আমি কিছুই বুঝলাম না।
এই অফিসে বসে আছি প্রায় ৩৭ মিনিট। ৩৭ মিনি....ট। ৩৭ মিনিট আপনার কাছে খুব একটা সময় মনে না হলেও আমার কাছে অনেক সময়। ৩৭ মিনিটে আমার দুপুরে গোসলসহ খাওয়া হয়ে যায়। ৩৭ মিনিটে আমার ইউনি থেকে বান্ধবী তুলির বাসায় যাওয়া যায়। ৩৭ মিনিটে আমি দুইহালি ডিম বাজার থেকে কিনে এনে দিতে পারি। ৩৭ মিনিটে বাসে করে ৩৭ কি.মি. যাওয়া যায়।এমনকি বিকালে আমি ৩৭ মিনিট-ও ঘুমাই না। ৩৭ মিনিটে...
--আবুল সাহেব কে?
আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। ছেদ না পড়ে উপায় নেই। আমার নামই তো আবুল হোসেন। এই ব্যক্তি আমাকে সম্মান করে সাহেব ডাকলেন। আমার কিছুটা খুশি হবার কথা। কিন্তু আমি মোটেও খুশি না। ঘড়ির দিকে তাকাতেই বুঝলাম ৩৭ মিনিটে আমি কি কি করতে পারি তা ভাবতে ভাবতেই আরো ৩৭ মিনিট পার হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালাম।
-জ্বী আমিই আবুল হোসেন।
-- ভিতরে আসেন।
হুম ভিতরে যাবো। ভিতরে তো যেতেই হবে। না গিয়ে উপায় নেই। এ অফিসে আজ আমি ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। ভিতরে গিয়েই ইন্টারভিউ দিতে হবে। ব্যাপারটা তো আর এমন না যে ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যরা বাইরে এসে ইন্টারভিউ নিবে। আমি বসে থাকবো আর তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবেন। এইযে স্যার, আপনার নাম কি আবুল হোসেন? আমি আপনার ইন্টারভিউ নিতে এসেছি। ইন্টারভিউতে পাশ করলে চাকরি হবে। বেতন ৪০ হাজার টাকা মাত্র। স্টার্টিং স্যালারী এর থেকে বেশী হবে না। আপনি কি রাজী? রাজী হলে ইন্টারভিউ শুরু করি? বলেন তো...
--কি হলো... আসেন না কেন মিয়া?
আমার ভাবনায় আবার ছেদ পড়লো। ঐ লোক দরজায় দাঁড়ানো। অল্পতেই বিরক্ত হয়ে গেছে। তাই নামের শেষে সাহেব বাদ। এখন এসেছে মিয়া। আমি বুঝলাম না সে বিরক্ত কেন?
আমি আবুল হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এম.এস করা। বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। আমার সমস্যা একটাই আমি বেকুব প্রকৃতির লোক। বেকুব লোক কিছু একটা নিয়ে ভাবা শুরু করলে থামতে পারে না। এই নিয়ে আমার বেশ কিছু কেলেংকারি কান্ড আছে। একবার ভাইভায় স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন- আমি কেলারম্যান বিক্রিয়া জানি কি না? আমি কেলারম্যান শোনা মাত্রই ভাবলাম ক্লিয়ারম্যান শ্যাম্পুর কথা। এই শ্যাম্পু মাথায় দিলে মাথা সাথে সাথে ঠান্ডা হয়ে যায়। চুলের গোড়াও নাকি মজবুত হয় কিন্তু সেটার জন্য আমি এই শ্যাম্পু মাথায় দেই না। মাথা ঠান্ডা হয় তাই দেই। আজকেও দিয়ে এসেছি। ভাইভা পরীক্ষার আগে মাথা ঠান্ডা রাখার কোন বিকল্প নাই। তুলি এই কথাটা প্রায়ই বলে। তুলি আরো অনেক দরকারি কথাই বলে। সাধারণত মেয়েরা ফালতু কথা বেশি বলে। কিন্তু তুলি মেয়েটা ব্যতিক্রম। সে অত্যন্ত দরকারি কথা বলে। তার আরো কিছু দরকারি কথার মধ্যে অন্যতম হলো সুগন্ধী ব্যবহার সংক্রান্ত কথা। তুলির মতে সুগন্ধী দেওয়া পুরুষ আর ব্র্যাড পিটের মাঝে একটাই তফাত। সেটা হলো ব্র্যাড পিট দেখতে খুবই সুন্দর। কিন্তু সুগন্ধী ব্যবহার মানুষ কে কখনোই সুন্দর করে না। মানুষকে সুন্দর করে পোষাক। পোশাক নিয়ে তুলির আরো কিছু কথা আছে। এর মাঝে... এমন হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে আমি প্রায় ঘন্টাখানেক পার করে দিয়েছিলাম। এর মাঝে আমার মাথায় ৩বার পানি ঢালা হয়েছে। পালস চেক করা হয়েছে ১৯ বার। