিকার এমআইটি-তে। সৌম্য লাইফ জ্যাকেট পরিহিত ছিলেন কিনা জানা গেল না।ক্যানুতে করে লেকে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাটি বেশি আলোচনায় এসেছে স্টার্জন লেকের দুর্ঘটনায়।

ক্যানু কি?
এটা এক ধরনের ছোট খোলা নৌকা। যাতে পা রাখা হয় নৌকার খোলের ওপর এবং এতে কোনো ফ্লোর বোর্ড থাকে না। আমাদের দেশে যে ছোট ছোট নৌকাগুলো দেখা যায় অনেকটা তার মতন তবে আরও সরু ও লম্বা।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং ইন্টারনেট ঘেটে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়–স্টার্জন লেক এবং পুরো কাওয়ার্থা লেইকস অঞ্চলে সাধারণত যে ধরনের ক্যানু ব্যবহার করা হয়, তা হলো ওপেন রিক্রিয়েশনাল ক্যানু—এগুলো মূলত হ্রদ এবং শান্ত নদীর জন্য তৈরি। এগুলো কোনো রেসিং ক্যানু নয়, কিংবা সরু ‘আইওয়া-স্টাইল’ কায়াকও নয়। বরং এগুলো পরিবারভিত্তিক, তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল কিন্তু তবুও উল্টে যাওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ, সাধারণত পলিইথিলিন বা রয়ালেক্স নির্মিত ক্যানু, যেগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬ ফুট এবং ২-৩ জন যাত্রী (অনেক সময় পোষা কুকুরসহ) বহন করতে সক্ষম।

এই অঞ্চলে জনপ্রিয় একটি মডেল হলো ক্লিয়ার ওয়াটার কাওয়ার্থা ক্যানু। এটি একটি ১৬ ফুট দীর্ঘ, রোটোমোল্ডেড (ঘূর্ণনপ্রক্রিয়ায় তৈরি) ক্যানু, যার তলা গোলাকার (ফ্ল্যাট বটম), নিচে কোনো ‘কিল’ নেই (নৌকার নিচের স্থিতিশীল রেখা)। এতে রয়েছে জালের তৈরি আসন বা ওয়েবড সিট, অ্যাশ কাঠের ট্রাস, ওজন প্রায় ৭৫ পাউন্ড এবং সর্বোচ্চ বহনক্ষমতা প্রায় ৭৫০ পাউন্ড বা ৩৪০ কেজি।

এই ধরনের ক্যানু বিশেষভাবে আরামদায়ক ও হালকা হলেও, গোলাকার তলার কারণে ভারসাম্য হারিয়ে সহজেই উল্টে যেতে পারে—বিশেষ করে যদি যাত্রীদের ওজন বিভাজনে গরমিল থাকে বা হঠাৎ ঢেউ এসে পড়ে।

কেন ক্যানু উল্টে যায়?

ক্যানু দেখতে নিরীহ মনে হলেও এটি একটি ভারসাম্য-নির্ভর, অস্থির নৌযান। নিচে কয়েকটি সাধারণ কারণ:

কম ভারসাম্য (লো স্ট্যাবিলিটি): ক্যানুর ফ্ল্যাট এবং সরু তলদেশ সহজেই জলতলে ঢেউ বা নড়াচড়ার ফলে দুলে ওঠে। সামান্য ভারসাম্য হারালেই উল্টে যেতে পারে।

একপাশে ওজনের চাপে (আনইভেন ওয়েট ডিসট্রিবিউশন): যাত্রীদের বসার অবস্থান যদি সমান না হয়, বা কেউ হঠাৎ উঠে দাঁড়ান, তাহলে ওজন একদিকে চলে যায় এবং ক্যানু উল্টে যায়।

আবহাওয়া ও ঢেউ: হ্রদে হঠাৎ হাওয়া বা বড় ঢেউ এলে ক্যানু দ্রুত দুলতে শুরু করে। বিশেষ করে ওপেন হালকা কাঠামোর জন্য ক্যানুতে পানি ঢুকলে সেটা তলিয়ে যেতে পারে।

অভিজ্ঞতার অভাব: অনেকেই ক্যানু চালানো সহজ মনে করেন, কিন্তু প্যাডলিং বা বৈঠা দেয়ার কৌশল না জানলে অথবা কোন দিকে ভর দিলে কী ঘটে তা না বুঝলে উল্টে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

