(ব্যাখ্যা খুঁজতে হলে অযথা পড়ে সময় নষ্ট না করার জন্য অগ্রিম ধন্যবাদ)
সময়টা 2000 সাল। এমনিতে 99 সালের পর 2000 সাল কিভাবে লেখা হবে তা নিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সঙ্গে আমজনতার মধ্যেও দারুণ একটা আশঙ্কার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। লোকমুখে সে সময় একটা প্রবল অনিশ্চিয়তা দেখা গিয়েছিল যে অন্য সবকিছু ম্যানেজ করা গেলেও বিমান যাত্রায় 31 ডিসেম্বরের পর পয়লা জানুয়ারির এই পরিবর্তন কিভাবে সেটিংস করা হবে তা নিয়ে। শুধু আমজনতার মধ্যেই নয়, বিমান সংস্থা গুলোর মধ্যেও নাকি প্রবল সংকটের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের মধ্যেও এই নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। আমার পরিচিত এমনই কয়েকজন এ সময় ডিসেম্বর জানুয়ারির দোলাচলের মধ্যে না পড়তে আগেভাগেই নিরাপদে নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে মনস্থির করেছিল। আমি মফস্বল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছি। অন্যান্য পড়ুয়াদের এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও আমাদের মত আদার ব্যাপারী মার্কা পড়ুয়াদের তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজন ছিলনা। কিন্তু সমস্যা হল অন্য একটি জায়গায়।
প্রথমেই জানিয়ে রাখি। মফস্বল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায় বাড়ি থেকে দৈনিক বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। কাজেই হোস্টেল বা মেসে থাকা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।কিন্তু আমার অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে বিষয়টি ভেবে শুরুতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। স্বভাবতই সে কথা মাথায় রেখেই অনেক খোঁজাখুঁজির পর সোনারপুরে একটি কম পয়সার মেসের সন্ধান পাই।রেললাইনের দুপাশে কাশবন তারই মধ্যে দিয়ে আসা-যাওয়া, একান্ত নিরিবিলি মেসটি ছিল শহরের কোলাহল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। প্রথম দেখাতেই মনে হল তপবনের কোন মুনির আশ্রম। টিনের শেড, বাঁশের দরমার বেড়া ও মাটির মেঝে; আপাতদৃষ্টিতে মেসটিকে দেখে নেহাত মন্দ লাগেনি। অন্ততঃ পকেটের পয়সা অনুযায়ী মানানসই বলতেই হবে। আমাদের মা.হাসান ভায়ের কথায় কিরপিনের মেস। যাইহোক এমন কিরপিনের মেস থেকে লাইনের ধার ধরে পাথরের উপর দিয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে গেলে তবেই সোনারপুর স্টেশনে পৌঁছাতে যেতো। রাস্তা ঘুরে গেলে তিন থেকে সাড়ে তিন কিমি দূরত্ব তো হবেই।কয়েকদিন থাকার পরে জানতে পারি এখানে যথেষ্ট চন্দ্রবোড়ার উৎপাত আছে। আমি ভীষণ সাপের ভয় পাই। কাজেই মেসের ছেলেদের কাছে সাপের আনাগোনায় কথা জেনে প্রতিটি রাতে খুব সিঁটিয়ে থাকতাম। একেতো সাপের আনাগোনা তার উপরে কতকটা হাঁটা- ফলে যৌথ তাগিদে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের সুযোগ পাওয়া।আর এর ফলেই ইতি ঘটতে পারে আমার এই শ্বাপদসংকুল মেস জীবনের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সেশন শুরু হয় অক্টোবর মাসের শুরুতেই। এক্কেবারে শুরু থেকেই লাগাতার চেষ্টা করে অবশেষে তৃতীয় লিস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে প্রবেশের সুযোগ পাই। কিন্তু সুযোগটি এলো ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। 