somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মীননাথ ও নাথর্ধম

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মীননাথ ও নাথধর্ম
হাসান মেহেদী

এ কথা ভাবতে একটু আলাদা রকমের ভালো লাগে যে, বাংলা ভাষার প্রথম কবি আমাদের বরিশালের লোক ছিলেন এবং তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না, প্রায় একজন নবীও ছিলেন। কারণ, তিনি পৃথিবীতে একটি নতুন ধর্ম এনেছিলেন। এই কবি ও প্রায়-নবীর নাম মীননাথ। তবে তার নাম অনেক রূপে লিখিত আছে: মৎস্যেন্দ্রনাথ, মচ্ছেন্দ্রনাথ ইত্যাদি। তার ধর্মের নামও অনেক: নাথপন্থা, নাথধর্ম, সহজিয়া ইত্যাদি। মীননাথের জন্মস্থান চন্দ্রদ্বীপ এবং জীবনের অনেকটা সময় চন্দ্রদ্বীপেই তিনি অতিবাহিত করেছেন। এ মর্মে রায় পাওয়া যায় ‘কৌলজ্ঞান নির্ণয়’ গ্রন্থে এবং জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও ওয়াকিল আহমদ এর বিশ্লেষণে।
মীননাথের প্রবর্তিত ধর্মটি বেশ মজার। এ ধর্মে ঈশ্বর নেই। বাঙালির ধর্মের ইতিহাসে রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য। এক বা একাধিক অলৌকিক শক্তি বা সত্তা ও তাদের আরাধনা এই অনেক বৈচিত্র্যের মাঝে এক মোটামুটি সাধারণ রূপ। কিন্তু অলৌকিক শক্তি বা ঈশ্বরের ধারণার উল্টোরূপ কিছু মতও এখানে ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। মীননাথের নাথধর্ম তার অনুরূপ। নাথধর্ম নিরীশ্বর অর্থাৎ এখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। এ ধর্মের সাধনায় কেন্দ্রে থাকে একজন গুরু বা সিদ্ধা। তাই এ ধর্ম গুরুবাদী। গুরুবাদী এই ধর্মের আদি ও প্রধান গুরু বা সিদ্ধা মীননাথ নিজেই। তার যোগ্য শিষ্য গোরক্ষনাথের প্রচেষ্টায় এই ধর্মমত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ নেপাল, সিকিম পর্যন্ত এ ধর্ম প্রচার লাভ করে।
নাথ পন্থের উৎপত্তি নিয়ে বিশ্লেষকগণ বিভিন্ন মত প্রদান করেন। নিম্নে কিছু মত উল্লেখ করা গেল-
“নাথপন্থা যে বৌদ্ধ মন্ত্রযান হইতে উদ্ভূত বা প্রভাবিত তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। এই নাথ পন্থা বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখার শূন্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত”।
ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাঙলা সাহিত্য কথা(১ম খন্ড), পৃ: ১৭,২১,২৮
“নবম,দশম এবং একাদশ খ্রিষ্ট শতাব্দে বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায়ের শাখা বিশেষের সহিত শৈব ধর্মের যোগ ও তন্ত্রাচার মিলিত হইয়া নাথ পন্থের সৃষ্টি করিয়াছিল”।
শ্রী নলিনী কান্ত ভট্টশালী, ‘মীনচেতন’ ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
