সেই স্কুল জীবন থেকে শুরু।
সরল যত কঠিন-ই হোক না কেন, তার উত্তর হবে শূন্য নাহয় এক। যে করেই হোক, গোঁজামিল দিয়ে তারে গোল্লা বানাইতে হবে।
ফিজিক্স প্র্যাকটিকালে 'g' এর মান দেড়শো আসছে?? কোন সমস্যা নাই, একটা জিরো গুম করে উলটা হিসাব মেরে তারে সাড়ে দশ বানানো দুই মিনিটের কাজ।
গ্রাফ পেপারের ডাবল পয়েন্টেড বিন্দু, ভুলে যাওয়া মুখস্ত অঙ্কের মাঝে হঠাৎ "দেওয়া আছে" কিংবা "আমরা জানি" বসিয়ে পৃষ্ঠা শেষ করা আজো বাংলার একবিংশ শতাব্দীর ছাত্রদের সবচেয়ে প্রিয় কাজ।
সুরেশ খাঁটি সরিষার তেল খুব যত্ন করে বাঁশে মালিশ করার পর বানরটাকে ছেড়ে দেয়া হতো আমাদের পাটিগণিতের বাঁশবাগানে। প্রতি মিনিটে ৩ মিটার ওঠার পর বেচারা ১ মিটার পিছলে যায়। সেটা নাহয় হলো, কিন্তু এই সংকটময় ক্যালকুলেশনে বরাবরের মতই আবেগপ্রবণ হয়ে যেতাম। অতঃপর ২০ মিটার বাঁশে উঠতে কত সময় লাগবে তা বের করতে গিয়ে কলমের পশ্চাদ্দেশে নির্মম কিছু কামড়ের পর যেই উত্তরটা আসতো (অবশ্যই ঘণ্টা এককে!!) তা জানতে পারলে স্বয়ং বানর পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে উদ্যত হতো!!
পারমুটেশন-কম্বিনেশন আমরা শিখি ইন্টারে এসে। পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যার একটা সুন্দর পরিবারকে দুইজনের কম্বিনেশনে ফেললে কতরকম হতে পারে দেখা যাক।
১) পিতা-মাতা ২) পিতা-পুত্র ৩) পিতা-কন্যা ৪) মাতা-কন্যা ৫) মাতা-পুত্র
অথচ এতগুলা অপশন বাদ দিয়ে আমাদের কোমলমতি গণিত-জীবন পিতা আর পুত্রের অভিশাপেই জর্জরিত এখনও। বিশ্বাস করেন, পিতার বয়স পুত্রের বয়সের যত গুণই হোক, অথবা তাদের বয়সের সমষ্টি যতই হোক, আমাদের কখনই কিছু যেত আসতো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না অঙ্কের উত্তরে পুত্রের বর্তমান বয়স পিতার বর্তমান বয়সের কয়েকগুণ বেশি আসতো।
আর তারপরই হতো অমর গোঁজামিল তত্ত্বের অবতারণা!!
তবে হ্যাঁ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে নারী-জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার যে অপচেষ্টা থেকে মাতা ও কন্যা আমাদের গণিতশাস্ত্রে আজো অবহেলিত, তা রোকেয়া-পরবর্তী যুগ থেকে আজও নারীদের মাঝে জাগরণ সৃষ্টিতে ব্যর্থ। কিন্তু আমার বিশ্বাস, নায়লা নাঈম-পরবর্তী যুগ অবশ্যই এগিয়ে আসবে এদিকটায়।
কেমিস্ট্রি ল্যাবে টাইট্রেশন করে ঘনমাত্রা বের করতে হতো। কপার সালফেট না কি জানি একটা। এক দানা, দুই দানা করে ওজন নিয়ে, ডিসটিল্ড ওয়াটার মেশাতে হয়। অতঃপর ব্যুরেটের নলে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে এক-দুই ফোঁটা করে ফেলতে হয় বিকারে। ফেলতে ফেলতে আমরা যখন ধৈর্যের চরম সীমায়, বিকারের দ্রবণ তখন উত্তেজনার শীর্ষে উঠে ফর্সা হতে শুরু করে মাত্র।
এরপর সততার সাথে এক্সপেরিমেন্ট করার মহান ব্রত নিয়ে আমাদের হিসাব নিকাশ শুরু হয়, কিন্তু ল্যাব এসিস্টেন্টকে নানারকম তেল মারার পর দেখা গেলো, এরোর আসে তিনশ পার্সেন্টের মতন।
নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ অন্তর্দ্বন্দ্ব চলে।
ব্যুরেট থেকে দ্রবণ না ফেলে কেউ কেউ অন্যত্র থেকে দ্রবণ ফেলার ইচ্ছা পোষণ করে। কেউ কেউ আত্মবিশ্বাসের সাথে জানায় যে, ডিসটিল্ড ওয়াটার-এর বদলে মূত্রবিসর্জন করে এক্সপেরিমেন্ট করলেও নাকি এরচেয়ে কম এরোর আসতো!!
