somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুনীর চৌধুরি ও কবর

২৫ শে মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের নাটক-সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কারিগর মুনীর চৌধুরী (জন্ম: ২৭ নভেম্বর ১৯২৫; মৃত্যু: ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১)। বিষয়-কাঠামো আর মঞ্চে পরিবেশনের কলা-কৌশলের দিক থেকে তাঁর নাটক স্বতন্ত্র। অল্পকাল ব্যবধানে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবার পর গোটা দুনিয়াব্যাপি যখন চিন্তার বিলোড়ন তৈরি হয়েছে শিল্প-সাহিত্যের উদার উঠানে তখন বাংলাদেশেও (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান) সে প্রবণতার প্রভাব ছায়া বিস্তার করেছে অনিবার্যভাবে। শিক্ষিত-সচেতন মানুস হিসেবে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী বিশ্বমননে স্নাত হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করবার সময থেকেই তিনি ঝুঁকে পড়েন নাটকের শিল্প-কৌশলের দিকে।
তাঁর প্রথম নাটক নওজোয়ান কবিতা মজলিস রচিত হয় ১৯৪৩ সালে। ১৯৪৬-এ লেখেন রাজার জন্মদিনে। ১৯৪৭-এর ভারতবিভাগের পর তিনি রেডিও কর্তৃপক্ষের আগ্রহে ও অনুরোধে বেতার-নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা টেলিভিশন থেকে প্রচারিত হয় চৌধুরীর একতালা-দোতালা নাটক। তাঁর নাটকে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার নগরকেন্দ্রিক জীবনপ্রবাহ এক কর্মচাঞ্চল্যের অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পেয়েছে। আর পেশাগতভাবে শিক্ষকতার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় শিক্ষার্থী-অধ্যাপক-প্রক্টর-হাউসটিউটর, সাংবাদিক-উকিল-পুলিশ-ডাক্তার-নেতা, রিক্সাওয়ালা-দোকানদার-অভিভাবক-প্রেমিকপ্রেমিকা প্রভৃতি চরিত্র তাঁর নাটকের ক্যানভাসে অতি সাবলীলতায় জায়গা করে নিয়েছে।
মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর, চিঠি প্রভৃতি নাটক সবিশেষ সাফল্য লাভ করলেও জনমানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও প্রশংসা পেয়েছে কবর নাটকটি। বিষয-ভাবনা এবং পরিবেশন-শৈলীর কারণেই সম্ভবত এটির প্রচার ও প্রসার অসামান্য। কবর গভীর জীবনবোধের আলোকে সজ্জিত একাঙ্গ নাটক। এ ধরনের নাটক অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের সৃষ্টি। পৃথিবীখ্যাত নাট্যনির্মাতা ইবসেনের সামাজিক-বাস্তবতাবোধ, বার্নার্ড শ-এর ব্যাঙ্গাত্মক জীবন-জিজ্ঞাসা, পিরান্দেলো-ব্রেখট-বেকেটের প্রগাঢ় শিল্পলগ্নতা আর মন্মথ রায়ের ভাষার গভীরতা প্রভৃতি অগ্রসর ভাবনা-প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুনীর চৌধুরী নির্মাণ করলেন বাংলা ভাষার আধুনিকতম নাটকের বারান্দা; যেখানে সহজ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে দেখে নেওয়া যায় জীবনের রূপ-নিবিড়তা ও গন্ধ-গভীরতা। মুনীর তাই সমকালের সহজ অনুভবের শিল্পকারিগর।
