২৫শে মার্চ রাত তারিখটা সামনে এলেই আমাদের সবার মনে অপারেশন সার্চলাইটের কথা মনে আসে, মনে আসে ২৫ মার্চ কাল রাতের কথা যেখানে মনে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী বর্বরচিত হামলার কথা । নিরস্ত্র বাঙালীদের উপরে সেই রাতে নারকীয় হামলা পাকিস্তানি আর্মি করেছিলো সে কথা আমাদের কারোই অজানা নয় । তবে এই একই রাতে অপারেশ সার্চলাইটের সাথে আরও একটা অপারেশন পাকিস্তানি আর্মি করেছিলো । অপারেশন বিগবার্ড । এই অপারেশনটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার অপারেশন । এই নামটার সাথে হয়তো অনেকেই পরিচিত আবার আবার অনেকের কাছেই পরিচিত নয় । আমি এই অপারেশন বিগবার্ড সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারি এই ব্লগে এসেই । আজকে মনে হল এটা নিয়ে একটু লেখা যাক । একটা সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের ব্লগে প্রচুর লেখা আসতো । এখন এসব আসে না ।
কিভাবে শুরু হয়েছিলো অপারেশ বিগবার্ড?
অপারেশ বিগবার্ড সম্পন্ন করার জন্য যে মানুষটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো তার নাম মেজর জহির আলম খান । তিনি সেই সময়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের থার্ড কমান্ড ব্যাটালিয়ানের দায়িত্বে ছিলেন । ২৩শে মার্চ তিনি ঢাকা আসেন অন্য একটি ব্যাপার । ঢাকায় আসার পূর্বে সে যখন কুমিল্লায় তার বাসা থেকে বের হচ্ছিলো তখন তার স্ত্রী তাকে বলে যে অফিসে রাখা সোনার গহনা গুলো যাতে সে এনে দেয় । কারণ কুমিল্লায় তাদের বাসায় কোন সেফ লকার ছিল না । সকল দামী গহনা সে রাখতো অফিসের লকারে । বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথে একটা ছোট নগ্ন ছেলেকে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে । ছেলেটি তার গাড়ি দেখেই চিৎকার করে ''জয় বাংলা'' বলে ওঠে । জহির আলমের এই সময়ে রেগে যাওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু সে আপন মনেই হেসে উঠে । তার আড়াই বছরের মেয়েও প্রায়ই ''জয় বাংলা'' বলে চিৎকারে ওঠে যখন তার বড় বোন তার পিছু নেয় । এটা তাদের খেলার একটা অংশ ।
২৩শে মার্চ যখন ঢাকাতে আসে জহির তখন তাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করতে আসে মেজর বিল্লাল । সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কর্নেল এসডি আহমেদের বাসায় । বিকেলে দিকে তাকে জানানো হয় যে ২৪/২৫মার্চ পাকিস্তানি আর্মি শেখ মুবিবর রহমানকে গ্রেফতার করবে । এবং এই পুরো গ্রেফতার অপারেশনের দায়িত্ব তাকে নিতে হবে । পরের দিন চীফ অব জেনালরেল স্টাফ রাও ফরমানের সাথে দেখা করে জহির আলম । তাকে চীফ নিশ্চিত করে যে ২৫ মার্চ রাতেই শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করতে হবে । এবং তাকে জানানো হয় যে শেখ মুজিবকে অবশ্যই জীবিত অবস্থায় গ্রেফতার করতে হবে । যদি এমনটি না হয়, শেখ মুজিব যদি অপারেশনের সময় মারা যায় তাহলে এর পুরো দায়ভার তকে নিতে হবে ।
এই কাজ করতে হবে বেসামরিক গাড়িতে করে এবং মাত্র একজন অফিসার নিয়ে । এই কথা শুনে মেজর আলম এই কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায় । সে চীফকে বলে তাকে অন্তত এক প্লাটুন সৈন্য দিতেই হবে নয়তো সে এই কাজ করবে না । এবং সেখান থেকে চলে আসে । আর্মি জেনারেল চীফ অফ স্টাফের সাথে এমন কথা বলার পরে জহির আলম একটু ভয়েই ছিলেন । তবে পরে অন্যান্য অফিসারদের মধ্যস্ততায় মেজর জহির আলম আবার রাও ফরমানের সাথে দেখা করেন । তখন রাও তাকে জানায় যে তাকে সব কিছুই দেওয়া যায় যা যা দরকার । সে কেবল সঠিক ভাবে যেন অপারেশন সম্পন্ন করে ।