“[যাহারা] নিরঞ্জনপন্থী, কনফট, মচ্ছেন্দ্রী, সারঙ্গীহার, কানিপা ইত্যাদি নামে আছেন তাহারা [সন্ন্যাসীরা] নাথপন্থেরই পথিক, ...নাথপন্থের উৎপত্তি ও বিকাশ যে বাঙ্গলা কেন্দ্রিক পূর্ব ভারতে ঘটিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ করিবার কিছুই নাই”।
ড. সুকুমার সেন, প্রাগুক্ত, পৃ:১-ক
“ব্রাহ্মণ্য-শৈব ও বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্রমত, এর আধুনিক নাম নাথপন্থ”।
ড. আহমদ শরীফ, বাঙলার সূফী সাধনা ও সূফী সাহিত্য, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
“নাথপন্থা মূলত আদিম মৈথুন তত্ত্ব ও টোটেম বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত এবং মূলত এটি অনার্য দর্শন। সাংখ্য ও যোগ এই দুই শাস্ত্র ও পদ্ধতি যে আদিম অনার্য দর্শন ও ধর্ম তা আজকাল আর কেউ অস্বীকার করেনা। এই শাস্ত্র অস্টিক কিংবা বাঙলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিরাত জাতির মনন উদ্ভূত। ... বাঙালির শিব ও ধর্মঠাকুর অনার্য মানস প্রসূত। তেমনই অনাদি এবং আদিনাথও কিরাত জাতির দান। ভোট-চীনার[মঙ্গোলীয়] নত> নথ> নাত> নাথ থেকেই যে “নাথ” গৃহীত তা আজ গবেষণার অপেক্ষা রাখে না”।
[কিরাত জাতি : এরা অনার্য ও শিকারজীবি জাতি ছিল। শিকারের জন্য তীর ধনুক ব্যবহার করত। এরা মূলত সাহসী হিংস্র জীবজন্তু বধ করে আহার করত]
ড. আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য;বাঙালীর মৌল ধর্ম, পৃ:৭৯

নাথপন্থা নিরীশ্বর, ধর্মমঙ্গল, শূন্যপুরানের ধর্মঠাকুর আর নাথ ঐতিহ্যের নিরঞ্জন আদিনাথ অভিন্ন। ধর্মঠাকুরের পুরানকথা আর নিরঞ্জনের সৃষ্টি বর্ণনা একই। নাথদের আদিনাথ শিব। জৈন ধর্মের আদিনাথও সম্ভবত শিব, জৈন ধর্মের প্রচারক মহাবীর নির্গ্রন্থ নাথ। নিগন্থ>নিগ্রন্থ>বেদবিরোধী।
মীননাথের জন্মস্থান চন্দ্রদ্বীপ, বর্তমান বরিশাল। কেউ কেউ মীননাথের জন্ম সন্দীপ বলে প্রায়ই ভুল করে থাকেন, কারন দূর অতীতে সন্দীপ চন্দ্রদ্বীপের ভেতরেই ছিল। মীননাথের শিষ্য গোরক্ষনাথের জন্ম পূর্ব বঙ্গ বলে পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে নাথপন্থার অনুসারীরা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মে ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। তাতী শ্রেণীর বৌদ্ধরাই প্রধানত নাথপন্থী। ইসলাম ধর্মে যারা জোলা ‘‍‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌জুলহা’ নামে পরিচিত তারা আদিতে নাথপন্থী ছিল। বাংলাদেশে পেশা ও জীবিকার ধরণ হিসেবে নাথপন্থীদের তিনটি শ্রেণী আছে:
ক. সাধারণ যোগী, খ. জাত যোগী, ও গ. সন্ন্যাসী যোগী।