যাইহোক, আরো দুই-তিনবার নানাভাবে এক্সপেরিমেন্ট করার পরও কোনওভাবেই দুইশ পার্সেন্টের কম এরোর আনা গেলো না।
এখন একটাই উপায়। কেমিক্যাল গোঁজামিল।
আগে ক্যালকুলেটরে হিসাব করে যতটুকু লাগে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে স্যার আসলে ফর্সা পানির মত একটা দ্রবণ তৈরি করে দেখাতে হবে। কাজ খুব বেশি না, কিন্তু রসময় গুপ্তের রস-আহরণে অভ্যস্ত হলেও রাসায়নিক রস-আহরণে অপারগ আমাদের এছাড়া আর কী-ই বা করার থাকে ঐসব মুহূর্তে?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নটরডেমের ছাত্রদের অন্যান্য দোষগুণ বাদ দিলেও, শুধুমাত্র গোঁজামিল দিয়ে দুনিয়াদারি মিলিয়ে ফেলার জন্য আলাদা একটা সুনাম আছে। ফিজিক্স প্র্যাকটিকাল আমাদের শুরুই হতো পিছন দিক থেকে। এই স্মার্ট গোঁজামিলের নাম ‘ব্যাক-ক্যালকুলেশন’। কতটুকু দূরে প্রতিবিম্ব হবে, কতটুকু তাপ লাগবে, কত ওহম রেজিস্টেন্স লাগবে- এইসব হিসাব হতো কাগজে; তারপর সরল মুখে অসহায় একটা ভাব ফুটিয়ে ঊনিশ-বিশ করে যন্ত্রপাতি ঠিক করা শুরু করতাম।
ম্যাথের প্রশ্নে কিছু একটা প্রমাণ আসলো, কেমনে করতে হবে কোনও আইডিয়াই নেই। অথচ পাশ-ফেল নিয়ে তুমুল টানাটানি চলার আশঙ্কা।
বিসমিল্লাহ বলে উপরে কিছু জায়গা রেখে খাতার নিচে প্রশ্নের লাইনটা তুলতাম। তারপর নিচ থেকে উপরের দিকে অজানা যাত্রা।
তুমুল অনিশ্চয়তা আর অ্যাডভেঞ্চারের পর এইরকম ক্ষেত্রে অঙ্ক মিলে যাওয়ার সুখ যে কি জিনিস, তা কেবল সৃজনশীল-গোঁজামিলকারীরাই জানে।
তবে হ্যাঁ, আমরা আমজনতা, গোঁজামিল কিংবা খোঁজা-মিল সবই আমাদের জন্য যায়েজ। কিন্তু তাই বলে মার্কোনী গোঁজামিল দিয়ে যেভাবে নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেলো সেটা কিন্তু মানা যায় না। আমাদের জগদীশচন্দ্র বসুর তৈরি করা মাইক্রোওয়েভ ট্রান্সমিশনের কোহেরার দিয়ে হুট করেই ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের পেটেন্ট করে ফেললো ইতালীয়ান লোকটা।
কি অসীম ক্ষমতা, তাইনা? বিশ্ব কাঁপানো নোবেল পুরষ্কার থেকে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের নো-বল পুরস্কার, গোঁজামিল দিয়েই তো চলছে সব!!