'ডাস্টবিন পেরোলেই আমার বাসা!' কথাটা মুখ থেকে যেন ব্যাঙের লাফ দেয়ার মতো হঠাৎ বেরিয়ে গেলো! নিজের থাকার জায়গার বর্ণনা মানুষ এভাবে দেয়?! সারা দিন কাজের পেছনে দৌড়ে পানিশূন্যতায় ভুগতে থাকলে মাথা ঠিক কাজ করে না- প্রমানিত!
রবিন বুঝে গেলো, আজ বিকেলে তার মাথা আর মুখ যে একই তালে এগোচ্ছে না!
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত পোহায়!
অফিসের জুনিয়রতম অফিসার হয়েছে বলেই হয়তো অনুরোধে ছোট বড় ঢেঁকি রবিনকে গিলতে হয় মাঝে মধ্যেই! এটা ঠিক করে দাও- ওটা সিধে করে দাও ধরণের অনুরোধ তো আছেই, বসের মায়ের ওষুধও ডিসপেনসারী থেকে কিনে আনতে পাঠানো হয় রবিনকে। আর ও সবই তেতো ঢোক গিলে মেনে নেয়!
এভাবেই অফিসের সময়টা কাটে; শুধু গত সপ্তাহের বৃহষ্পতিবার একটা ছোট ঘটনা ঘটেছিলো যেটা রবিনকে এই সপ্তাহেও মনে মনে দহন দিয়ে যাচ্ছিলো!
শিকদার সাহেব, রবিনের বস, পঞ্চম বারের মতো ওকে পাঠিয়েছিলেন ডিসপেনসারীতে! একই সময় এক ছ্যাঁচড়া কলিগ, কলিম মুন্সী, রবিনের উপর নিজের কাজটা চাপিয়ে দিয়ে পরকীয়া করতে বেরিয়ে গেছে। কাজটাও আবার টাইম বাঁধা। গোপনীয়তাটুকু রাখতে গিয়ে রবিন বসকে বলে ফেলেছে, না স্যার, তেমন কাজের চাপ নেই। মানে, নিচে নেমে ওষুধ কিনতে পাঠালে কাজে কোনও সমস্যা হবে না।
কিন্তু ভুলটা হলো ডিসপেনসারীতেই, প্রত্যেকবারের মতো আট দশটা ওষুধের নাম আর কোম্পানী মিলিয়ে কিনতে গিয়ে এক পাতা ক্যাপসুল কিনে ফেললো যার মেয়াদ মাস খানেক আগেই ফুরিয়ে গেছে।
সোজা অফিসে ফিরে বসের রুমে ঢুকে ওষুধগুলো প্রেসক্রিপশানের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ে শোনালো শিকদার সাহেবকে। খুঁতখুতে মানুষ, প্রত্যেকবার রবিন ওষুধ আনার পরে এই কাজটুকু করিয়ে নেন তিনি। রবিন ওষুধ মিলিয়ে খুচরো টাকার হিসেবটা বুঝিয়ে দিতে যাবে যখন, তখনই ওর খেয়াল হলো রুমে তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব।
কি করবে বুঝে ওঠার আগেই তৃতীয় ব্যক্তিটি ক্যাপসুলের পাতার দিকে আঙুল তাক করে বলে উঠলো, ওগুলো একটু দেখি? ক্যাপসুলগুলো হাতে নিয়ে একটু পাল্টে দেখেই শিকদার সাহেবের দিকে ফিরে তৃতীয় ব্যক্তি বললো, 'বাবা, এগুলো ডেট এক্সপায়ার্ড!'
শিকদার সাহেব কোনও উত্তর না দিয়ে সরাসরি রবিনের দিকে তাকালেন, তার দৃষ্টি আস্তে আস্তে তীক্ষ্ন হয়ে উঠলো রাগে! রবিন এই অফিসে জয়েন করার পর থেকে এমনটা কখনও হয়নি! মেঘ গর্জনের মতো স্বরে আদেশ করলেন, যাও, এখনই এগুলো পাল্টে নিয়ে এসো!
তৃতীয় ব্যক্তির মুখের দিকে এতক্ষণেও তাকানো হয়নি রবিনের, ক্যাপসুলের পাতাটা ফেরত নিতে গিয়ে দেখলো! অপমানটা যেনো হঠাৎ করে দশগুণ হয়ে গেলো রবিনের কাছে- এরকম রূপসী কারও সামনে, বা, নিজের মেয়ের সামনে বস এতোটা উচু-গলা করতে পারলেন! না কি ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, যে, তার মেয়েটার দিকে নজর দিলে মেঘ শুধু গর্জাবেই না, বাজও পড়বে!
ফের অফিস থেকে ডিসপেনসারী রাস্তাটুকু রবিন শুধু সংকুচিতই হলো একটু একটু করে।
সেই ঘটনার পর থেকে রবিন ভীষণ ভালো হয়ে গেলো, রিসেপশনিস্ট আপুর সাথেও জোকস করার স্পৃহা হারিয়ে ফেললো যেন!
কিন্তু নতুন সপ্তাহ ঘোরার পর, শিকদার সাহেব একদিন ডেকে বললেন, আমার গাড়িটা নিয়ে বাসায় দিয়ে এসো, ড্রাইভার যেনো সাবধানে চালায়। রবিনের কারণ জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি, সে সোজা আমিন ড্রাইভারকে ডেকে কোথায় যেতে হবে বলে গাড়িতে উঠে পড়েছে।
বাসার গ্যারেজে ঢোকার পর আমিন জানতে চাইলো, ছার, গাড়ি কই যাইবো? রবিন এই প্রশ্নের উত্তর জানে না, কিন্তু ড্রাইভারের কাছে ছোট হওয়া চলে না। তাই বললো, ওয়েট করো একটু, শিকদার স্যারকে ফোন করছি। ফোন রবিন করবে না, একটুও দেরী না করে বেরিয়ে অফিসের রাস্তা ধরলো।
মিনিট পাঁচেক হাটার পর, রবিনের আনমন ছুটে গেলো তৃতীয় ব্যক্তির ডাকে, এই যে মিস্টার রবিন, কোথায় যাচ্ছেন? গাড়িটা রাস্তার পাশে এসেই থেমেছে, আমিন ড্রাইভার একটু মুচকি মুচকি হাসছেও যেন! সেটা অগ্রাহ্য করে রবিন বললো, অফিসে যাচ্ছি!
-গাড়িতে উঠুন, অফিস পর্যন্ত যাবেন।
-না, আমার বাসায় একটু কাজ আছে!
-আচ্ছা, আপনার বাসাটা কোথায়!
-ঐ যে সামনের ডাস্টবিনটা পেরোলেই আমার বাসা!