বহনক্ষমতার চেয়ে বেশি ওজন: প্রতিটি ক্যানুর একটি নির্দিষ্ট বোঝা বহনের ক্ষমতা থাকে। সেই সীমা ছাড়িয়ে গেলে নৌযান ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।

কেন্দ্রীভূত নিম্নাকর্ষণ না থাকা: ক্যানুতে যাত্রীদের ওজন নিচের দিকে না হলে (উদাহরণস্বরূপ দাঁড়িয়ে থাকলে) কেন্দ্রবিন্দু ওপর চলে যায় এবং উল্টে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

আমাদের অনেকের মধ্যেই একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে—সাঁতার জানি, লাইফ জ্যাকেটের কী দরকার? এই ধারণাই মারণ ফাঁদ।

সাঁতার শেখা জরুরি, কিন্তু সেটা লাইফ জ্যাকেটের বিকল্প নয়। ঠান্ডা পানির ধাক্কা, হঠাৎ প্যানিক, ঢেউ, বা নৌযান উল্টে যাওয়া—এই সব কিছু মিলিয়ে আপনি শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারেন। বহু অভিজ্ঞ সাঁতারুও এভাবে মারা গেছেন। কানাডার নৌ-নিরাপত্তা সংস্থা বলছে, প্রতি বছর যে শতাধিক নৌদুর্ঘটনায় প্রাণ যায়, তার প্রায় সবাই লাইফ জ্যাকেট না পরা ব্যক্তিরা। আর কানাডাতে হাজার হাজার লেক বা হ্রদ আছে। আছে লেক সুপিরিওরের মতন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিঠা পানির হ্রদ। দুর্ঘটনার দিন হ্রদের জলেও তাপমাত্রার পরিসংখ্যান পাওয়া গেল ৬২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ১৬.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।

পত্রিকা মারফত যতটুকু জানা গেল, মৃত ব্যক্তি দুজনই বাংলাদেশের বাসিন্দা এবং যে কোনো বাংলাদেশির জন্য এই তাপমাত্রা যথেষ্ট পরিমাণ শীতল। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির সাঁতারের দক্ষতার সঙ্গে প্রতিকূল আবহাওয়ায় অভিযোজিত হওয়ার সক্ষমতা বড় ব্যাপার। সারা বছর বাংলাদেশে থাকা যে কারও জন্যে তা কঠিন হতে পারে।

আপনি যদি কখনো ক্যানু, কায়াক বা প্যাডলবোর্ডে চড়ে থাকেন, আপনি জানেন এগুলো কীভাবে সামান্য ঢেউতেই ভারসাম্য হারায়। এগুলো মূলত বিনোদনধর্মী জলযান—তুলনামূলকভাবে হালকা ও অস্থির। আর এদের জন্য লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত, আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও।

আমি এই লেখা লিখছি একজন নাগরিক হিসেবে এবং একজন সচেতন ভ্রমণপ্রেমী হিসেবে। এই বার্তাটা শুধু কানাডার জন্য নয়, বাংলাদেশের মতো দেশেও যারা ছোট ট্রলারে, কাঠের নৌকায় প্রতিদিন পারাপার করেন তাদের জন্যও সমান প্রযোজ্য। আমাদের দেশে লাইফ জ্যাকেট নেই বলেই যেন কেউ পরে না—এটা কোনো যুক্তি নয়, এটা অবহেলা।

জীবন বাঁচানোর জন্য কোনো ‘কূল’ দেখানোর দরকার নেই। লাইফ জ্যাকেট পরা মানেই আপনি সচেতন, আপনি নিজেকে ও আপনার পরিবারকে গুরুত্ব দেন।

অনুরোধ, এই লেখাটা পড়ার পর আপনার পরবর্তী যেকোনো জলভ্রমণের সময়, লাইফ জ্যাকেট নিয়ে বের হবেন। এটা কোনো অপশন নয়—এটা আপনার জীবনরক্ষাকারী সঙ্গী।

একটি ছোট পদক্ষেপ নিতে পারেন আপনি, যাতে আপনার প্রিয়জনের কান্না না শুনতে হয় কাউকে। লাইফ জ্যাকেট পরুন। যে কোনো সময়, যে কোনো পানি, যে কোনো গন্তব্যে।

প্রকাশিত : বিডিনিউজ২৪.কম view this link
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২৫ সকাল ৮:৫২
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×