কবর নাট্যকারের দৃষ্টি-উন্মোচনকারী সৃষ্টি। এর প্রেক্ষাপট পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা-আন্দোলন। বিষয় এবং পরিবেশন-কৌশলের দিক থেকে নাটকটি গতানুগতিকতার বাইরে এক নবতর সংযোজন। জাতীয় চেতনার প্রতি প্রবল বিশ্বস্ততা আর মর্যাদা রক্ষায় প্রতিবাদ প্রকাশে এর ভূমিকা অপরিসীম। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কেবল উর্দুকে ঘোষণা করার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব-পাকিস্তানে প্রতিবাদের যে ঝড় সৃষ্টি হয়েছিল, তার সাহিত্যিক ভাষারূপ বর্তমান নাটক। ভাষা-আন্দোলনের স্বপক্ষে কাজ করার অপরাধে মুনীর চৌধুরীকে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫২-১৯৫৪ সময়ে জেলখানায় থাকা-কালে বামপন্থী বিপ্লবী রাজনীতিবিদ রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে, ১৯৫৩ সালে প্রথম ভাষাদিবস পালন উপলক্ষে পরিবেশনের জন্য তিনি রচনা করেন কবর নাটক। এবং এটি যথাসময়ে কারাকক্ষেই মঞ্চস্থ হয়।
আপাতভাবে ফরমায়েসি সৃষ্টি মনে হলেও এর কাঠামোয় রয়েছে শিল্পী মুনীরের মনে গেঁথে-থাকা অনুভবের প্রবল-প্রভাবি চিন্তার ছাপ। ভাষা-আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণে নিহতদের রাতারাতি কবর দেওয়ার জন্য, রাজনৈতিক হাঙ্গামা কৌশলে এড়ানোর জন্য, শাসকগোষ্ঠী ছিন্নভিন্ন মৃতদেহগুলিকে পুঁতে ফেলতে চাইলে ইসলামধর্মের রীতিবিরোধী বলে গোর-খুঁড়েরা আপত্তি তোলে; আর বারুদের গন্ধ থাকায় এ লাশ কবর দেওঅ উচিৎ হবে নবলে মত দেয় মুর্দা ফকির। এমতাবস্থায় বিপাকে পড়ে দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার এবং নেতা। পুলিশ-অফিসারের নির্মোহতা এবং নেতার অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত ভারসাম্যহীনতা ও ভীতির পরিবেশে নাটকের আবহ প্রবম্বিত হয়; লাশগুলি সমবেতভাবে প্রতিবাদ জানায়Ñ ‘আমরা কবরে যাবো না। আমরা বাঁচবো।’Ñ এই হলো কবর নাটকের মূল পরিসর। এই ক্যানভাসে নির্মিত হয় সংলাপ ও পরিবেশের সমূহ কলা-কৌশল। কাহিনিতে প্রবেশ করে পূর্বাপর আবহের আলো-আঁধার।
নাটকের আবহে লাশগুলি জীবিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কথোপকথনে তাদের অংশগ্রহণ আর তাদের প্রতিবাদের বাস্তব অবস্থা পাঠককে প্রকৃত ঘটনার কাছাকাছি নিয়ে দাঁড় করায়। নেতা ও পুলিশ-ইন্সপেক্টর তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করে, ভয় দেখায়, আস্বস্ত করতে চায়; কিন্তু তারা নাছোরবান্দা। কাহিনিটিতে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতিনিধিদের আচরণ এবং ভাষা-ঐতিহ্য-মর্যাদা রক্ষাপ্রত্যয়ী জনতা-প্রতিনিধির ভূমিকা চিত্রিত হয়েছে একটি সমাজ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তব পরিস্থিতির পেক্ষাপটে।
নামহীন নেতার নির্মমতা-বিশ্বাসঘাতকতা-মিথ্যাচারিতা আর ক্ষমতার প্রতি অপরিসীম লোভÑ এই কথামালা সাজানো হয়েছে তৎকালীন রাজনীতির নোংরা রূপ তুলে আনার প্রয়াসে। নেতার দমননীতির একটি ছবি এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারেÑ