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের হেড পর্যন্ত চলে এসেছিলেন। আমার বাসায় ফোন করা হয়েছে। আমার বাবা অতিসত্বর আসবেন বলে কথাও দিয়েছিলেন(পরে আর আসেননি)। শেষে আমাকে পাজাকোলা করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো। হাসপাতালের বেডে শোয়ানোর সাথে সাথে আমার টনক নড়ে। আমি তখন কেলারম্যান বিক্রিয়াটা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু কেউ আমাকে কথা বলতে দেয়নি। আমি বুঝলামইনা যে কেন আমি বিক্রিয়াটা বলতে পারবো না! পরে অবশ্য আমি বিক্রিয়াটা লিখে স্যারকে পাঠিয়েছিলাম। লাভ হয়নি। আমাকে পাশ মার্কের বেশি নাকি দেয়নি। লাভের মাঝে লাভ যেটা হয়েছে আমাকে আর কখনো ভাইভা দিতে হয়নি। এই ঘটনার পর আমি ইউনিতে রীতিমত বিখ্যাত হয়ে যাই। কেউ কোন কারণে ভাইভা পরীক্ষা না দিলেই সেটাকে সবাই বলতো ‘আবুল ইফেক্ট’। আবুল ইফেক্টের কারণে আমি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলাম যে বন্ধু তুলি আমাকে প্রপোজ করতে বাধ্য হয়। ওই ভাইভাই আমার ভার্সিটি জীবনের প্রথম এবং শেষ। আজ আমার দ্বিতীয় ভাইভা। চাকরীর ইন্টারভিউ। আমি অস্থির প্রকৃতির সেই লোকের আহবানে সাড়া দিয়ে পা বাড়ালাম।
-স্যার আসতে পারি?
-- বসেন। কি নাম আপনার?
- জ্বি স্যার আবুল হোসেন।
-- কোন আবুল? মন্ত্রী আবুল ? হা হা হাহ হা...
উনি আকাশ বাতাস কাপিয়ে হাসতে লাগলেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। উনি হাসছেন কেন?আমার কি হাসা উচিত? আমার হাসি সাধারণত দুই ধরনের। না বুঝে হাসা এবং দাঁত কেলিয়ে হাসা। এখানে কোন ধরনের হাসি দিলে চলবে বুঝতে পারছি না। যেহেতু বুঝতে পারছি না তাই না বুঝে হাসিটাই দিলাম।
--আপনি কি বিবাহিত?
আমি বিবাহিত কি না সেটা উনার হাতে আমার রেজিমিতেই আছে। উনি তারপরও কেন জিজ্ঞাসা করছেন বুঝলাম না।
-না স্যার। এখনো অবিবাহিত।
--কেন? ধ্বজ নাকি?
আমি স্তম্ভিত হলাম। এইলোক এইসব কি বলে!
- না স্যার। চাকরি বাকরি নাই... বিয়া করে বউকে খাওয়াবো কি?
-- উহু! আপনে নিশ্চয়ই ধ্বজ! কি আপনার তো দাঁড়ায় না, তাই না?
- কি দাঁড়ায় না?
-- কি দাঁড়ায় না মানে? (উনি উত্তেজিত হয়ে চেয়ার থেকে প্রায় উঠে দাড়ান)
আমি ভয় পেয়ে বললাম- জ্বি আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমার দাঁড়ায় না। আমার মাথায় গোলমাল হওয়া শুরু হলো।
উনি আবার শান্ত হয়ে বসেন।
--গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি?
আমার গার্লফ্রেন্ড আছে কি নাই সেটা জানার সাথে আমার চাকরির কি সম্পর্ক বুঝলাম না। বললাম- জ্বি আছে স্যার।
উনি নড়েচড়ে বসলেন। গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে তাকে বেশ উৎসাহিত মনে হলো।
--ও আচ্ছা! কতদিনের সম্পর্ক? কত বছর কত মাস?
-(মাথা চুলকে) সাড়ে তিন বছর হবে মনে হয়।
--কি বলেন! একটা সম্পর্ক আছে তাও কতদিনের ঠিকমত জানা নেই!?
আমি দ্বিগুণ জোরে মাথা চুলকাতে থাকি। আমি আর কি বলবো? আমার কিছু বুঝে আসছে না!
--ডেটিং করেন?
- মাঝে সাঝে।
--ডেটিং-এ কি করেন? চুমাচুমি? হাগিং?
- না।
-- তাইলে?