24 শে ডিসেম্বর সমাবর্তন অনুষ্ঠানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সপ্তাহের জন্য উইন্টার ভ্যাকেশন শুরু হয়। নিয়ম অনুযায়ী খোলার কথা 2 জানুয়ারিতে।যতদ্রূত সম্ভব হোস্টেল সুপারকে রিপোর্টিং করার নিয়ম। নতুবা সুযোগ নষ্টের সম্ভাবনা থেকে যায়। রুম অ্যালটমেন্টের পর যথারিতি আমার রুমমেটের সঙ্গে দেখা করি। প্রথম পরিচয়েই আপাতদৃষ্টিতে সরল সাদাসিধে স্বভাবের বাংলা বিভাগের পিজি প্রথম বর্ষের মোক্তার আহমেদের সঙ্গে পরিচয় হয়।ভীষণ মিষ্টি ছেলেটি সারাক্ষণই টিপটপ এবং পারফিউম মেখে থাকে। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বারংবার প্যান্টের মধ্যে শার্ট গুঁজে গুঁজে দিচ্ছিল। আর ঠিক উল্টোটাই আমি। প্যান্টের উপরে শার্ট ছেড়ে দিয়ে পড়ি। পায়ে থাকে মুগুর মার্কা অজন্তা চটি। একটি প্যান্ট ও দুটি-শার্টে আমার সপ্তাহ চলে যায়। ট্রেনে কোন টিকিট কাটতে কোন পয়সা লাগেনা। পকেটে দুই টাকা নিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ গেছি। একদিন চেকারের সামনে পড়লাম। ফাইন চাইল, না দিতে পারলে চালান করার হুমকি দিল। পকেটে পয়সা নেই বলে, হাতে পায়ে ধরলাম। কিন্তু ব্যাটা শুনল না। এবার আমার সারা শরীরে পরীক্ষা করে দেখল কোথাও কোনো টাকা-পয়সা লুকানো আছে কিনা। অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে প্যান্টের গোপন পকেটে হাত দিয়ে বেশ কিছুদিনের সুরক্ষিত আটভাজ করা দু টাকার নোটটা বের করে আনল। বেশ কিছুক্ষণ টাকাটা উঁচুতে ধরে অট্টহাসির পর বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে,
-ভাগ এখান থেকে ভাগ।
কথা শেষ হতেই, আমি এক নিঃশ্বাসে দিলাম ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়।
এমতাবস্থায় শুরুতে মোক্তারের মতো ওজনদাড়ি রুমমেটের সঙ্গে পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবনযাত্রার আসন্ন বৈষম্যের কথা ভেবে কিছুটা হীনমন্যতা উপলব্ধি করে একটু দূর থেকে ওর সঙ্গে কথা বলছিলাম। আশঙ্কা ছিল, আমার গায়ের ঘেমো দুর্গন্ধ না ওর নাকে গিয়ে পৌঁছায়।তবে কথার মধ্যে একবারও ওর এসব নিয়ে বিরক্ত হতে দেখলাম না। বরং আমাকে পেয়ে বেশ খুশি খুশি বলেই মনে হলো। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে বাড়ি মোক্তারের সঙ্গে প্রথম দিনেই অনেক কথাবার্তা হয়েছিল। মনে মনে খুশি হয়েছিলাম এমন একজন রুমমেট পেয়ে যে হোস্টেল জীবনের বাকি দিনগুলো বেশ আনন্দেই কাটবে। বেশ সচ্ছল পরিবারের ছেলে মোক্তার। পড়াশোনা করে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ও নিজেও ইতিমধ্যে তিনবার বিদেশ সফর করে এসেছে। পাসপোর্ট-ভিসা থাকায় কলকাতার ধর্মতলার একটি সংস্থার ব্যবসায়ীক কাজে দুবার ব্যাংককে ও একবার ঢাকা ঘুরে এসেছে। বাড়ি থেকে এক পয়সা নিতে হয় না; সংস্থার টাকাতেই নাকি ঘুরে বেড়ায়। খুব উচ্ছ্বসিতভাবে প্রথম দিনেই জানিয়েছিল ঢাকা, ব্যাংককের নানান অভিজ্ঞতার কথা। কিন্তু এতটা আনন্দের মধ্যেও নিজের বিষণ্নতার কথা জানাতে ভোলেননি। নিজের হোমটাউন জঙ্গিপুর, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটেই অবস্থিত। গোটা শহরটাই নাকি বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করে টিকে আছে। তবে সেই ব্যবসা বৈধ পথে নয়। পয়সার অভাব ওদের নেই কিন্তু যে ব্যবসার কথা কারোর সঙ্গে মুখ খুলে বলতে পারে না- এটাই ওর হীনমন্যতার প্রধান কারণ।
