অনুগল্প।
==
একটি অপূর্ণতার গল্প।
★
মিথুর সাথে অননের পরিচয় ‘ ফেজবুক' নামক একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
অনন টুকিটাকি লেখালেখি করে।
একদিন অননের একটা গল্প পড়ে মিথুর ভালো লেগেছিল, সেই ভালো লাগা থেকেই অননের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় মিথু। অননের অবশ্য ধারণা এই বন্ধুত্ব ‘ফেজবুকের' অন্য আর দশটা বন্ধুত্বের মতই ভঙ্গুর প্রকৃতির হবে। বাস্তবিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক ইচ্ছা করলেই ভেঙ্গে ফেলা যায় না, কিন্তু ‘ভার্চুয়াল' বন্ধুত্ব শুধু ‘আনফ্রেন্ড অপশনে ক্লিক' করলেই শেষ! তার চাইতেও কঠিন জিনিষ হচ্ছে ‘ব্লক'। কারো ‘স্ট্যাটাস' কিংবা ‘কমেন্ট' পছন্দ হয়নি? দাও ‘ব্লক' মেরে!
এই হচ্ছে ‘ভার্চুয়াল' বন্ধুত্ব।
অবশ্য দু'একজন যে আলাদা নেই তাও না। দুই একজন ব্যাতিক্রমও আছে। সেই দু'একজনের মধ্যে অননও পড়ে। তার কাছে বন্ধুত্ব মানে শুধুই বন্ধুত্ব। সেটা যে মাধ্যমেই হোক না কেনো।
অনন ভ্যাগাবন্ড টাইপ ছেলে। জগতের সকল গুরুত্বহীন কাজে তার আগ্রহ বেশি। সে একই সাথে সব বিষয়ে
‘সিরিয়াস', আবার কোন বিষয়েই ‘সিরিয়াস’ না। এই জন্যই তার মা তাকে বলে পাগল, বাবা বলে অপদার্থ, আর বন্ধুদের কাছে সে বাউন্ডুলে। তার অনেক- অনেক বদগুনের মধ্যে সবগুলোকেই ছাপিয়ে যায় তার বদরাগি স্বভাবটা। হুট করেই রেগে যায় সে। শুধুমাত্র বদরাগের কারণে এই বয়সেই তাকে অনেক কিছু হারাতে হয়েছে। তবুও তার স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি।
এখনো রেগে গেলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
মিথু খুব গোছালো মেয়ে। মাথার চুল থেকে হাতের নখ পর্যন্ত পরিপাটি মেয়ে সে। সুন্দরী মেয়েরা সাধারণত বুদ্ধিমতী হয় না। কিন্তু এই মেয়ে উথাল-পাতাল রুপবতী হয়েও কি করে মগজে এতো বুদ্ধি রাখে কে জানে!
অননের মতো স্বভাবসিদ্ধ অগোছালো একটা ছেলেকে অনেকটাই গোছালো করে ফেলেছে সে। যে ছেলে কোনদিন পশ্চিম দিকে ফিরে একটা আছাড়ও খায়নি, সে ছেলেকেই এখন প্রায়ই মসজিদের প্রথম কাতারে দেখা যায়। রাত দুটা তিনটার পরও যে ছেলের ঘুম আসতো না, সে-ই এখন এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। এটা অননের জন্য মিরাকল ছাড়া আর কি-ই বা হতে পারে।
জীবনে কারো কথাই শোনেনি অনন, শাসন- বারন তার কোনদিনই ভালো লাগেনি। কিন্তু কেনো যেনো এই মেয়েটির কথা শুনতে তার খুব ভালোলাগে। মাঝে মধ্যে তার মনেহয়, ‘ইশ! যদি মেয়েটির সাথে আরো আগে বন্ধুত্ব হতো, তবে হয়তো জীবনটাই অন্যরকম হতে পারতো।'
খুব মিষ্টি গলা মিথুর। সে যখন অননকে শাসন করে, অননের তখন খুবি হাসি পায়। অননকে প্রায়শই শাসন করে সে, তখন খুব চেষ্টা করে গলার স্বরটা একটু ঝাঁজালো করতে, কিন্তু পারে না। উল্টো তখন তার গলা আরো মিষ্টি শোনায়। অনন যতই হাসে মিথু ততই রাগে, একপর্যায়ে কেঁদে ফেলে। মেয়েটার এমন ছেলেমানুষি মমতা দেখে সত্যিই অবাক লাগে অননের। মেয়েটা তাকে খামোখাই ঋণি করে ফেলছে।
অননের যায়গায় অন্যছেলে হলে হয়তো ভাবতো, ‘ইশ! এই কণ্ঠের শাসন-বারনেই যদি জীবনটা পার করে দেয়া যেতো।'
এটা আবেগের কথা, এ ধরনের আবেগের সাথে অননের পরিচয় নেই। উল্টো সে মনে করে ‘মেয়েটা কী বোকা! কোথায় কার ঘরে গিয়ে পড়বে তার নাই ঠিক, অথচ আমার মত একটা পাগল-ছাগল ছেলের জন্য কত দরদইনা দেখাচ্ছে!'
