ঢাকা শহরে যারা দীর্ঘদিন ধরে আছে তাদের কাছে জ্যাম অতি সাধারণ ব্যাপার । জ্যামে দুই ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া তাদের কাছে অতি সাধারণ ব্যাপারে । আমার নিজের কাছেও এটা অতি সাধারণ ব্যাপারই ছিল ! জ্যামে বসে বেশির ভাগ সময়ই আমি বই পড়তাম নয়তো মোবাইলে কোন লেখা লিখতাম । আমার প্রথম ব্লগ জীবনের প্রায় সকল লেখাই জ্যামে বসে মোবাইলের নোটপ্যাডে লেখা । সেই লেখা তারপর পিসিতে নিয়ে পোস্ট করতাম । কিন্তু সাইকেল টা কেনার পর আর সেই সব কাজ করা হয় না । প্রথমে আমি সাইকেলটা কিনেছিলাম মূলত শখ করেই । ছুটির দিন গুলোতে এদিক ওদিক সাইকেল চালিয়ে যাবো এটাই ছিল মূলত প্লান । কিন্তু করোনার সময় থেকেই বাস চড়া বাদ দিয়েছি । এখন সাইকেলের উপরে পুরোপুরি নির্ভর । যেদিকেই যা সাইকেলে চেপে যাই । আগে যেখানে আমার যেতে দেড় ঘন্টা লাগতো সেখানে এখন আমার লাগে মাত্র ২৫ মিনিট । বাস ভাড়া তো বাঁচেই সেই সাথে সময় বাঁচে । কিন্তু এতো ভাল কিছুর পরেও একটা খারাপ জিনিস ঘটেছে । এই সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার ফলে জ্যামে বসে যে ধৈর্য্য শক্তি আমি অর্জন করেছিলাম সেটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে । ধরুন মাঝে মাঝে এখনও রিক্সাতেে উঠতে হয় । মার্কেটে কিংবা কোন বন্ধুর সাথে সময় তো আর সাইকেল নেওয়া হয় না, তখন রিক্সাতে চাপতে হয়, তখন আমার মেজাজ চরমে ওঠে জ্যামে আটকালেই । সাইকেল ফাঁকফোকড় দিয়ে চালিয়ে চলে যাওয়া যায়, যাওয়া যায় দ্রুত । এমন কি মাঝে মাঝে একটু সিগনালও ব্রেক করে যাওয়া যায় সাইকেল নিয়ে । যদিও আমি অতি ভদ্র ভাবে সকল ট্রাফিক আইন মেনেই চলি তবুও আমার যে কোন স্থানে যেতে সময় লাগে না । আমি আমার রুটের সকল সর্ট কাট চিনি । কোন সময়ে কোথায় জ্যাম আটকাবে সেটাও জানি তাই আমাকে সত্যি জ্যামে আটকে থাকতে হয় না । এই যেমন আজকে আমি বাসা থেকে মহাখালি ডিওএইচএস গিয়েছি মাত্র ২০ মিনিটে । আড়ং আর বিজয় সরনীর মোড় ছিল রাস্তায় । ভাবতে পারেন ব্যাপারটা?
যা বলছিলাম রিক্সাতে উঠলেই আমার এই ধৈর্য্যচুত্যি ঘটে । রিক্সা এমন ভাবে ধীরে ধীরে যায় তখন এমন মেজাজ গরম হয় । থাপড়াইতে ইচ্ছে করে সব কয়টাকে ! যা দেখি সব কিছুর উপর মেজাজ গরম হয়ে ওঠে । সাইকেল আমাকে ঢাকার রাস্তায় এনে দিয়েছে গতি কিন্তু আমার এতো দিনে জ্যামে বসে থেকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা ধৈর্য্য শক্তি কেড়ে নিয়েছে ।
তবে জ্যাম যতই এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি না কেন ঢাকার রাস্তায় চলতে গেলে মাঝে মাঝে জ্যামে জ্যামপ্যাক্ট হয়ে যেতে হয় । এই যেমন দুইদিন আগের ঘটনা । মহাখালির এসকেএস টাওয়ার থেকে যাবো মগবাজারের দিকে । কেবল রাস্তা পার হয়ে মহাখালি যক্ষা হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে আমার পাক্কা ৩০ মিনিট সময় লাগলো । যারা এই রাস্তায় যাওয়া আসা করেন তারা জানেন যে এই পথ টুকু বলতে গেলে কেবল রাস্তার এপাড় আর ওপাড় । ৫ মিনিটের পথ । এমন ভাবে এখানে জ্যাম বেঁধে গেল যে সাইকেল তো দুরে থাকুক মানুষজন হাটতে পর্যন্ত পারছিলো না । আমি যে সময়ে এই রাস্তায় চলাচল করি সেই সময়ে এখানে এই কুত্তা বিলাইয়ের জ্যাম পড়ে না বললেই চলে । মানে আমি জ্যাম পেয়েছি তবে এমন ভাবে আটকা আমি এর আগে কোন দিন পরি নি ।