অপারেশন শুরুর আগে পুরো প্লাটুনকে মোট তিন ভাগে ভাগ করা হয় । তিন গ্রুপের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজার বিল্লাল, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন এবং ক্যাপ্টেন সাইদের উপরে । অপারেশন শুরুর আগে ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে পাঠানো হয় শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর বাড়ির রেকি করার জন্য । সে দুজনকে সাথে নিয়ে বের হয়ে যায় রেকি ও বাড়ির আশে পাশে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ।
রাত নয়টার দিকে মেজর জহির আলম এয়ারফিল্ডে এসে হাজির হয় । রাত দশটার দিকে সেখানে হাজির হয় ক্যাপ্টেন হুমায়ুন । সে শেখ মুজিবের বাড়ি রেকি করে এসেছে । সে জানায় যে যাওয়ার পথে বেশ কিছু রোডব্লক বসানো হয়েছে । তাই সেগুলো সরাতে সময় নষ্ট হবে । তাদের সময়ের একটু আগেই বের হওয়া উচিৎ । ঠিক হয় নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগেই তারা রওয়ানা দিবে । ঠিক হয় তারা বিমানবন্দর হয়ে সংসদভবন মোঃপুর হয়ে ধানমণ্ডিতে গিয়ে হাজির হবে।
মেজর জহির আলম রাত এগারোটা সময় তার সেনা প্লাটুন নিয়ে রওয়ানা দেয় শেখ মুজিবের বাড়ির উদ্দেশ্যে । পূর্বের পরিকল্পনা মোতাবেগ তার সংসদ ভবনের রাস্তা পার হয়ে মোহাম্মাদপুরে ঢোকেন । মোহাম্মাদপুর রাস্তায় কোন বাতি ছিল না । মেজর জহির আলম জীপ নিয়ে এগোতে থাকে । তার জীপের পেছনে রয়েছে তিনটি ট্রাক । তিনটি ট্রাকের আলো নেভানো । তবে তার জীপের সামনে হেড লাইট জ্বলছে। ধানমণ্ডতে প্রবেশের কিছু দুর থেকে রাস্তার উপরে প্রতিবন্ধক আসতে থাকে । রোড ব্লক তৈরি করতে ট্রাক সহ নানান ধরণের যান বহন উল্টে রাখা হয়েছে, মোটা পাইপ ফেলে রাখা হয়েছে । দুশ গজ পরপর তিনফুন/চার ফুট পুরু করে ইট দিয়ে দেয়াল বানানো হয়েছে । মেজর জহির ট্রাক দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ব্লক হাটিয়ে রাস্তা তৈরি করতে চাইলো কিন্তু পারল না । শেষে জহির আলম সাইদকে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার মত রাস্তা তৈরি করতে বলল । তারপর বাকিদের নিয়ে পায়ে হেটে এগিয়ে চলল শেখ মুজিবরের বাড়ির দিকে । তারা পায়ে হেটেই পৌছালো বাড়ির সামনে ।
একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বাইরের ডান দিকে অবস্থান নিল । ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের দল দেয়াল টপকে ঢুকে পড়ে বাড়ির আঙ্গিনায় । সেখানে মুহুর্তের ভেতরে গোলাগুলি শুরু হয় । মেজর জহির বাইরে থেকে সেই গুলাগুলি শুনতে পাচ্ছিলো । সেখানে একজন নিহত হয় । বাড়ির বাইরের পুলিশ সদস্যরা গোগাগুলির এক পর্যায়ে পাশের লেকে ঝাপ দেয় । বাড়ির প্রবেশ মুখ সংলগ্ন এলাকা সেনাদের দখলে চলে আসে । পুরো বাড়ি এবং আশে পাশের সব বাড়িই এখন অন্ধকারে ঢেকে আছে । কোন আলো নেই কোথাও ।
সৈন্যরা বাড়ির ভেতরে ঢোকার সময় ছোট খাটো বাঁধার সম্মুখীন হল বটে তবে সেগুলো সহজেই সরিয়ে দেওয়া গেল । তারা বাড়ির আঙ্গিনা থেকে মুল বাড়িটে প্রবেশ করলো । পুরো বাড়ি কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে । কোথাও কেউ নেই এমন একটা ভাব । সৈন্যরা বাড়ির প্রতিটা ঘরে তল্লাসী করতে শুরু করলো । প্রতিটি দরজা খুলে সেখানে শেখ মুজিবের খোজ করতে শুরু করল কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না । কেবল মাত্র একটা ঘরের দরজা বন্ধ ছিল ভেতর থেকে । একজন সৈন্য মেজর জহির আলমকে এসে জানালো যে একটা ঘর ভেতর থেকে বন্ধ এবং ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ আসছে । মেজর জহির তখন মেজর বিল্লালকে দরজা ভেঙ্গে ফেলতে বলল । সেই সাথে ক্যাপ্টেন সাইদকে বাড়ির সামনে কোন জনতার ভীড় এসেছে কিনা সেটা দেখার জন্য । মেজরের লক্ষ্য ছিল যে লোকজন জড় হওয়ার আগে, কেউ জানার আগেই শেখ মুজিবকে নিয়ে কেটে পড়বে । কারণ জনতা যদি টের পেয়ে যায় তাহলে এখানে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে ।