অনন জানে না, মিথুর কাছে তাদের এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা কী। বন্ধুত্ব? নাকি অন্যকিছু? তবে এটুকু সত্যি যে, মিথু মেয়েটা তার বুকের কোন একটা যায়গায় অননের জন্য অনেক খানি মমতা জমা করে রেখেছে। ভ্যাগাবন্ড টাইপ ছেলে হলেও অনন বুঝতে পারে, মিথুর এই মমতার মধ্যে কোন ভেজাল নেই। এই ব্যাপারটাও অননকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। তার জন্য শেষ পর্যন্ত মেয়েটার কোন ক্ষতিই না হয়ে যায়!
মাঝে মধ্যে অননের খুব ইচ্ছা করে, আর দশটা পুরুষ মানুষের মত স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে। তারো একটা চাকরি থাকবে, ছোট্ট একটা সংসার থাকবে, ‘মিথু টাইপ' একটা বৌ থাকবে, পরির মত দেখতে একটা মেয়ে থাকবে। পরিটা সারাদিন দুষ্টামি করবে আর তার মা কপোট রাগ দেখিয়ে— আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে মেয়েকে শাসন করবে, মেয়ে আবার তা নকল করে বাবাকে দেখাবে, আর বাপ-বেটি মিলে হেসে কুটি কুটি হবে।
এটাওতো জীবন। এমন জীবন তার কেনো হলোনা? তার কি অধিকার নেই আর দশটা মানুষের মত জীবন যাপন করার? তবে কেনো তাকে এমন জীবন যাপন করতে হয়? কে দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর? ভাবতে ভাবতে পুরাতন মাথাব্যথাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে অননের। সে সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ায়। মাথাব্যথাটা ইদানীং খুব ভোগাচ্ছে তাকে। আগে এতো ঘন ঘন হতো না, অনেকদিন পরপর হতো। তখন একটা ‘পেইন কিলার' খেয়ে হাল্কা একটা ঘুম দিলেই সেরে যেতো। কিন্তু এখন আর তা হচ্ছে না। একবার শুরু হলে একেবারে আধমরা করে ছাড়ে।
মাথাব্যথাটা প্রথমে খুবি তিব্রভাবে শুরু হয়, এরপর আস্তে আস্তে ভোঁতা হতে থাকে। শেষের দিকে অনন অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে চলে যায়। তখন সে বুঝতে পারেনা, কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব! একবার মনে হয় সবই সত্যি, আবার মনে হয় সবই কল্পনা!
এরকম একদিন মাথা ব্যাথা উঠেছিলো। মাস তিনেক আগের ঘটনা সেটা। টানা তিনদিন ছিলো সেবার। তিনদিনে প্রায় তিনশ বার ফোন দিয়েছিলো মিথু। শেষের দিকে চার্জের অভাবে ফোনটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো! এদিকে মিথু ভেবে বসে আছে তার ফোনে বিরক্ত হয়েই অনন ফোন অফ করে দিয়েছে! দুশ্চিন্তায় তার নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠেছিলো সেবার। খুব রেগে গিয়েছিলো সে। পরে অবশ্য অনন মেয়েটাকে ঠান্ডা করেছিলো, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে তাকে।
মিথুর জোরাজুরিতেই সেবার ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো অনন। এমনিতে ডাক্তার-ফাক্তার তার কখনোই ভালো লাগে না। এসব তার কাছে ফালতু দিকদারী মনে হয়! কিন্তু মেয়েটা অনেক করে অনুরোধ করায় সে আর না করতে পারলো না। সে ভাবলো, ‘যাই একবার, দেখি গিয়ে— ডাক্তার সাহেব আমার মাথাব্যাথা রোগের নতুন কী নাম দেয়!'
ডাক্তার দেখে শুনে একগাদা পেইন কিলার আর গন্ডা খানেক ‘টেষ্ট সাজেস্ট' করে দিলো। এর মধ্যে শুধু ‘সিটি স্ক্যান' করতেই আড়াই তিন হাজার চলে যাবে। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ‘প্রেসক্রিপশনটাকে' ছিঁড়ে ড্রেনে ফেলে দিলো সে! এতোটাকা খরচ করার সামর্থ তার নেই।
গত দু'দিন ব্যাথাটা ছিলো না, আজ আবার শুরু হয়েছে। সে তার ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়লো। এই সময় সে প্রতিক্ষা করে। কিসের প্রতিক্ষা সেটা শুধু সেই জানে! আজো সে প্রতিক্ষা করবে। মিথু মেয়েটার ছবি বার বার তার মনে ভেসে উঠছে। এরকম কষ্টের মুহুর্তে মেয়েটার মুখটাই কেনো মনে আসে সে জানে না। বোধহয় তার অবচেতন মন ওই মুখে স্বস্তি খোঁজে। তার মনে হয় এরকম হাজারো কষ্ট ভূলে থাকা সম্ভব শুধু একপলক এই মেয়েটার নির্মল-স্নিগ্ধ মুখটার দিকে তাকিয়ে।
মাথাব্যাথার তিব্রতা বাড়ছে, এখন আর কিছুই ভাবতে পারছে না সে। তার মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবে সে।
জ্ঞান হারানোর আগে সে দেখলো মিথু ‘কল' করছে। তার চোখের কোল বেয়ে দু'ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কলটা রিসিভ করার সামর্থ তার নেই। তার মনে হলো এই মেয়েটার সাথে আর কোনদিনই তার কথা বলা হবে না। ফোনটা হাতে নিয়েই জ্ঞান হারালো সে।
(সমাপ্ত।)