আসাদ সাহেব প্রাণপণে দৌড়াচ্ছেন।বামনাকৃতির কয়েকজন মানুষ ছুড়ি হাতে তার পিছনে ছুটে আসছে।তিনিও সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছেন।হঠাতই হোঁচট খেয়ে,মুখ থুবড়ে পড়লেন রাস্তায়।ছুড়ি হাতে একজন তার বুকের উপর উঠে বসলো।
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন তিনি।ঘেমে নেয়ে একাকার।পাশ ফিরে দেখেন নীলুফা ঘুমাচ্ছে।বিকট শব্দে নাক ডাকছে।যেনো,গন্ডারের সাইনাস হয়েছে।আসাদ সাহেবের এই মুহূর্তে ইচ্ছে হচ্ছে,পাশবালিশটা তুলে নিয়ে নীলুফার মুখে চেপে ধরতে।খেল খতম!
বিছানা থেকে নেমে,ফ্রিজ খুলে,পানি বের করলেন।বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরালেন।প্রায় প্রতি রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখছেন।একই স্বপ্ন।ভালো একজন হুজুর-ফকির না দেখালেই নয়।তাবিজ-কবচ কিছু একটা নিলে যদি কাজ হয়! রফিককে জিজ্ঞেস করতে হবে।কর্মঠ ছেলে।
পাশের রুমে বাতি জ্বলছে।তিনি উঁকি দিলেন। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে।ভয় পায় বলে বাতি জ্বালিয়েই ঘুমায়।বাম হাতটা কপালের উপর।কব্জির কাছে গাঢ় কালো একটা জন্ম দাগ।মেয়ে দেখতে হয়েছে আসাদ সাহেবের মায়ের মতো।অপূর্ব সুন্দরী!সে সাথে মেধাবীও।গতো বছর,ক্লাশ ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে।ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি।আহা,কি মায়া! বাকি রাতটা আসাদ সাহেব বারন্দায় চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিলেন।
কোতোয়ালি থানার অফিস কক্ষে,টেবিলের উপর পা তুলে,দিয়াশলাই কাঠি দিয়ে মনের সুখে কান চুলকাচ্ছেন আসাদ সাহেব।গতো দুই বছর ধরে তিনি এ থানার দারোগা হিসেবে আছেন।সেকেন্ড অফিসার রফিককে পাঠিয়েছেন,স্থানীয় কমিশনার কার্যালয়ে।কমিশনার সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন।অবশ্য তিনি নিজেও যেতে পারতেন!ইচ্ছে করেই তাকে পাঠিয়েছেন। রফিক এই থানায় নতুন। ছেলে ভালো।তাকে একেবারে পীর মানে!
-কি খবর রফিক? ঘটনা কি?
-ঘটনা স্যার তেমন কিছুনা, কমিশনার সাহেবের একটা ছোট ভাই আছে। নাম আশফাক। কমিশনার সাহেবের বড় আদরের।
-তোমার সমস্যা কি জানো? তুমি কথা বেশি প্যাঁচাও।ডিমের ল্যালফা অংশ বাদ দিয়ে কুসুমে আসো।
-জ্বি স্যার। কমিশনার সাহেবের ভাই একটু দুষ্টামি করেছে।যুবক ছেলে তো।দুষ্টামির বয়স।
-দুষ্টামির ধরণ কি ?
-কমিশনার সাহেবের বাড়ির ঠিক উল্টো পাশের টিনশেডে,একটা পরিবার থাকে।একটা মেয়ে আছে। ক্লাশ সিক্সে পড়ে।বাবা গার্মেন্টসে কাজ করে।
কমিশনার সাহেবের ভাই আর তার কয়েকজন বন্ধু মিলে মেয়েটাকে আজ সকালে তুলে এনেছে।
-সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! কমিশনার সাহেবের বক্তব্য কি ?
-বলেছে,আজকের আর কালকের দিনটা আটকে রেখে ছেড়ে দিবে।অল্প বয়স,ঝোঁকের বসে তুলে এনেছে।এই আর কি!