সে বছর আমি ডব্লিউ বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিই। যদিও বিষয়টি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছে গোপন রেখেছিলাম। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কাজেই শেষ মুহূর্তে সবাইকে গোপন রেখে নিজেকে প্রস্তুতি রাখাটাই আমাকে প্রতিনিয়তই তাড়া করে বেরিয়েছিল। মোক্তার গল্প করতে চাইলেও আমার মন পড়েছিল নিয়ম রক্ষার বা সৌজন্যটুকু দেখিয়ে বিদায় নেওয়ার।মন চাইলেও গল্প বাগীশ মোক্তারের কাছ থেকে সেদিন যেন কিছুতেই ছাড়া পাচ্ছিলাম না। তবে ও ছুটিতে বাড়ি গিয়ে আরোও কিছুদিন থাকার কথা বলাতে বেশ খুশি হয়েছিলাম। এরকম একটা একা ফাঁকা ঘর-ই মনে মনে আমার খুব দরকার ছিল। অন্তত পরীক্ষায় কটা দিন পর্যন্ত নিজেকে নিজের মতো করে প্রস্তুতি নিতে পারব ভেবে। সেদিন গল্প শেষে মোক্তার চাবিটি আমার হাতে তুলে দেয়। সন্ধ্যাবেলা মেসে ফেরার পথে, মনে মনে ভীষণ প্রফুল্ল হই যে এতদিন পর আমার স্বপ্ন স্বার্থক হতে চলেছে।বিরক্তিকর ট্রেন লাইন ধরে পাথরের উপর দিয়ে হাঁটা যে কতটা বেদনার, কতটা কষ্টের তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন।
পয়লা জানুয়ারি মেসে সেলিব্রেশন করে সকলকে বিদায় জানিয়ে দু তারিখে সকাল বেলায় আমি সামান্য বেডিং পত্র নিয়ে হোস্টেলে পৌঁছে যাই। হোস্টেল সুপারকে নিয়ম রক্ষার রিপোর্টিং করে সেদিন গোটাদিন বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকি। সারাদিনে হোস্টেলের বিভিন্ন বোর্ডার মাঝে মাঝে দরজা ঠেলে মোক্তারের খোঁজ করে, কেউবা আমি নুতন কিনা জিজ্ঞাসা করে যে যার মত চলে যায়। আমিও তাদের প্রশ্নের প্রয়োজনমতো উত্তর দিয়ে নিজের কাজে ডুবে থাকি। মাঝে দুপুর ও রাতের মিলটুকু খেতে একটু ডাইনিং রুমে যাওয়া ছাড়া সারাদিন আমি রুমেই কাটিয়ে দেই। মোক্তার জানিয়েছিল, সন্ধ্যারাতে ছাত্ররা কেউ পড়াশোনা করে না। সকলেই ডাইনিং রুমে টিভিতে খবর দেখতে বা কেরাম খেলে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দেয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি আসল পড়াশোনা শুরু হয়। আমি আবার সম্পূর্ণ উল্টো প্রকৃতির। সারাদিন পড়াশোনা করলেও বেশি রাত জাগতে পারিনা। সে কথা মাথায় রেখে হোস্টেলের প্রথম দিনে সারাদিন পড়াশোনা করলেও সন্ধ্যা রাতে সাড়ে দশটা/ এগারোটার মধ্যে খেয়ে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ে অন্যের আক্রমণের লক্ষ্য না হতে আরো রাত জেগে পড়াশোনা করতে থাকি। রাত এগারোটার পরে একটু ঝিমুনি ভাব এসেছিলো। বুঝতে পারছি আর চোখ খুলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একবার মনে হল মাথার উপরে কিরণ দেওয়া 100 ওয়াটের বাল্বটা অফ করে দিই। কিন্তু অন্যান্য ঘর থেকে তখনো হাসি-ঠাট্টার শব্দ কানে আসছিল। কাজেই বালিশে মাথা গুঁজে মড়ার মত রইলাম পড়ে। কতক্ষণ এভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম ঠিক মনে নেই, হঠাৎ প্রবল শব্দে মাথার উপর থাকা বাল্বটি ফেটে গেল। মুহূর্তেই কাঁচের টুকরোগুলো ঝনঝন পড়লো চতুর্দিকে। আমার ঘুম গেল ছুটে। চোখ ঘষতে ঘষতে হঠাৎ নিচের দিকে চোখ গেল। তখনো ফিলামেন্টের রক্তিম আভা থেকে সামান্য কিরণ দিচ্ছে। তারই আবছা আলোয় আমার মত করে চার হাত-পা চারদিকে দিয়ে কে একজন শুয়ে আছে। দূরে লক্ষ্য গেল দরজার দিকে।