ঠিক এই সময়ে ভেতর থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে । সাথে সাথে গ্রেনেড ফাটার আওয়াজও হয় । সাথে সাথে মেশিনগানের গুলির আওয়াজও শোনা যায় । মেজরের মনে তখন কেবল একটা ধারণায় জন্মে যে শেখ মুজিব হয়তো মারা পড়েছেন । মেজর দৌড়ে গিয়ে হাজির হন দরজার সামনে । তবে সেখানে গিয়ে দেখা যায় এমন কিছুই হয় নি । দরজা তখনই ভেতর থেকে বন্ধ । তবে এবার ঘরের ভেতর থেকে শেখ মুজিব সাড়া দেন । গুলি না করার শর্তে সে বাইরে বের হয়ে আসতে রাজি হয় ।
শেখ মুজিব বের হয়ে আসার পরে মেজর জহির তাকে তার সাথে আসতে বলে । তখন শেখ মুজিব মেজরের কাছে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার কথা বলেন । শেখ মুজিব বিদায় নিয়ে এলেন । তাকে সহ পুরো দল গাড়িতে উঠে বসলেন । তখনও বাড়ির সামনে কোন মানুষের ভীড় জমে নি । মেজর জহির আলম গাড়িতে ফিরে এসে ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়ে জানালো যে সে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করেছে । বিগ বার্ড ইন কেইজ ।
গাড়ি যখন চলতে শুরু করবে তখন শেখ মুজিব জানালেন যে তিনি ভুল করে তার পাইপ ফেলে এসেছেন । তার পাইপ লাগবেই । মেজর আবারও তাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলল । এরপর মধ্যে শেখ মুজিব নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন । তিনি বুঝে গেছেন যে আর্মি তার কোন ক্ষতি করবে না । কেবল গ্রেফতার করতে এসেছে । তিনি পাইপ হাতে নিয়ে মেজরকে জানালেন যে ফোন করলেই সে নিজে হাজির হয়ে যেত । তখন মেজর তাকে বলল, আমরা আপনাকে দেখতে চেয়েছিলাম যে চাইলে আপনাকেও গ্রেফতার করতে পারি ।
শেখ মুজিবকে মাঝের ট্রাকে বসিয়ে পুরো আর্মি দল রওয়ানা দিল সদরের দিকে । তখনই মেজর জহির আলমের মনে পড়লো যে পুরো পরিকল্পনা টা ছিল কিভাবে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হবে সেটা নিয়ে । কিন্তু গ্রেফতারের পরে তাকে কোথায় রাখা হবে কিংবা কার কাছে হস্তান্তর করা হবে সেটা নিয়ে কোন আলোচনা হয় নি ।
তৎকালীন সংসদ ভবনে সিড়িতে শেখ মুজিবকে বসিয়ে রেখে মেজর জহির আলম সেনা সদর দপ্তরে গিয়ে হাজির হল । টিক্কাখানের সাথে দেখা করে সিদ্ধান্ত হল যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতে শেখ মুজিবকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেই ঘরেরই রাখা হবে তাকে। এরপর শেখ মুজিবকে রাখা হয় ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসের একটি কক্ষে । সেখানে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ভবনের চারতলার একটা কক্ষে তাকে সরিয়ে নেওয়া হয় । তার তিন দিন পরে তাকে পাকিস্তানেই নিয়ে যাওয়া হয় ।
এভাবেই শেখ মুজিবর রহমানকে প্রায় বিনা বাধায় সেদিন গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় ।
তথ্যসুত্রঃ যে যে পোস্ট পড়েছি
The way it was - Z A Khan এই বইয়ের অধ্যায় এগারোতে শেখ মুজিবের গ্রেফতারের বর্ণনা দেওয়া আছে ।
‘অপারেশন বিগ বার্ড'
শেখ মুজিব যেদিন পাকিস্তানের কারাগারে হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন
২৫শে মার্চ রাতে যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিলো শেখ মুজিবকে
আরও একটা পোস্ট পড়তে পারেন স্বাধীনতা দিবসঃ “মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হল বলিদান- লেখা আছে অশ্রুজলে...”
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০২৩ দুপুর ১:৪৪