‘পুঁতে ফেল। দশ-পনেরো বিশ-পঁচিশ হাতÑ যত নিচে পারো। একেবারে পাতাল পর্যন্ত খুঁড়তে বলে দাও। পাথর দিয়ে, মাটি দিয়ে, ভরাট করে গেঁথে ফেল। কোনদিন যেন আর ওপরে উঠতে না পারে। কেউ যেন টেনে ওপরে তুলতে না পারে, যেন চ্যাঁচাতে ভুলে যায়।’
প্রগতিশীল চিন্তার লালনকারী নাট্যকার মুনীর তাঁর নাটকে মানবতাবাদী ভাবনার প্রকাশ দেখাতে চেয়েছেন; পেরেছেনও। রক্ষণশীলতা আর প্রগতিশীলতার যে দ্বন্দ্ব, তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন আপন অনুভবের শক্তিতে। পরাক্রমশালী রাজনীতির দৌরাত্ম্য ও অসহায়তা এবং আদর্শবাদী চিন্তাধারার মাহাত্ম্য রচিত হয়েছে নাটকটির সংলাপের চমৎকারিত্বে ও আভিজাত্যে। রাজনৈতিক প্রতাপ, অহমিকা, জনগণের নাম করে নিজেদের উদরপুর্তি আর দায়িত্বের (ক্ষমতার নয়) অপপ্রয়োগ যে জাতিগতভাবে হীনমন্যতাকে লারন করে, তার বাস্তব চিত্র মুনীর নির্মাণ করেছেন। প্রসঙ্গত, সংলাপের অতি জরুরি অংশবিশেষ দেখে নেওয়া যাকÑ
“নেতা : দেখ ছেলে, আমার বয়স হয়েছে। তোমার মুরব্বিরাও আমাকে মানে। বহুকাল থেকে এ দেশের রাজনীতি আঙ্গুলে টিপে টিপে গড়েছি, শেপ দিয়েছি। কওমের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের, বলতে পার, আমিই একচ্ছত্র মালিক। কোটি কোটি লোক আমার হুকুমে ওঠে বসে।
মূর্তি : কবরে যাব না।
নেতা: আগে কথাটা ভালো করে শোন। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, শিক্ষিত ছেলে। চেষ্টা করলেই আমার কথা বুঝতে পারবে। বিশ্ববিদ্রালয়ের সব চেয়ে উঁচু ক্লাসে উঠেছ। অনেক কেতাব পড়েছ। তোমার মাথা আছে।
মূর্তি : ছিল। এখন নেই, খুলিই নেই। উড়ে গেছে। ভেতরে যা ছিল, রাস্তায় ছিটকে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
নেতা : জীবিত থাকতে তুমি দেশের আইন মানতে চাওনি। মরে গিয়ে তুমি এখন পরপারে কানুনকেও অবজ্ঞা করতে চাও। কম্যুনিজমের প্রেতাত্মা তোমাকে ভর করেছে, তাই মরে গিয়েও এখন তুমি কবরে যেতে চাও না। তোমার মত ছেলেরা দেশের মরণ ডেকে আনবে। সকল সর্বনাম না দেখে বুঝি কবরে গিয়েও শান্ত থাকতে পারছো না। তোমাকে দেশের নামে, কওমের নামে, দ্বীনের নামে যারা এখন মরেনি, তাদের নামে মিনতি করছিÑ তুমি যাও, যাও, যাও।
মূর্তি : আমি বাঁচবো।
নেতা : কি লাভ তোমার বেঁচে? অশান্তি ডেকে আনা ছাড়া তোমার বেঁচে কি লাভ? তুমি বেঁচে থাকলে বারবারদেশে আগুন জ্বলে উঠবে, সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার না করে সে আগুন নিভবে না। তার চেয়ে লক্ষী ছেলের মত কবরে চলে যাও। দেখবে দু’দিনেই সব শান্ত হয়ে যাবে। দেশের সুখ ফিরে আসবে। (মূর্তি মাথা নাড়ে) আমি ওয়াদা করছি তোমাদের দাবী অক্ষরে অক্ষরে আমরা মিটিয়ে দেবো। তোমার নামে মনুমেন্ট গড়ে দেবো। তোমার দাবী এ্যাসেম্বীলিতে পাশ করিয়ে নেবো। দেশ জোড়া তোমার জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করবো। যা বলতে তাই করবো।”