অন্ধকারের মধ্যে দরজা যথারীতি বন্ধ আছে। মনে মনে ভাবছি,প্রশ্ন করতে যাব তুমি কে, এমন সময় চোখ গেল পাশের দেওয়ালে। ফিনকি দিয়ে বার হওয়ার টাটকা রক্ত দেওয়ালে লেগে আছে। মুহূর্তেই কাঁচা রক্তের আশঁটে গন্ধ নাকে এলো।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরিচিত মিষ্টি একটা গন্ধ। খুব পরিচিত লাগলো গন্ধটা। কিন্তু পরক্ষণেই আমার হাত পা অবশ হয়ে গেল। তার পরের ঘটনা আমার আর মনে নেই।
সকালে বাইরের কোলাহলে আচমকা উঠে বসি। চোখ মেলে দেখি দূরে টেবিল ঘড়িতে 9:35 হয়েছে। আশ্চর্য হই যখন দেখি মাথার উপরে বাল্বটি দিব্যি আছে। আরো আশ্চর্য হই যখন নিচে তাকিয়ে দেখি এক টুকরো কাঁচের কনা পর্যন্ত সেখানে নেই। এ কী করে সম্ভব! একইভাবে দেওয়ালের যেমন রং তেমনই আছে। কোথাও কোন রক্তের দাগ নেই। এখন দিনের আলোতেও আমি গতরাতের ঘটনায় শিউরে উঠি। অথচ এমন ঘটনা যে কাউকে বললে তো কেউ বিশ্বাস করবে না। শুধুমাত্র বাল্বের সুইচ অন করে দেখলাম, বাল্বটি কেটে গেছে।আর মিষ্টি গন্ধটা তো মোক্তারের গা থেকেও সেদিন পেয়েছিলাম ।নাহা! এখানে থাকতে আমার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু যাব কোথায়? কাছে যা টাকা ছিল আগের রাতে মেসে ফিস্ট করে সব তো শেষ করে এসেছি। আর তাছাড়া পুরানো জায়গায় ফিরে গিয়ে ওদেরই বা কি ব্যাখ্যা দেব। নানান ভাবনা সেদিন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। কে দেবে গো আমারে সলিউশন? এখন আমার করনীয় কি?মেসে ফিরে যাব? নাকি এখানেই থাকবো? পরক্ষনেই মনে আসে মোক্তারের কথা। মনে মনে প্রশ্ন জাগে, ওর সঙ্গে কি তাহলে এরকম ঘটনা কখনো ঘটেনি? নইলে ও এখানে থাকবে কি করে? এই ভাবনায় আমার সেদিন সারা দিন কেটে যায়। খাওয়া তো নয়, গর্ত পূরণের জন্য মাঝে একটু ডাইনিং রুমে গেলেও খাবার যেন কিছুতেই গলার ওপাশে সরছিল না।পরে একটু বাইরে গিয়ে বাল্বটি পাল্টে ফেলি। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই মনের অস্থিরতা আবারও বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিং রুমে আড্ডারত অন্যান্য বোর্ডারদের সঙ্গে বসে পড়ি। ওরা এত হৈ-হট্টগোল করলেও সেসব কিছু আমার মাথার মধ্যে ঢুকছিলনা। কিছুতেই নিজেকে মেশাতে পাচ্ছিলাম না ওদের সঙ্গে। খুব অসহায় লাগছিল।নিজেকে সেসময় ভিনগ্রহের কোন বাসিন্দা বলে মনে হচ্ছিল। সাথে সাথে আজ রাতে আবার কি হয়, তার আগাম আশঙ্কায় সারা শরীরে যেন শীতল স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে।
মলিন মুখে বসে ছিলাম ডাইনিং রুমের এক কর্ণারে।এক এক করে যে যার রুমে তখন ফিরে যেতে থাকে। টিভির দিকে চেয়ে থাকলেও লক্ষ্য ছিল শূন্য দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ। তারই মধ্যে আমার চোখ ঘুরছিল অন্যান্য বোর্ডারদের গতিবিধির দিকে। ক্রমশ ডাইনিং রুম ফাঁকা হতেই যেন কোন অশরীর আগমন বার্তা হৃদয়ে হাতুড়ি পিটতে থাকে। এমন সময় দুপুরে খোঁজ নিতে আসা মোক্তারের বন্ধু সাত্যকির আচমকা ডাকে সম্বিৎ ফিরে পাই।
-কিরে পলাশ! রুমে যাবিনা? এখনো বসে আছিস?