প্রথম শ্রেণী গৃহ যোগী। তারা কৃষি ও তন্তুবায়ের কাজ করে। জাত যোগীরা ভবঘুরে ও সাপুড়ে। সন্ন্যাসী যোগীরা প্রধানত ভিক্ষা করে। অলাবু বা নারিকেলের মালা তাদের ভিক্ষার পাত্র। যোগীরা ‘অচল’ নামক এক যষ্ঠি ব্যবহার করে। ঢাকা ও ত্রিপুরার যোগীরা প্রধানত বস্ত্র উৎপাদন করে। রংপুরের চুনতি যোগীরা চুন উৎপাদন করে। পানাতি যোগীরা পান উৎপাদন করে। পূর্ববঙ্গে ‘মৎস্য’ ও ‘একাদশী’ নামে দুটি যোগী সম্প্রদায় আছে তারা পরস্পরের অন্ন গ্রহণ করে না অন্তর্বিবাহ করে না; ত্রিপুরা, নোয়াখালী ও বিক্রমপুরে মৎস্য যোগী ও ঢাকায় একাদশী যোগী বসবাস করে। কুমিল্লার ময়নামতি পাহাড় সংলগ্ন ঘোষনগর গ্রামে যোগীদের বসবাস আছে। ১৮৮১ সালে বঙ্গদেশে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ যোগীর বসবাস ছিল। ১৯১০ সালে একমাত্র ত্রিপুরাতে ৬৮,০০০ যোগী ছিল। শ্রীমতি কল্যানী মল্লিক “নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দর্শন ও সাধন প্রণালী” গ্রন্থে বলেছেন, পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশে সাড়ে চার লক্ষ যোগী আছে। এদের এক তৃতীয়াংশ পশ্চিমবঙ্গ এবং দুই তৃতীয়াংশ পূর্ববঙ্গে বসবাস করে। ভাবতে ভালো লাগে যে, এরা সবাই আমাদের বরিশালের মীননাথের ধর্মের অনুসারী।
দশম শতকের শেষভাগ থেকে কোন কোন গুরু বা সিদ্ধা এমন ছিলেন যিনি শৈব ও বৌদ্ধ এই দুই পদ্ধতিরই আচার্য ছিলেন। অর্থাৎ তিনি আচার্য হিসেবে যেমন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কর্তৃক মান্য হতেন তেমনি শৈব সম্প্রদায় কর্তৃক মান্য হতেন। আমরা তিনজন প্রধান সিদ্ধার কথা জানি যারা উভয় সম্প্রদায় কর্তৃক সম্মানিত হয়েছেন। এঁরা তিনজন হলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, জালন্দর ও কানহ। মোটসিদ্ধার সংখ্যা বলা হয় চৌরাশি। Albert Grunwedel তিব্বতী সূত্রে প্রাপ্ত চৌরাশি জন মহাসিদ্ধার নাম পরিচয় সংকলন করেছেন।।
চৌরাশি সংখ্যাটি বিভিন্ন কারণে নাথপন্থায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চৌরাশি আঙুল পরিমিত কায়ার সাধনে সিদ্ধ হলে নাথপন্থায় তাকে সিদ্ধা বলে। বৌদ্ধপূর্ব যুগের আজীবিকদের বিশ্বাস ছিল যে চৌরাশি লক্ষ স্তর বা অবস্থা (জন্মান্তর) অতিক্রম করে আত্মা মনুষ্য দেহে স্থিতি পায়। মৈত্রায়নী উপনিষদে চৌরাশি হাজার বার জন্মের বা জন্মান্তরের উল্লেখ আছে। কোন কোন তন্ত্রে ও পুরাণে বিভিন্ন অবস্থায় চৌরাশি লক্ষ যোগী ও জন্মের কথা আছে। বৌদ্ধদের “ধর্মখন্ধ” [ধর্মস্কন্ধ] এর সংখ্যা চৌরাশী হাজার। যোগ ও তন্ত্রের গ্রন্থে যোগাসনের ব্যায়াম চর্যাপদ্ধতি চৌরাশি প্রকার। কানফাটা যোগীদের জপমালায় রয়েছে চৌরাশি বিটি বা দানা। স্কন্ধপুরাণে রয়েছে চৌরাশি প্রকার শিবলিঙ্গের বর্ণনা।