প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহের যে কোনো সমাপ্তি নেই; ব্যর্থতা নেই, সে সত্য আঁকতে ভোলেননি নাট্যকার। প্রগতির পথে, সত্যের পথে অন্যানেয়র বিপরীতে যারা শ্রম ও চিন্তা বিনিয়োগ করে, তাদেরকে শোষণ-প্রত্যাশি সরকার বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল শৃঙ্খলা-বিনষ্টকালি হিসেবে আখ্যায়িত করতে চায়। আর এর অপরপীঠের সত্য হলো কালে কালে এই বিপ্লবীরাই জাতির ভাগ্যগঠনে কাজ করেছেÑ কখনো নীরবে, কখনো প্রকাশ্যে। কিন্তু, ইতিহাস থেকে পাঠ নিলে দেখা যায়, বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ দমনের জন্য সরকার প্রায়শই ভ্রান্তনীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। ডিভাইড অ্যান্ড রুলস নীতিতে বিভেদ সৃষ্টি করে, নানান রকম প্রলোভন দেখিয়ে শান্তিকামী ও অধিকার-রক্ষায় প্রত্যয়ী মানুষকে প্রতিহত করতে চায় কুট-কৌশলী শাসকদল।
নাটকটিকে বর্ণিত কেরানি মূর্তির অভিজ্ঞতা থেকে পাঠক জানতে পারেন, নেতা বারবার ওয়াদা ভঙ্গ করেন; কথা দিয়ে কথা রাখেন না। মিথ্যাবাদী। দাবী আদায়ের কর্মসূচিকে নস্যাৎ করার জন্য নেতা অনেক প্রতিশ্র“তি দিয়ে পরবর্তীকালে সে কথা ভুলে যান।Ñ এ চিত্রাবলির মাধ্যমে নাট্যকার জাতীয় নেতাদের চরিত্রবৈশিষ্ট্য আঁকতে চেয়েছেন। আর পলিটিক্যাল পার্টির নেতৃবৃন্দের অভিপ্রায়-স্বার্থপরতা-নির্মমতা বাস্তবায়নের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির সদস্যরা কীভাবে নির্লজ্জের মতো সহায়তা করে, তার স্বরূপ অঙ্কনের জন্য পুলিশ ইন্সপেক্টর হাফিজের ভূমিকা উপস্থাপন করেছেন। সরকারের ভক্ত-দায়িত্বশীল কর্মচারী হিসেবে, হঠকারিতা-কৌশলে পারদর্শী অফিসার রূপে পুলিশের আত্মকেন্দ্রিকতা ও তোষামোদি মানসিকতাকে প্রকাশ করেছেন নাট্যকার। হাফিজের অভিব্যক্তিÑ
‘পাকিস্তান হবার পর আমরা পেটি-অফিসাররাই কেবল কিছু পেলাম না। বৃটিশ অঅমলেও সমাজে মিশতে পারিনি। পাকিস্তানের জন্য এত ফাইট করে, আমাদের এখনও সেই দশা। যদি আপনারাও আমাদের দিকে ফিরে না তাকান আমরা বাঁচবো কি করে? আমাদের ত কোন রাজনীতি নেই স্যার! সরকারই মা-বাপ। যখন যে দল হুকুমত চালায় তার হুকুমই তামিল করি।’
আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের ছলনা-নিবেদন, মিথ্যাচার, আর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সাথে ব্যক্তিত্বহীন আচরণকে পরিবেশন করতে গিয়ে লেখক হাস্য-কৌতুকের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। নাটকের গতি আর রস নির্মাণে মুনীর চৌধুরী অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বলেই সিরিয়াস বিষয়কে হালকাভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। প্রশাসনের মানবিক দুর্বলতা আর শোষন-পীড়ন নীতির প্রতি নাট্যকারের স্পষ্ট ইঙ্গিত কাহিনির গতিময়তাকে ত্বরান্বিত করেছে বলে ধারণা করা যায়। এ নাটকে মূর্দা ফকির চরিত্রটির মধ্য দিয়ে মুনীর চৌধুরী প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপরীতে সত্য জীবনবোধকে আলোকিত করতে চেয়েছেন। প্রতীকি অর্থে ফকির জাতির জাগ্রত বিবেক। অমানবিকতার প্রবল প্রবাহে লোকটি মানবিকতা-নামক প্রবণতার একাকি ধারক ও বাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। হাফিজের জবানিতে নাট্যকার জানাচ্ছেন ফকিরের অবস্থান ও চরিত্র-স্বরূপÑ
