somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মূল্যবোধ ছুঁড়ে ফেলা সমাজ...

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ৯:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৩৫ বছর আগে আমেরিকায় একটি সামাজিক বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো। একটি দামি গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে এক শিশুকে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েজ বলতো, ‘আমরা বিশ্বের সবচেয়ে অতৃপ্ত জাতি। নিজেদের ব্যবহৃত পণ্যাদি ডাস্টবিনে যেমন ফেলে দিতে পারি, তেমনি নিজেদের স্বার্থে প্রিয় সন্তানকেও রাস্তায় ছুড়ে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করি না। আমরা ফেলে দেওয়ার সমাজ। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি।’ আমরাও কি তবে দিনে দিনে সেই পথে চলতে শুরু করেছি?

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের কেজাউড়া গ্রামের আব্দুল বাছিরের কোলেই হত্যা করা হয় তার শিশু সন্তান তুহিন হাসানকে।গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই পাঁচ বছরের শিশু তুহিন হাসানকে তার বাবা, চাচা ও চাচাতো ভাই মিলে খুন করেন। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সুনামগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. খালেদ মিয়ার আদালতে তুহিনের চাচাতো ভাই শাহরিয়ার ও চাচা নাসির উদ্দিন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এরআগে ৫ অক্টোবর ২০১৯ সালে চ্যানেল২৪-এর সংবাদে প্রচারিত হয় বিবাহ বিচ্ছেদের পর চার বছরের শিশু সন্তান আরদিতকে মা-বাবা কেউই নিতে চাননি। ফরিদপুরে জুয়ার বোর্ডে মাত্র তিন হাজার টাকায় নিজের শিশুসন্তানকে বিক্রি করে দেন বাবা। (এসএ টিভি, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনমূলক অনুষ্ঠান ‘খোঁজ’, পর্ব ২৫)।

গত ১৬ অক্টোবর বার্তা২৪.কম-এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ‘পারিবারিক বিরোধের বলি শিশুরা, ৯ মাসে ৩২০ হত্যা’। এছাড়া প্রায় সংবাদপত্রের পাতায় স্থান পাচ্ছে নবজাতক হত্যার সংবাদ। ১৯ মে, ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে যে, ‘চলতি মাসের প্রথম পনের দিনে মোট আটাশজন নবজাতককে ডাস্টবিনে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৭ জন ছিল মৃত, বাকি আটজন জীবিত’। সংবাদের ধরন অনুযায়ী উল্লিখিত সব খবরই দুঃসংবাদ। অবশ্য দুঃসংবাদেরও রকমফের থাকে; কোনোটা ব্যক্তিগত, কোনোটা সমষ্টিগত।

দুই দশক আগেও আমাদের পারিবারিক বন্ধন ছিল অটুট। অনেক চড়াই-উৎরায় পেরিয়েও এই সমাজের মানুষই সেটা ধরে রেখেছিল। অর্থনৈতিক সূচকের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল না মিলেয়ে বরং উল্টো পথে হাঁটছে সমাজ। পরিবার ভাঙছে, দুর্নীতি বাড়ছে, কমছে মূল্যবোধ। দিনে দিনে আমরা নাম লেখাচ্ছি পরিত্যাগের সমাজে। যার সবচেয়ে বড় চর্চা হচ্ছে বাবা-মা ও সন্তানের মানবিক সম্পর্কে। ক্রমেই ভেঙে পড়ছে পারিবারিক বন্ধন। সন্তান যেমন নির্দ্বিধায় বাবা-মাকে পাঠাচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে, বাবা-মাও তেমনি সন্তানকে ছুড়ে ফেলছেন। এটি থেকে খুব নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পরিবারে ফাটল ধরেছে। দিন দিন মানুষের প্রতি মানুষের অনাস্থা বাড়ছে। সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে শব্দহীন ভাবে। এটাকে কি সমাজের অধঃপতন বলা চলে? প্রশ্ন করার কে আছে যে উত্তর আসবে! আর এসব তো কোনও প্রশ্ন নয়, এ যেন আর্তনাদ!