নাথপন্থ দুই ভাগে বিভক্ত। মীননাথ-গোরক্ষনাথ কাহিনতত্ত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশুদ্ধ নাথপন্থা। আর হাড়িফা- কানুফার তত্ত্ব ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কামাচারী তান্ত্রিক সাধনা যার ফলে গড়ে উঠেছে সহজিয়া মতবাদী গৃহযোগী সম্প্রদায়। এরা বিশুদ্ধ নাথপন্থী নয়। এদেরকে বলা হয় ‘ফা’পন্থী।
মীননাথের নাথ ধর্মে একটি সৃষ্টিতত্ত্বও রয়েছে। এতে বলা হয়েছে জলময় অন্ধকার অবস্থা থেকেই অনাদিশক্তি গড়ে ওঠে এবং তার ইচ্ছা থেকে কায়াধারী আদিনাথ ও নিরঞ্জনের উদ্ভব। আদি শক্তির ঘর্ম থেকে জল, জল থেকে কূর্ম [কুমির] তারপর হংস, উলুক এবং তারপর হলো বাসুকির [সাপ] জন্ম। আদিনাথের মন থেকে আদি শক্তির উদ্ভব। এই আদ্যাশক্তিই জন্ম দিলেন শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মার। আবার শৈব শক্তি থেকে দেব ও মানবের সৃষ্টি।
নাথ সাধনা প্রণালীতে বলা হয় দেহের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নাড়ী। তার মধ্যে তিনটি প্রধান ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না এদেরকে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী এই তিনটি মহানদী কল্পনা করা হলে অন্যগুলো উপনদী। এগুলো দিয়ে শুক্র, রজঃ, নীর, ক্ষীর ও রক্ত প্রবাহমান। এ প্রবাহ বায়ুচালিত। অতএব নাথ সাধনা প্রণালীতে বলা হয় বায়ু নিয়ন্ত্রণের শক্তি অর্জন করলেই দেহের উপর কর্তৃত্ব জন্মায়।
এ সাধনায় মজার প্রসঙ্গ হলো রমণ বা রতি বিষয়ক। এ সাধনা প্রণালীতে বলা হয় প্রশ্বাস হচ্ছে রেচক, শ্বাস হচ্ছে পূরক এবং দম অবরুদ্ধ করে রাখার নাম কুম্ভক। ইড়া নাড়ীতে পূরক ও পিঙ্গলায় রেচক করতে হয়। কুম্ভক বা দম ধরে রাখার সময়ের দৈর্ঘ্যই সাধকের শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ। এর নাম প্রাণায়াম। এমন অবস্থায় দেহ হয় ইচ্ছাধীন তখন যে-শুক্রের স্খলনে নতুন জীবন সৃষ্টি হয় সেই শুক্রকে নাড়ীর মাধ্যমে উর্ধ্বে সঞ্চালিত করা হয়। তার পতন ও স্খলন রোধ করলেই শক্তি হয় সংরক্ষিত। সেই সঞ্চিত শুক্র শরীরে জোয়ারের জলের মতো ইচ্ছানুরূপ প্রবাহমান রেখে স্থায়ী রমন সুখ অনুভব করাও সম্ভব। মূলাধার [গুহ্য ও জনন ইন্দ্রিয়ের মধ্যস্থ] থেকে শুক্রকে নাড়ীর মাধ্যমে উর্ধ্বে উত্তোলন করে ললাট দেশে সঞ্চিত করে রাখলেই ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব। এটাই সিদ্ধি সাধনার তিনটি স্তর - প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধি।
প্রবর্তাবস্থায় যোগী সুষুম্না-মুখে সঞ্চিত শুক্ররাশি ইড়া মার্গে মস্তিষ্কে চালিত করার প্রয়াস পায়। এতে সাফল্য ঘটলে যোগী প্রেমের কল্পনারূপ অমৃতধারায় স্নাত হয়। শৃঙ্গারের রতি স্থির করলে তথা বিন্দু ধারণে সমর্থ হলে যোগী সঠিক নামে অভিহিত হয়। তখন মস্তিষ্ক সঞ্চিত শুক্ররাশিকে পিঙ্গলা পথে চালিত করে সুষুম্নামুখে আনা হয়। ফলে বিন্দু আজ্ঞাচক্র থেকে মূলাধার