-ভাইজান, একটা টেহা দিবেন? কিছু খামু।
--টাকাটুকা নাই। যা সর এখান থেকে।
রত্না সরে না। প্রেমিকা পাশে থাকলে প্রেমিকের কাছ থেকে ভালো ভিক্ষা পাওয়া যায়। সাড়ে নয় বছর ধরে এই পার্কে ভিক্ষা করার অভিজ্ঞতা থেকে সে ভালোই জানে এখান থেকে ভিক্ষা মিলবেই। তার শুধু বিমর্ষ বদনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
রত্না বিমর্ষ বদনে দাঁড়িয়ে থাকে।
-কি বললাম না ভাংতি নাই। যা এখান থেকে! খামোখা দাড়ায় আসস কেন?
রত্না তবু দাঁড়িয়ে থাকে। হাত বাড়িয়ে থাকা চোখে প্রবল আকুতি। ক্ষুদার্থ চোখে মায়া বেশি থাকে। প্রেমিকার কাবু হতে সময় লাগে না।
-আহা খামোখা বকছো কেন মেয়েটাকে? দিয়ে দাও কিছু। দেখেই তো বুঝা যাচ্ছে কিছু খায়নি সারাদিন।
-(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)ওকে। তুমি যখন বলছো দেখি... (মানিব্যাগ বার করে) ভাংতি তো নেই... ঠিকাছে এই নে দশ টাকা। কিছু কিনে খাইস। যা।
রত্না টাকাটা নিয়ে মৃদু হাসে। তার টেকনিক সহজে বৃথা যায় না।
একটা রুটি আর কলা কিনে রত্না পার্কের বেঞ্চে বসে। তার হাতে খাবার দেখে সদরুলের আবির্ভাব। তার এই ছোটভাইটার খালি খাইখাই স্বভাব। থাবা দিয়ে রুটির আধা খুবলে নেয় সদরুল। কলাটা নিয়ে কাড়াকাড়ি বেধে যায় দুজনে।
-হারামজাদা এত খাই খাই মারাস কেন? সকালেই তো দুইটা রুটি খাইলি।
--আবার খিদা লাগসে। এট্টু কলা দে।
-না দিমু না। আমার বহুত খিদা লাগসে।
--খাওন কই পাইলি?
-ঐযে... রত্না হাত বাড়িয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলকে দেখিয়ে দেয়।
সদরুল দৌড়ে ভিক্ষা নিতে যায়। রত্না খিলখিল করে হাসে। এত টাকা ভিক্ষা দেওয়ার পর কেউ ঐদিনে আর সহজে ভিক্ষা দেয় না। এটাও সে জানে। সদরুলকে ঐখানে পাঠিয়েছে শুধু একটু টাইম পাওয়ার জন্য। ও আসতে আসতেই রুটি কলা সাবার হয়ে যাবে!
খাওয়া শেষে কলার খোসাটা ছুড়ে ফেলতে গিয়ে রত্না বেঞ্চের পাশে মোটাসোটা গাট্টাগোট্টা গাউস মিয়াকে দেখে। গাউস মিয়া বেশ কিছুদিন হলো রত্নার আশেপাশে খুব করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে রত্নাকে সুন্দর জামা, লিপস্টিক দিতে চায়। বলে যে তার সাথে কাজ করলে নাকি অনেক টাকা দিবে। ভালো খাবার দিবে। রত্না জানে গাউস মিয়া তাকে দিয়ে খারাপ কাজ করাতে চায়। তার সই মনোয়ারা গাউস মিয়ার পাল্লায় পড়েছিলো। মাঝে কয়েকদিন মনোয়ারাকে রাত্রিবেলা সুন্দর পোশাক পড়ে পার্কে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছে রত্না। এর কিছুদিন পর থেকে মনোয়ারাকে আর পার্কেই দেখা যায়নি। রত্না সুন্দর জামা-লিপস্টিক চায়, কিন্তু মনোয়ারার মত হতে চায় না। তাই সে গাউস মিয়াকে দেখলেই পালায়। আজকে অবশ্য পালানোর সুযোগ মিললো না। গাউস মিয়া একটা হাত ধরে পাশে বসে পড়লো।
-কি দুপুরের লাঞ্চু করলি নিরে...! হে হে হে হে...
--হাত ধইরছেন কেন? হাত ছাড়েন।
-আহা তুই রাগ হচ্ছিস কেরে? তোর লয়ে কি এট্টু গপসপ কইরবার পারি না?