এক আশ্চর্য সময়ে আছি আমরা। মানুষের সব কাজের পেছনে লোভ কিংবা স্বার্থপরতা কাজ করছে। আর সেই লোভ কিংবা স্বার্থপরতার বলি হচ্ছে শিশুরা। দেশের মানুষের আয় বেড়েছে, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, আত্মহত্যার হার বেড়েছে, বেড়েছে যৌন হয়রানি, সামাজিক অস্থিরতা, হতাশা, কালো টাকা, আইন ও নৈতিকতা বহির্ভূত কার্যকলাপ। পরিবার কিংবা সামাজিক অনুশাসন সমাজকে আর আয়ত্তে রাখতে পারছে না। অর্থবিত্ত কিংবা ক্ষমতার নেশায় জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে। কোথাও কোনও জবাবদিহিতা নেই। আইডেনটিটি, প্রেজেন্টেশন, সেলফ এক্সপ্রেশন, ইন্টারপারসোনাল রিলেশন, সোশিওকালচারাল রোল—কোনও কিছুই মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আধুনিকতা নামক অদ্ভুত এক রোগের মোড়কে ঢাকা পড়েছে সমাজ। সমাজের ওপরটা চাকচিক্যময় জৌলুসে ভরা, ভেতরটা অন্তঃসারশূন্য।

সামাজিক বৈষম্য মানুষকে ক্রমাগত হীন, ক্ষুদ্র করে তুলেছে। মানুষের চিন্তা ও কাজে সমাজের প্রভাব থাকে সবচেয়ে বেশি। সমাজে যে বৈষম্য বিদ্যমান, তা বোঝার জন্য মাইক্রোস্কোপ বা টেলিস্কোপের দরকার নেই। ব্যক্তিগত ও জাতীয় আচরণে মানুষের মনস্তত্ত্বের যে সংকীর্ণতা প্রকাশ পাচ্ছে, সেটুকুই যথেষ্ট। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ যখন সূচকের সর্বনিম্ন স্তর থেকেও অনেক নিচে নেমে যায়, তখন সামাজিক দায়িত্বশীলতা আশা করা নেহাতই মূর্খতা। ‘সামাজিক সত্তা ও স্বার্থ বনাম ব্যক্তি সত্তা ও স্বার্থ’-এর বিচারে ব্যক্তি স্বার্থটাই এখন মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। অবিরাম মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সময় এখন। ব্যক্তি চরিত্রগুলো একটা নির্দিষ্ট ছকে বন্দি, মানুষ এখন এমন জীবনমান গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে, যা সময়ের অবক্ষয়িত মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খেয়ে যাচ্ছে। কঠোর পরিশ্রম আর অসুখী উপার্জনের এই সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অনিবার্য অস্তিত্ব বিদ্যমান।

সমাজ কাজ আসলে প্রহরীর ভূমিকা পালন করে। সমাজ যখন নিষ্ক্রিয় বা নেতিবাচক ভূমিকা নেয়, তখন বুঝতে হবে অন্য কোনও শক্তি কাজ করছে। সমস্যা সমাধানের একটা উপায় হচ্ছে চারপাশের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। আইন করে কি সব অপরাধ দমন করা যায়? আইন থাকলে তার ফাঁক ফোকরও থাকে। তাই প্রয়োজন সমাজের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। প্রতিটি মানুষকে হতে হবে সচেতন। আবেগ থাকা দোষের কিছু নয়। তবে, তা যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। আধুনিক প্রজন্মের কাছে ‘অর্থহীন’ পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে আরও একবার ঝালিয়ে নিয়ে চর্চা করার সময় এসেছে।

সন্তানের দায়িত্ব যেমন সমাজের, তেমনটা রাষ্ট্রেও। রাষ্ট্র আমাদের প্রাইভেট লাইফের সঙ্গে ক্লোজলি রিলেটেড। আমরা একটা বানানো পৃথিবীতে বাস করছি। বানানো সরকার, বানানো খবর, বানানো প্রথা, বানানো উন্নয়ন সূচকে। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা রাখছেন নৈতিক উন্নয়নে তার 'টিকিটি'র দেখা মিলছে না। উন্নয়নের যে দেখা আমরা সংখ্যাতত্ত্বে পাই কিংবা রাজনৈতিক মঞ্চে থেকে বাতাসের ইথারে ভেসে আসা কথাগুলো বাস্তবে দেখা দেয় না। বাস্তবে আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যেখানে রয়েছে অনিরাপত্তা অনিরাপদ জীবন এবং প্রতিদিনকার উদ্বিগ্নতা। মানুষের মধ্যে বিনয়, মমতা, সহমর্মিতা এসবই দূর্লভ এখন। চরিত্র গঠন, আত্মিক উন্নয়নের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার নেই। আত্মকেন্দ্রিক এই সময়ে পৃথিবীর কোথাও যদি ক্ষমার অযোগ্য কিছু ঘটতে থাকে, তাহলে মানুষের তা জানা উচিত, তা নিয়ে ভাবা উচিত এবং পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করা উচিত। গায়ের জামাটা যদি ময়লা হয়, তবে দোষ জামার নয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:২৮
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×