অবাধ স্নায়ুপথে জোয়ারের জলের মতো উচ্ছসিত প্রবাহ পায়। এতে প্রেমানন্দে দেহ প্লাবিত হয়। এর নাম তারুণ্যামৃত ধারার স্নান। এর ফলে সাধক ইচ্ছাশক্তি দ্বারা দেহ-মন নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায় এবং ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী পথে শুক্র ইচ্ছামত চালু রেখে অজরামরের মতো বোধগত সামরস্যজাত পরামনন্দ বা সহজানন্দ উপভোগ করতে থাকে। এরই নাম লাবণ্যামৃত পারাবারের স্নান। ইহা কায়াসাধন বা দেহসাধনের অতি প্রাচীন শাস্ত্র, তত্ত্ব ও পদ্ধতি। নেপাল তিব্বত ছাড়া সমতলভূমির মধ্যে বৌদ্ধযুগে কেবল বাংলাদেশে এর বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই এ অঞ্চলে সহজিয়া ও নাথপন্থার উদ্ভব।
নাথপন্থায় মহাজ্ঞানতত্ত্ব নামে একটি তত্ত্ব রয়েছে। মহাজ্ঞান হল “কায়া” বা যোগ সাধনার দ্বারা মরণশীল মানবদেহের পরিবর্তন এনে দীর্ঘজীবন তথা অজরত্ব ও অমরত্ব লাভ করা। নিরীশ্বরবাদী এই ধর্ম কোন প্রকার অলৌকিক ঐশী শক্তিতে বিশ্বাস করে না। যোগলদ্ধ জ্ঞান দ্বারা সমাধিস্থ হওয়ার মধ্যে ঈশ্বরের স্থান নেই। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মে নিরীশ্বরবাদের চেতনার সাথে এর মিল আছে। এই মহাজ্ঞানতত্ত্বের সাধনার দ্বারা সাধক কিছু অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়; যেমন: ক. নিজ দেহের আকার পরিবর্তন, খ. শূন্যপথে বিচরণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ মুহূর্তে অতিক্রম, গ. ভক্তকে সন্তানলাভের বর প্রদান, ঘ. মন্ত্রবলে মৃত ব্যক্তিকে জীবিতকরণ এবং এমনকি কাটা মুন্ডু জোড়াদান, ঙ. মন্ত্রবলে ভূত-ভবিষ্যতের জ্ঞানলাভ ইত্যাদি।
নাথপন্থায় সাধন বিষয়ে কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। এই সাধনপন্থায় একজন শিষ্য ছয়মাস সংযমাদি পালন করার পর গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে যোগী হয়। দীক্ষিত যোগী গেরুয়া বস্ত্র পরিধান করে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ও উপবীত ধারণ করে। দুই কানে কুন্ডুল পরে। ডান বাহুতে যোনিলিঙ্গের চিহ্ন এবং হাতে পিতল, রূপা, লোহা বা গন্ডারের চর্মের বলয় পারে। দীক্ষা গ্রহণ কালে মস্তক মুন্ডন করলেও পরে জটা ধারণ করতে পারে। কানের উপাস্থি পর্যন্ত দীর্ঘ ছিদ্র করে বলে নাথপন্থীরা ‘কানফাটা যোগী’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
দীক্ষাগ্রহণের পর যোগী আজীবন ব্রহ্মচর্যা অথবা গার্হস্থ্যধর্ম পালন করতে পারে। মৃত্যুর পর যোগীর মৃত দেহ ধ্যানাবস্থায় আসন বদ্ধ করে সমাধিস্থ করা হয়। তবে ‘গোপীচন্দ্রের গানে’ মাণিকচন্দ্রের মৃত্যু হলে তাকে হিন্দু রীতিতে দাহ করা হয়। ময়নামতী সহমরণে চিতায় আরোহণ করলেও অগ্নি তাকে দাহ করতে পারেনি কারণ মহাজ্ঞানের প্রভাবে তিনি অমরত্বের অধিকারিনী ছিলেন।
