somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইউনিভার্স ২৫: ইউটোপিয়া থেকে বিলুপ্তির গল্প

২৬ শে অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৯৬৮ সালের এক জুলাইয়ের সকাল। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথের ল্যাবরেটরিতে একটা অভিনব পরীক্ষা শুরু হয়। সেই পরীক্ষাটা করেন জন বি. ক্যালহুন। তিনি এই পরীক্ষার নাম দেন ইউনিভার্স ২৫। এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল আদর্শ পরিবেশে ইঁদুরদের জীবন পর্যবেক্ষণ করা। এই আদর্শ পরিবেশ বলতে সেই সেখানে খাদ্য, পানির কোন অভাব থাকবে না। কিন্তু সেখানে জায়গা বাড়বে না, সীমিত থাকবে। ক্যালহুন জানতে চেয়েছিলেন যে যদি সব মৌলিক চাহিদা পূরণ করা হয়, তাহলে একটা সমাজ কিভাবে বিকশিত হবে? এটা জানার জন্যই তিনি এই ইউনিভার্স ২৫ তৈরি করেছিলেন। এটা ছিল সেই ইদুরদের জন্য ছিল স্বর্গ কিন্তু কিছু সময় পার হওয়ার পরেই দেখা গেল যে এই স্বর্গ নরকে পরিণত হয়েছে।
পরীক্ষার জন্য বিশেষ কেজ তৈরি করা হল। ১০১ x ১০১ ইঞ্চি। এই বর্গাগার কেজকে মোট ২৫৬টি ছোট ছোট কক্ষে বিভক্ত করা হয়। এগুলোর নাম দেওয়া হয় "অ্যাপার্টমেন্ট", এছাড়া পুরো জায়গাটাকে চারটি টাওয়ারে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি টাওয়ারে খাদ্য ও পানির অফুরন্ত সরবরাহ রাখা হয়। তাপমাত্রা সব সময় নিয়ন্ত্রণ করা হয়! ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল তাদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ। এটাকে ইঁদুরদের ইউটোপিয়া বলা যায়।—যেখানে জীবনের ধারণের জন্য কোনো ইদুরকে কোন চিন্তা করতে হত না। বিড়াল বা অন্য কোনো শিকারী প্রাণীর ভয় ছিল না, খাদ্যের অভাব ছিল না। ক্যালহুন এই ইউটোপিয়াতে মোট আটটা ইঁদুর ছাড়লেন। চারটি স্ত্রী এবং চারটি পুরুষ। সবাই সুস্থ এবং সবে যৌবন প্রাপ্ত।
শুরুর দিকে সব কিছুওই স্বাভাবিক ছিল। ইঁদুরগুলো কেজটার প্রতিটি কোণায় ঘোরাফেরা করত। টাওয়ারগুলোতে নিজেদের বাসা বানালো এবং দ্রুত প্রজনন শুরু করে দিল। প্রথম ১০৪ দিন পর্যন্ত ইদুরদের এই ইউটোপিয়া চমৎকার ভাবে এগিয়ে চলছিল। ক্যালহুন এই পর্বটার নাম দিয়েছিলেন "স্ট্রেটিফিকেশন"। এখানে দেখা যায় যে ইঁদুররা একে অপরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করত। তাদের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকল। প্রতি ৫৫ দিনে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছিল। ৩১৫ দিনে ইদুরের জনসংখ্যা হোল ৬২০।
এরপরেই ঝামেলা শুরু হল। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে কেজের মধ্যে স্থান সংকট তৈরি হলো। তবে খাদ্য এবং পানির কোনো অভাব ছিল না। তখন একটা পরিবর্তন দেখা গেল। ইঁদুর সমাজের ভেতরে একটা চাপ সৃষ্টি হল। দেখা গেল কিছু ইঁদুর, বিশেষ করে কিছু শক্তিশালী পুরুষ ইঁদুর, খাচার ভেতরের ভালো ভালো জায়গাগুলো দখল করে নিল। অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের ছিল টাওয়ারের বাইরের অংশে ঠেলে দেওয়া হল। এটাই ছিল সমাজের প্রথম ফাটল। ৩১৬ থেকে ৫৬০ তম দিন পর্যন্ত ইঁদুরের জনসংখ্যা হল ২২০০। এই পর্বের নাম দেওয়া হল "স্ট্যাগনেশন"। এই জনসংখ্যাও কিন্তু কেজের ধারণ ক্ষমতার বেশি ছিল না। কিন্তু জনসংখ্যা কিন্তু আগের মত বাড়ল না। বরং এখান থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে গেল। এখন প্রতি ১৪৫ দিনে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হতে লাগল যা আগের তুলনায় অনেক ধীর।