যথারীতি মেজাজ গরম হতে শুরু করলো । তখন যা কিছু সামনে দেখি তাকেই আমার থাপড়াই মন হতে লাগলো । রাস্তার উপরে বসে দোকান পাট গুলো আমার কোন কালেই পছন্দ ছিল না । ঐদিন এই দোকান পাট দেখে মেজাজ আরও খারাপ হতে লাগলো । কেউ দেখি আরাম করে স্ট্রিট ফুড থেকে চটপটি খাচ্ছে রাস্তার উপরে টুল পেতে বসে । এই টুল না থাকলে আমি এই রাস্তা দিয়ে যেতে পারতাম । আবার দেখি এক সিএনজি ওয়ালা সিএনজি দাড় করি রাস্তা আটকে বসে আছে, এক রিক্সাওয়ালা দাড়িয়ে রয়েছে । এক বাইকওয়ালা উল্টো পথে আসার চেষ্টা করছে । সোজা পথে আমরা যেতে পারছি না এই বলদ আসছে উল্টো দিকে । এদের সবাইকে ধরে সমানে থাপড়াইতে মন চাচ্ছিলো । কিন্তু মন যা চায় তা কি করা যায় !
আরও একটু দুরে যেতেই জ্যামের আসল কারণ বুঝা গেল । মহাখালি বাসস্ট্যান্ডে সব সময়ই রাস্তার উপরে বাস দাড় করিয়ে রাস্তার পরিমান সরু করে রাখে। আগে দেখতাম একসারি কিংবা দুই সারি বাস দাড়িয়ে আছে । ঐদিন দেখি তিনসারি বাস দাড়িয়ে । এখন একটা রাস্তায় যদি তিন সারি বাস রাস্তায় দাড়িয়ে থাকে তাহলে অন্যদের চলাচলের জন্য রাস্তা থাকে ? অথচ কেউ দেখার নেই কারো কিছু বলার নেই ।
অবশ্য এই মেজাজ গরমের আরও একটা কারণ আমি টের পাচ্ছিলাম । সেটা হচ্ছে সন্ধ্যার নাস্তা করা হয় নি । আমি সব সময় খেয়াল করে দেখেছি যে যখনই আমার পেটে ক্ষুধা অনুভব হয় তখন সব কিছুতেই আমার বিরক্তি কিংবা রাগের পরিমানটা অন্য সব সময়ের চেয়ে একটু বেশি হয় । পেট ভরা থাকলে যেই ঘটনার প্রতি আমি সামান্য প্রতিক্রিয়া কিংবা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাই না পেট খালি থাকলে সেই একই ঘটনায় মেজাজ চরম খারাপ হবে । মহাখালি পার হয়ে এক গলির ভেতরে ঢুকলাম । সেখানে একটা হোটেল রয়েছে । সন্ধ্যার নাস্তা সেরে বের হয়ে আবারও রাস্তায় নামলাম । অবশ্য এখন আর জ্যাম ছিল না । রাস্তা একদম ফাঁকা । সেই সাথে আমার পেটও ভরা । তখন আর কাউকে থাপড়াইতে মন চাচ্ছিলো না । বরং মনে হচ্ছিলো সব কিছুই তো স্বাভাবিক ভাবে চলছে !
সাইকেল দিয়ে শুরু করেছিলাম সাইকেল দিয়েই শেষ করি । বর্তমানে ঢাকা শহরের যা অবস্থা, যাদের শরীর ফিট তাদের সবার উচিৎ সাইকেল চালানো । এতে করে আপনার স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে, আপনার অর্থ সশ্রয়ী হবে এবং সব থেকে বড় উপকার হবে যে আপনার সময় বাঁচবে । দিন দিন জীবন যাত্রার ব্যায় যে হারে বাড়ছে, ফুয়েলের দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, বাস ভাড়া যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে যাদের নিয়মিত চলাচল করতে হয়, তাদের সাইকেলের থেকে ভাল যানবাহন আর হয়ই না । অবশ্য একটা অপকার হবে এতে । জ্যাম থেকে যে ধৈর্য্য শক্তি আপনি অর্জন করেছিলেন সেটা সাইকেল চালালে নষ্ট হয়ে যাবে ধীরে ধীরে । কিছু পেতে হলে কিছু তো ত্যাগ করতেই হবে । নয় কি!
ঢাকার ব্লগারগন, আজ থেকেই সাইকেল চালানো শুরু করুন । জীবন সুন্দর করুন ।
pic source