আমি মাথা উঁচু করে তাকাতেই ও আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারে। কিছুটা ঘাড় নিচু করে আগ্রহ ভরা চোখে একেবারে সামনে চলে আসে। কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-শরীর খারাপ লাগছে?
কি উত্তর হবে বুঝতে না পেরে অনেকটা অসহায় ভাবে হ্যাঁ বলাতে সঙ্গে সঙ্গে ও আমার হাত ধরে ওররুমে নিয়ে যায়। এবার আমি নির্ভয়ে ওর সঙ্গে পুরো ঘটনাটা শেয়ার করি। ও তখন দু'বছর আগে আন্ডারগ্রাজুয়েটে পড়াকালীন মোক্তারের রুমমেট অনির্বাণের আত্মহত্যা করার ঘটনাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। সাত্যকি অবাক হয়, দু বছর আগের ঘটনা এখন এভাবে ঘটলো কেমন করে শুনে। একইভাবে মোক্তারই বা এই রুমে দু বছর কাটালো কি ভাবে? পরবর্তী তিন দিন আমি সাত্যকির রুমেই কাটিয়ে দেই। চতুর্থ দিন সন্ধ্যাবেলায় মোক্তার হস্টেলে ফিরে আসে। উল্লেখ্য যে সময় আমরা অধীর আগ্রহে ওর আগমনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।
মোক্তারের কথায়,
-আন্ডারগ্রাজুয়েটে পড়াকালীন আসানসোলের অনির্বাণ ছিল আমার রুমমেট। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী অনির্বাণের একটি অ্যাফেয়ার্স ছিল। মেয়েটি ছিল অপূর্ব সুন্দরী। দুজন দুজনকে অসম্ভব ভালোবাসতো। হোস্টেলে থাকলেও অনির্বাণ বলতো, সারাক্ষণ যেন ওর মন পড়ে আছে আসানসোলে। কিন্তু ওদের এই সম্পর্ক বেশি দিন টেকেনি। মেয়েটির বাড়িতে সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ায় অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করে। মেয়েটিও ছিল খুব জেদি। সে বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারিনি। নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যা করে বসে। খবর পেয়ে অনির্বাণ ছুটে যায় আসানসোলে। খুব বিমর্ষ হয়ে পরদিন হোস্টেলে ফিরে আসে।ফিরে এসে সেদিন কারো সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। আমি উপযাজক হয়ে বেশ কয়েকবার ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। কোন লাভ হয়নি। এক সময় আমি নিজের পড়াশুনার মধ্যে ঢুকে পড়ি। আনুমানিক সাড়ে বারোটা নাগাদ হঠাৎ ওর আত্মচিৎকারে দেখি ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। পাশের দেওয়াল মেঝেতে রক্তে ভরে গেছে। ও মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করছে। নিজের পেটে ছুরি চালিয়ে অনির্বাণ আত্মহত্যা করে। পুলিশি ঝামেলাগত কারণে কিছুদিন রুম সিল করে দেওয়া হয়। আমিও সাময়িকভাবে অন্যরুমে কাটিয়ে দেই। ইতিমধ্যে প্রত্যেকদিন রাতে প্রায়ই স্বপ্ন দেখি, অনির্বাণ যেন আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। আমি যেন আগের রুমে ফিরে যায় এবং আমাকে ভয় না পেতে অনুরোধও করে। ও আমার কাছে আরও জানায়, আমি থাকলেই নাকি এই রুমে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। আর