এই সময়ে কিছু ইঁদুরের ভেতরে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দিতে শুরু করল। কিছু পুরুষ ইঁদুর নিজের নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ক্যালহুন এদের নাম দিলেন "দ্য বিউটিফুল ওয়ান্স"। এরা প্রজননে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল এবং অন্য ইঁদুরদের উপর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। কিছু মা ইঁদুর তাদের সন্তানদের পরিত্যাগ করতে শুরু করল, কেউ কেউ আবার সন্তানদের খেয়ে ফেলল। যৌন আচরণে বিকৃতি দেখা গেল। সমকামিতা, অস্বাভাবিক যৌনতা, এবং এমনকি ক্যানিবালিজমও দেখা গেল। অর্থ্যাৎ এক ইঁদুর অন্য ইঁদুরকে খেয়েও ফেলতে শুরু করল যদিও খাদ্যের কোনো অভাব ছিল না। ক্যালহুন এই অবস্থার নাম দিলেন "বিহেভিয়ারাল সিঙ্ক"। এটাই ছিল ইঁদুর সমাজের ধ্বংসের শুরু। এখানে ইঁদুরদ সমাজের নিয়ম-কানুন ভেঙে পড়তে শুরু করল।
৫৬১ দিনের পর থেকে ইউনিভার্স ২৫ সমাজের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠল। এই পর্বটির নাম দেওয়া হল "দ্য সেকেন্ড ডেথ"। যেসব ইঁদুর বেঁচে ছিল, তারা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল। নতুন প্রজন্মের ইঁদুররা একা একাই থাকতে পছন্দ করত বেশি। তারা প্রজননে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল, নিজেদের সাজানো-গোছানোতে ব্যস্ত থাকত, এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এড়িয়ে চলত। জন্মহার ক্রমশ কমে গেল। শিশু মৃত্যুর হারও বাড়তে লাগল। ১৯৭১ সালের মধ্যভাগ থেকে ইঁদুর সমাজে আর কোন নতুন সন্তানই জন্ম নিল না। জনসংখ্যা কমতে শুরু করল। অবশেষে, ১৯৭৩ সালের মে মাসে শেষ ইঁদুরটাও মারা গেল। ইউটোপিয়া সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেল।।
ক্যালহুন এটিকে বাইবেলের Revelation 2:11 এর সাথে তুলনা করলেন। এখানে শারীরিক মৃত্যুর আগে সমাজের আত্মা মরে যায়। তার মতে, ইউনিভার্স ২৫ এ তাই ঘটেছিল। সেখানে সমাজের আত্মা মরে গিয়েছিল। অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং সীমিত স্থানের কারণে ইঁদুররা তাদের সামাজিক ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছিল। অনেক ইঁদুর "অপ্রয়োজনীয়" হয়ে পড়েছিল, যা হিংসা, বিশৃঙ্খলা, এবং শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। ক্যালহুন এই পরীক্ষাকে মানুষের সমাজের জন্য একটি সতর্কবাণী হিসেবে দেখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শহুরে জীবনে অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং সামাজিক চাপ মানুষের সমাজকেও একইভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ইউনিভার্স ২৫কে যদি মানুষ্য সমাজের জন্য একটা সতর্কবার্তা হিসাবে কি দেখা যায়? অনেকেই এটাকে সতর্কবার্তা হিসাবে দেখে আবার অনেকেই মনে করে যে ইঁদুরের উপরে যেমন ভাবে প্রভাব ফেলে মানুষের উপরে এতা সেই প্রভাব ফেলবে না। হয়তো আবার হয়তো না।
এই হচ্ছে ইউনিভার্স ২৫ এর গল্প।



আরো বিস্তারিত পড়তে চাইলে
1. Universe 25
2. Behavioral Sink
3. Universe 25 Experiment

নিচের ইউটিউব ভিডিওটা দেখতে পারে।


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১২:০২
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×