মোহসেন ফানী’র বর্ননায় অমৃতকুন্ডকে গোরক্ষ শিষ্যদের শাস্ত্র বলে উল্লেখ করে। সেই হিসেবে নাথশাস্ত্র হিসেবে অর্মতকুন্ডকে ধরা যায়। এই গ্রন্থটি সম্ভবত প্রাকৃতে কিংবা অবহট্টে রচিত ছিল। চৌদ্দ শতকে মিশরের সূফী মুহ্ম্মাদ আল মিশরী অমৃতকুন্ডের উল্লেখ করেছেন। মুছলিম জগতের সর্বত্র জনপ্রিয় হয়েছিল এই গ্রন্থ। অমৃত কুন্ড কামরূপের গ্রন্থ কামরূপ বাসী ভোজবর্মন ও অম্ভরানাথের সাহায্যে প্রাপ্ত ও অনুদিত, এতে অনুমান করা চলে যোগী ব্রাহ্মন নন বৌদ্ধ। অমৃতকুন্ডের দশটি অধ্যায় এবং পঞ্চাশটি শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে বিষয়বস্তু। এই গ্রন্থটির সূচি দেখলে নাথপন্থদের সাধনা প্রনালীর সাথে পরিচিত হওয়া যাবে।
১। জীবসৃষ্টি ২। জীবসৃষ্টি রহস্য ৩। মন ও তার তাৎর্পয ৪। অনুশীলন ও তার পদ্ধতি ৫। শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ৬। বিন্দু ধারন ৭। চিত্ত চাঞ্চল্য ৮। মৃত্যুলক্ষণ ৯। ইন্দ্রিয় ও মনজাত জগতের বর্ণনা।
আর্যধর্মের সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদিতায় আমাদের মীননাথের এই সাধন-ধর্মের অবসান হয়। বিলুপ্তিলগ্নে নিম্নবিত্তের নাথপন্থীরা স্বধর্ম রক্ষার প্রয়াসে বাহ্যত ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র ও সমাজ অঙ্গীকার করে ব্রাহ্মণ্য সমাজে আশ্রিত হয়ে আত্মরক্ষা করে। এ সময়েই প্রজ্ঞা- উপায়ে, বজ্র- তারায়, করুণা- শূন্যতায়, নাথ- নিরঞ্জনে ও আদিনাথ-আদ্যশক্তির [প্রকৃতি] বদলে হরগৌরী নাম বরণ করে। ক্রমে আদিনাথ- চন্দ্রনাথে, বৈদ্যনাথ- শিবে, তারা -চন্ডীতে, লোকনাথ- অবলোকিতেশ্বর বিষ্ণুতে, জাঙ্গুলী- মনসায়, বৎসলা- বাসুলীতে রূপান্তরিত হয়ে নিচুজাত হিন্দুর দেবতা রূপে গৃহীত হয়। ষোড়শ শতকের অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে এসব দেবতা অধিকাংশই অশ্রদ্ধায় অপসৃত হয়।
তাই আজ আমরা মীননাথকে ধর্মপ্রবর্তকের মর্যাদায় যতোটা দেখি তার চেয়ে অনেক বেশি কবির মর্যাদায় দেখতে চাই। মনে মনে স্মরণে পড়ে ষোড়শ শতকের ইংরেজ কবি ও সমালোচক স্যার ফিলিপ সিডনির ভাবনা- poet মানেই তো prophet
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৫৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমাধান দিন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩১




সকালে কন্যা বলল তার কলিগরা ছবি দিচ্ছে রিকশাবিহীন রাস্তায় শিশু আর গার্জেনরা পায়ে হেটে যাচ্ছে । একটু বাদেই আবাসিক মোড় থেকে মিছিলের আওয়াজ । আজ রিকশাযাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ পোয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×