তাহলেই অনির্বাণ এখানে নিশ্চিন্তে থেকে যেতে পারবে। এই স্বপ্নের কথা আমি কাউকে জানাইনি। হোস্টেল থেকে আমাকে অপশন দেয়া হয়েছিল অন্যরুম পছন্দের। কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। পুরানো রুমটি খুলে দেওয়ার পর শুরুতে একটু গা ছমছম করলেও কদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাই। আরও বেশ কিছুদিন পর নুতন একজন রুমমেট দিলে সেদিনও এমন ঘটনা ঘটেছিল। সেই রুমমেট ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। আমিও রুম ছাড়ার চিন্তা করছিলাম। কিন্তু অনির্বাণ সেদিনই স্বপ্নে আমার কাছে ক্ষমা চাইলো।ও আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে এলাও না করার কথা জানিয়ে দেয়।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মুক্তার আবার বলতে লাগলো,
- ভীষণ পারফিউম পছন্দ করতো ছেলেটা।সত্যিকথা আমি পারফিউমের ব্যবহার ওর কাছ থেকেই শিখেছি। সাধারণত দিনের বেলায় আমি ব্যবহার করলেও প্রায়ই রাতে সাড়ে বারোটা নাগাদ পারফিউমের মিষ্টি গন্ধে রুম ভরে যায়। আমি নাক দিয়ে তার সুবাস নিই। তখন বুঝতে পারি, ও এসেছে। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে বাল্বটি অফ করে দেই। শূন্যে কিছু কথা ওকে উদ্দেশ্য করে বলি। উল্লেখ্য জীবিত থাকাকালীন ও খুব খুশি হত ওর পারফিউমটাকে ভালো বললে। একবার জানিয়েছিল,ওর গার্লফ্রেন্ড নাকি ওকে উপহার দিয়েছে। যে কারণে তারপর থেকে বিশেষ ব্রান্ডের পারফিউমটি ও ব্যবহার করত।
কিছুক্ষণ দম নিয়ে মোক্তার আবারো বলতে লাগলো,
অনির্বাণের আত্মহত্যার ঘটনার পর থেকে হোস্টেলের কেউ এই রুমে থাকার সাহস দেখাত না। নতুনরা পরিচিত কারো না কারোর মাধ্যমে জেনে যেত এই রুমের ঘটনাটা। ফলে রুমমেট ছাড়াই দীর্ঘদিন আমি এই রুমে একাই থেকে এসেছি। সম্প্রতি আগের হোস্টেল সুপার অবসর নিয়েছেন। নবনিযুক্ত হোস্টেল সুপার আমার একার জন্য একটা রুম না ছাড়তে বোর্ডার দেওয়ার মনস্থির করেন। আর তাছাড়া এটা হোস্টেল কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। আমিই বা বলি কেমন করে অনির্বাণের কথা। কতৃপক্ষের সেই সিদ্ধান্তের ফলেই নতুন বোর্ডারের আগমন। আসলে আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারিনি যে আমার সঙ্গে অনির্বাণও এই রুমে থাকে।
এতক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম।মোক্তারের কথা শেষ হতেই চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বুকে যেন এতক্ষণ একটা জগদ্দল পাথর চাপা ছিল। এবার অনেকটা হাল্কা হাল্কা অনুভব করি। বিষয়টি পরিষ্কার হয় যে আমারও তল্পিতল্পা গুটিয়ে রুম ছেড়ে চলে অন্যত্র চলে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-পোস্টটি আমার অত্যন্ত প্রিয় পদ্ম পুকুর ভাইকে উৎসর্গ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০২১ রাত ৯:১৫