-গল্প করি। বাদাম খাই। মাঝে মধ্যে আইস্ক্রিমও খাই।
--ধূর মিয়া! আপনে তো দেখি কোন কামেরই না! একটা গার্লফ্রেন্ড আছে, তারে নিয়া পার্কে যাইবেন। চুমাচাট্টি দিবেন। কোমরে হাত দিয়া ঘুরবেন। তা না মিয়া... করেন কি? আইস্ক্রিম খান!! ফাইজলামি করেন আমার সাথে ? আপনে তো মিয়া কিছুই পারেন না! (উনি আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন)
- জ্বি স্যার। ঠিক ধরেছেন। আমি কিছুই পারি না।
উনি আমার ‘পারি না’ শুনে কিছুটা ঠান্ডা হলেন।
--লেখাপড়া কি করছেন?
-কেমিস্ট্রিতে এম.এস করেছি।
--আরে মিয়া সেইটা তো জানি আমি। কেমিস্ট্রি কি শিখছেন সেইটাই তো জানতে চাই!
-জ্বি স্যার বলেন। কি নিয়ে বলবো?
--অত কঠিন কিছু না। আপনেরে সহজ প্রশ্ন জিগাই। দেখি কইতে পারেননি। ধরেন, আপনে বিবাহিত। আপনার বউ বাচ্চা আছে। আপনে এক বাসায় থাকেন। আপনার পাশের বাসায় এক লোক থাকে। বউ নিয়া। আপনার সেই লোকের বউরে ভালো লাগে। আপনার উপরের ফ্ল্যাটে আরেক লোক থাকে। তার মেয়ে ইন্টারে পড়ে। আপনার তারেও ভালো লাগে। আপনার পাশের বাড়ির ছাদে এক ছেমড়ি ঘুরে। আপনের তারে আরো বেশি ভালো লাগে। এইবার কন আপনার মনের কেমিস্ট্রি আসলে কি রকম?
আমি এইবার বুঝলাম।
এই লোক মানসিক বিকারগ্রস্থ। ইনার বিশাল কোন সমস্যা আছে। আমার চাকরির দরকার নেই। এখন এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া দিয়ে কথা।
-স্যার আমার চাকরির দরকার নেই। আমি আসি?
--সে কি? আসি কেন? চাকরি লাগব না মানে?
-না স্যার লাগবে না। এমনিতেই লাগবে না। আমার বাবার অনেক টাকা পয়সা আছে। উনি আমাকে খাওয়াতে পারবেন। আসি স্যার। থ্যাংকিউ।
আমি উঠে গেলাম। বের হয়ে যাবার আগে উনি আবার ডাকলেন।
--আবুল সাহেব, শুনে যান।
-জ্বি স্যার।
--বসেন। কথা শেষ হয়নি। কথা শেষ করি।
আমি বসলাম না। আমার আর কথা শোনার ইচ্ছা নেই। এরপর হয়তো জিজ্ঞাসা করবেন আমার বাবা-মাও প্রেম করতেন কি না? তারা ডেটিং এ গিয়ে কি করতেন? বাবা কি মায়ের কোমর ধরে ঘুরে বেড়াতেন? নাকি বাবা-ও ধ্বজ?
-স্যার আপনে বলেন। আমি শুনতেসি। (আমি দাড়িয়েই রইলাম। আমার আর বুঝার দরকার নাই)
--আরে বসেন না। ঘাবড়াইয়েন না।
হুম একদম ঠিক। ঘাবড়াবো কেন? ঘাবড়ানোর মত কি কিছু হয়েছে? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়লাম। এই লোক কি চায় আসলে?
--আপনার চাকরি কনফার্ম। স্টার্টিং ২৮ দিবো। চলবে?
আমি হতভম্ব। বলে কি?!
-চাকরি কনফার্ম মানে? আমি তো কিছুই পারি না। আপনেও কিছু জিজ্ঞাসা করেন নাই। চাকরি হয়ে গেলো স্যার? আমি তো কিছুই বুঝলাম না!!
--হুম হলো। শুনেন... আমার অতি পারা লোকের দরকার নাই। আবার অতি চালাক-ও দরকার নাই। আমার দরকার বোকাসোকা গাধা প্রকৃতির লোক। আপনে বেকুব লোক। আর আপনে সত্যবাদি। আমার এইগুলাই দরকার। কাজ তো আমি আপনাকে শিখায় নিবো। ট্রেনিং দিলে সবাই সব পারে। ট্রেনিং পাইলে বাঘেও রিং গলায় বেরিয়ে যায়। সিংহ খেলা দেখায়। আপনে তো পারবেন-ই। যান জয়েনিং লেটার নিয়ে যান। আগামী মাসের ১ তারিখে আসবেন, ওকে?
আমি সরাসরি জয়েনিং লেটার নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমি এখনো কিছুই বুঝলাম না।