‘লোকটা এমনিতে ভাল লেখা-পড়া জানে। ভাল আলেম। গ্রামের স্কুলে মাস্টারী করত। তেতাল্লিশে দুর্ভিক্ষে চোখের সামনে ছেলে-মেয়ে-মা-বৌকে মরতে দেখেছে। কিন্তু কাউকে কবরে যেতে দেখেনি। মুর্দাগুলো পচেছে। শকুনের খুবলে দিয়েছে। রাতের বেলায় শেয়াল এসে টেনে নিয়ে গেছে। সেই থেকে পাগল। গোরস্থান থেকে কিছুতেই নড়তে চায় না। বলে, মরে গেলে কেউ যদি কবর না দেয়। মরার সময় হলে, কাছাকাছি থাকব, চট করে যাতে কবরে ঢুকে পড়তে পারি। বড় ট্র্যাজিক স্যার।’
রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে অস্থির এই সমাজ-ব্যবস্থায় সর্বহারা মানুষগুলি যে জীবনবাদী-জাগরণী আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে, তারই বাস্তব রূপায়ন এই ফকির। না-পাবার যাতনা আর অসম রাষ্ট্রকাঠামোর নির্মম শিকার সে। নিরাপত্তা নামক বিষয়াবলির সাথে, আন্তরিকতা-সহমর্মিতা নামক বোধের সাথে তার পরিচয় নেই। সে কেবল দেখেছে বর্বরতা-প্রতিহিংসা আর অসহযোগিতার প্রবল ছোবল।
বাহ্যিক-বিশ্লেষণে মনে হতে পারে, নাটকটির ঘটনা-পরম্পরা ও চিত্রায়ন চিরন্তন কোনো অনুভবের সত্যকে হয়তো ধারণ করে না; সমসাময়িক রাজনৈতিক সংকটকে কেবল উপস্থাপন করে। কিন্তু বাস্তবে, বিশ্ব-পরিসরে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক অনিরাপত্তার পেক্ষাপটে এই নাটকটির প্রাসঙ্গিকতার কথা অস্বীকার করা চলে না। প্রতিপাদ্য বিষয় ও রচনাকুশলতার কিছুটা তারতম্য থাকলেও আমেরিকান নাট্যকার ওৎরিহ ঝযধ-িএর ইঁৎু ঞযব উবধফ এবং উৎপল দত্তের অমৃত অতীত নাটকের সাথে মিল রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ঢাকায় অবস্থানরত কয়েকজন প্রগতিশীল আমেরিকান সৈনিকের সাথে মুনীর চৌধুরীর আলাপ হয়েছিল; সে সুবাদে আমেরিকান সাহিত্যপাঠে তিনি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ইঁৎু ঞযব উবধফ –এর বিষয়-ভাবনা হয়তো অবচেতনভাবে তাঁকে প্রভাবিত করে থাকবে। কবর রচনা করবার সময় তিনি বিশেষভাবে মাতৃভাষা ও নিজভূমির প্রতি মানুষের মমতাকে রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। চিন্তার দৃঢ়তার ক্ষেত্রে মুনীরের নাট্যভাবনা অবশ্যই বিশেষত্বের দাবি রাখে।
রাষ্ট্রীয়-সামাজিক বিশেষ প্রেক্ষাপটে মানবিকতা আর অস্তিত্ব-সচেতনতার আবেদন আঁকতে গিয়ে নাট্যকার সাধারণ মানুষের আর্তিকেও সামনে হাজির করেছেন। অতিপ্রাকৃত পরিবেশ পেিবশনের ক্ষেত্রে তিনি শেক্সপীয়রের এবং সংলাপ-রচনায় বার্নাড শ-এর সৃজনরীতি কছুটা হলেও প্রয়োগ করেছেন। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিপরীতে মানবিক এবং অধিকারবোধের সত্যভাষণের আবেদন সৃষ্টিতে এই ইঙ্গিতধর্মী নাটকটি বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ সংযোজন। আমাদের মূল্যবোধ আর ইতিবাচক মনোবৃত্তিকে জাগ্রত রাখার জন্য, ব্যক্তিক-সামষ্টিক অগ্রসরচিন্তাকে সামান্য হলেও পরিসর তৈরি করে দেবার জন্য, কবর নামক এই গণনাটকটির আবেদন অনস্বীকার্য।এই লিঙ্ক পাওয়া
Click This Link
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×