-আর কিছু বলে নাই ?
-আর এই খামটা দিয়েছে।আসাদ সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরলো রফিক। আরো বলেছে,মেয়ের বাবা-মা কেও আসলে,ব্যাপারটা আপনার নিজের মতো করে দেখতে।আসাদ সাহেব খামের মুখটা অল্প ফাঁক করলেন,এক হাজার টাকার নোটের দুটো বান্ডেল!
-ঠিক আছে,ঠিক আছে। আমার হয়েছে যতো যন্ত্রণা।এরা তো খাম ধরিয়ে দিয়েই খালাশ।প্রেস,ইলেকট্রনিক মিডিয়া,সাংবাদিক,ডিবি,এই-সেই আরো কতো কিছু সামলাতে হয়!আর এই নাও,এখানে বিষ হাজার টাকা আছে।আরেকটা কথা,মুখ যতো কম চালাবা,নিজের জন্য ততোই ভালো। তুমি কথা বেশি বলো। তবে তোমাকে আমি বিশেষ স্নেহ করি।
-জ্বি স্যার। দোয়া রাখবেন।
আসাদ সাহেব আবারো কান খোঁচানোয় মনোযোগ দিলেন। কিছুক্ষন বাদেই জীর্ণশীর্ণ বস্ত্রের, কৃশকায় এক লোক থানায় এসে উপস্থিত হলেন। পরক্ষণেই বোঝা গেলো ইনি মেয়েটির বাবা।
-স্যার,সকাল থেইক্কা আমার মাইয়্যাডার খোঁজ পাইতাছিনা।সবাই কইতাছে, কমিশনারের ভাই আমার মাইয়্যাডারে তুইলা নিয়া গেছে। আপনেরা কিছু একটা করেন।
-আপনি দেখছেন তুলে নিতে? দেখেন নাই। শোনা কথায় কান দিবেন না।দেখেন,কোনো ভাতার কিংবা নাগরের সাথে ভেগে গেছে কিনা!
-না স্যার না,আমার মাইয়্যাটা খুবই ভালা।রাস্তা দিয়ে যখন হাটে মাথা তুইলাও তাকায় না।স্কুলে যায়,পড়াশোনা করে,বলেই সে হাওমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
-দেখেন,কান্নাকাটির যায়গা এটা না, মেয়ে কার সাথে গেছে খোঁজ করেন।আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি খোঁজ করেন।অকাজ শেষ হলে আপনা আপনিই ফেরত আসবে।আপনাদের মতো পরিবারের মেয়েদের খুব ভালো করে চেনা আছে।পনেরো বছর পুলিশে চাকুরি করি।কতো হরিদাস পাল দেখলাম,আপনারা তো সেখানে চ্যাঁটের বাল!
এখানে ঝামেলা না করে বাড়ি যান। আমার জরুরি অপারেশনে বের হতে হবে।এই রফিক,গাড়ি বের করতে বলো তো!
কোনোএক বর্ষার দুপুর।ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে, আরামে চোখ লেগে এসেছে আসাদ সাহেবের।এমন সময় থানায় খবর এলো,পাশের এলাকায় পরিত্যক্ত খালের ধারে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছে।সেকেন্ড অফিসার ছুটিতে।একরকম বাধ্য হয়েই,আরামকে হারাম করে গাড়ি নিয়ে বের হতে হলো আসাদ সাহেবকে।মিনিট দশেকের রাস্তা।ভিড় ঠেলে কাছে গেলেন।ছিন্নবিন্ন স্কুল ড্রেস পড়ুয়া কিশোরী।মুখ দেখা যাচ্ছনা।কেও একজন রাস্তা থেকে কুঁড়িয়েই, একটা ময়লা কাপড় দিয়ে, শরীর আর মুখটা কোনো রকম ঢেকে দিয়েছে।ঢেকে দেয়া শরীরের এক পাশ দিয়ে,বাম হাতটা বের হয়ে আছে। যার কব্জির কাছে গাঢ় কালো একটা দাগ!
-নাকিব
১-৮-২০১৭