আজ ২৫ শে মার্চ সেই ভয়াল কালোরাত্রি । পাকিস্তান হানাদার বাহিনী স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত নিরস্ত্র বাঙালির উপর ইতিহাসের বিভীষিকাময় গণহত্যা চালায় । পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের এই গণহত্যা অভিযানের নাম দিয়েছিলেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’ । ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরের বেসামরিক মানুষের উপর তারা এই বর্বরোচিত আক্রমণ চালায় ।
আমার আজকের লেখাটায় মুলত আমি ২৫ শে মার্চের সেই রাতে আমার মেহেরপুর জেলায় কি ঘটেছিল তা উল্লেখ করার দুঃসাহস করবো , ৭১ এর সময় যেহেতু বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা ছিল তাই আলোচনার সূত্রে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গার প্রসঙ্গও আসবে । আমি যেসব তথ্য তুলে ধরবো এ লেখায় তা মুলত পত্রিকা, বই, ব্লগ পড়ে জানা তাই তথ্য সম্পর্কিত অভিযোগ থাকতেই পারে । আপনারা আমার দেয়া তথ্য ভুল ধরিয়ে দিলে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো । আল্লাহ’র নামে শুরু করলাম ......
২৫ শে মার্চের ভয়াল সেই গণহত্যার খবর মুহূর্তেই মেহেরপুরে পৌঁছে যায় । প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নুরুল হকের মাধ্যমে মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরীর কাছে সর্বপ্রথম খবর পোঁছে যায় । ১৪ অক্টোবর, ১৯৭৩ সালে মহকুমা প্রশাসক এক সাক্ষাৎকারে বলেন-
' ২৫ শে মার্চ রাতে নুরুল হক এমপি, আমাকে টেলিফোনে জানালেন যে, ঢাকায় পাকবাহিনী শহরে বের হয়ে পড়েছে এবং জনগণের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে । আমি তাকে অবিলম্বে আমার বাসায় আসতে অনুরোধ করি । অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে, ঢাকা টেলিফোন এক্সচেন্স কুষ্টিয়াকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানিয়েছে এবং কুষ্টিয়া এক্সচেন্স মেহেরপুরে এই খবর জানিয়েছে ।’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ৯ম খণ্ড পেজ-৩৫৩]
এ খবর পাবার পর মহকুমা প্রশাসক জাতীয় পরিষদ সদস্য মোঃ সালাউদ্দিন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দদের জানান । সবাই মেহেরপুর থানায় এসে ওয়্যারলেসের সাহায্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের যোগাযোগের চেষ্টা করেন । অপারেটর সামাদ বহুকষ্টে একবার সংযোগ স্থাপন করতে পারলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে ভেসে আসে ‘ Movement start’ । এরপর আর যোগাযোগ সম্ভব হয় নি ।
অন্যান্য শহরের মতো মেহেরপুর মহকুমার জেলাশহর কুষ্টিয়া তে যশোর সেনানিবাসের ২৭ তম বেলুচ রেজিমেন্টের ১৪৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য কুষ্টিয়ার এসে পৌঁছায় ।
সেই রাতেই মেহেরপুরবাসিকে মাইকিং করে পাকিস্তান সৈন্য কর্তৃক কুষ্টিয়া আক্রমণের খবর জানিয়ে দেয়া হয় এই প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি শাহজাহান খান বিশু । এছাড়া সে রাতে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ইসমাইল হোসেন, সাবঃ রেজিস্টার আবু বক্কর কে সাথে নিয়ে গাংনী এসে আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে জরুরী মিটিং করেন এবং আনসার কম্যান্ডার আলতাফ হোসেন ও আবুল কাসেম কে খলিসাকুন্ডি ব্রিজ অচল করে দেবার নির্দেশ দেন । এছাড়াও ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগ সে রাতেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের সমস্ত প্রস্তুতি নেন ।মূলত সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য যোগাযোগ বাবস্থা বিচ্ছিন্ন করেন নেতা কর্মীরা । পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগকারি মহকুমা প্রশাসক এক সাক্ষাৎকারে বলেন-
‘ ২৫ শে মার্চ রাত মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা পাকা সড়কে গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরি করা হয় এবং মেহেরপুরকে চুয়াডাঙ্গার সাথে বিচ্ছিন্ন করা হয় । মেহেরপুর-কুষ্টিয়া রাস্তায় খলিসাকুন্ডি বাঁধের পুল ভেঙ্গে চুরে দেয়া হল । একদল যুবক এই পুলটা ভেঙ্গে দিয়েছিল । ’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস , ৯ম খণ্ড, পেজ-৩৫৪]
২৫ শে মার্চ সেই রাতে শুরুমাত্র মিটিং করেই মুক্তিকামীরা থেমে থাকে নি গ্রামে গ্রামে ঘুরে সামরিক আয়োজনেও প্রস্তুতি নিয়েছিল । আনসার- মুজাহিদের লোকজন একত্রিত করেন । মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহি চৌধুরী বলেন-
“ মেহেরপুর আনসার কম্যান্ডার কে আমি আদেশ দিই ২৬ শে মার্চের মধ্যে মেহেরপুর মহকুমার সমস্ত আনসার ও মুজাহিদকে একত্রিত করার জন্য ।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস , ৯ম খণ্ড, পেজ-৩৫৪]
মেহেরপুরের মানুষ যুদ্ধকালিন সব প্রস্তুতি সেই রাতেই সম্পূর্ণ করে ফেলেন জ্বালানি তেলও সংগ্রহ করেন করিমপুর থেকে ।
২৬ শে মার্চ সকাল । চারিদিকে লাশের গন্ধ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে । সকাল হবার অনেক আগেই মেহেরপুর এবং গাংনীতে মানুষের অভূতপূর্ব প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যায় । সবার চোখে-মুখে অজানা শঙ্কা এবং কৌতূহল । সবাই ব্যক্তিস্বার্থ তুচ্ছ করে ছুটে এসেছেন দেশের মুক্তির জন্য । গ্রাম থেকে খবর পেয়ে আনসার-মুজাহিদের সদস্যরাও ইতিমধ্যে ছুটে এসেছে । সবাই দেশের স্বার্থে সেচ্ছাসেবক হবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে ।
২৫ শে মার্চ রাতে মেহেরপুর থানা ওয়্যারলেসে “Movement Start” যে সংক্ষিপ্ত তথ্য পৌঁছালেও । সেই রাতেই চুয়াডাঙ্গা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক অ্যাড ইউনুস সাহেবের কাছে ইপিআর ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বানীটি পৌঁছেছিল -
"This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh where ever , you might be and with whatever you have. To resist the occupation army to the last. Your fight must go on until the last solder of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. Allah will help us. Joy Bangla.”
সারাদেশের মতো মেহেরপুরের মুক্তিকামী মানুষও সেদিন চুপ থাকেন নি দেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের আন্দলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করে । কৃতজ্ঞতা জানায় ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ বীরাঙ্গনার প্রতি ।
জয় বাংলা ।