--গপসপ অন্য জায়গায় গিয়া করেন। আমার লগে কি? হাত ছাড়েন।
-আহ্ ছেড়ি তুই বড় কালাকারি করছ দেহি! লিপস্টিক নিবি নি এট্টা? তোরে লিপস্টিক দিলে যা লাইকপে নারে... এক্কেরে পরীর লাহান সুন্দর্য্য... হে হে হে হে...
--পরী লাগতোনা আমার... ছাড়েন তো দেহি।
রত্না সহজে হাত ছাড়াতে পারে না। গাউস মিয়া হাত মুচড়ে তাকে কাছিয়ে আনে। পানের পিকভরা মুখের বিশ্রি গন্ধে রত্নার গা গুলিয়ে উঠে। গাউস মিয়া আরেকটা হাত তার কোমরে চেপে ধরে। রত্নার শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। এমন সময়ে সেখানে আরেকটা লোকের আবির্ভাব।
-ঐ মিয়া কি করেন... হাত ছাড়েন! মিয়া বদমায়েশি করার আর জায়গা পান না তাই না? মাইয়া পাইলেই হইছে?! ছাড়েন!- গাউস মিয়াকে ধমকে উঠে লোকটা।
গাউস মিয়া দ্রুত রত্নার হাত ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। রত্না ধপ করে বেঞ্চে বসে বড় বড় দম নিতে থাকে। লজ্জ্বায় তার চোখে পানি চলে আসে। লোকটা বেঞ্চে রত্নার পাশে বসে পড়ে।
-এই মেয়ে তোর নাম কি?
--র...রত্না।
-বাড়ি কই?
--এইখানেই।
-বাপ মা আছে?
--নাই। বাপে মরছে। মায়ে আরেকজনের লগে গেছে গিয়া।
-(লোকটা কিছুক্ষন ভাবে)... ও তা তুই কি করস?
--কিছু না। ভিক্ষা করি।
-বাসায় কাম করবি?
রত্নার না করার কোন উপায় নেই। সে জানে রাত হলেই গাউস মিয়া আবার আসবে। এসে ত্যক্ত করবে। এর চেয়ে বাসা বাড়িতে কাজ করা ভালো। তার মা আগে বাসা বাড়িতে কাজ করতো। প্রায়ই রাতে গোশত সাথে করে নিয়ে আসতো। আহা গোশতের সেকি ঘ্রাণ! সে কথা ভাবতেই রত্নার জিভে জল চলে আসে। কতদিন খায়নি সে!
পার্কের কাছেই একটা সাদা বিল্ডিং-এ লোকটা থাকে। লোকটার নাম মনির। রত্মাকে মনির ভাই বলে ডাকতে বলেছে। মনির ভাই রত্নাকে একটা ছোট্ট ঘর দেখিয়ে দেয়। এখানেই সে থাকবে আর বাসার কাজ করবে।রত্নার চোখে পানি চলে আসে। ইটের দালানে তার বাসা হবে সেটা রত্মা কল্পনাও করতে পারেনি! ঝাড়ু হাতে সে ঘড়দোর ঝাড়তে শুরু করে দেয়। রাতে মনির ভাই বিরানী নিয়ে আসে। সে কি স্বাদের সেই বিরানী! আর গোশতে ভরা! রত্নার মনে হয় সে স্বপ্নের দেশে আছে। খাওয়া দাওয়া করেই সে ঘুমিয়ে পড়ে।
বেশি রাতে রত্নার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে বুঝতে পারে বিছানায় সে একা নয়। কেউ একজন পাশ থেকে তার জামা খোলার চেষ্টা করছে। আতংকিত রত্নার গলা দিয়ে আওয়াজ-ও বের হয় না। ভয়ে সে বিছানা থেকে নামতেও পারে না। পাশ ফিরিয়ে শুধু মনির ভাইয়ের চেহারাটাই দেখতে পায়। জানালা গলে আসা ল্যাম্পপোষ্টের হলুদ আলোয় মনির ভাইকে আর দিনের আলোর মত দেবদূত লাগছে না। কেমন যেন ঘোরলাগা চোখের দানবের মত লাগছে...
পরদিন দুপুরে পার্কের বেঞ্চে শুয়ে আকাশ দেখছে রত্মা। বুঝতে পারে বেঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে মোটাসোটা গাট্টাগোট্টা গাউস মিয়া খিলাল দিয়ে দাত খুটছে আর তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।
রত্না চোখ মুদে ঘুমিয়ে পড়ে। তার আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না...