রমিসা বুবুকে খুব শীঘ্রই আবার দেখা করতে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে আসি ঠিকই কিন্তু বুবুর জীবনে অজানা রহস্য জানার তীব্র বাসনা মনের মধ্যে উথাল পাথাল করতে থাকে। তাই শ্রেয়সীকে নিয়ে ফেরার পথে মনে মনে স্থির করি সম্ভব হলে পরদিনই আবার বুবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব। পরিকল্পনা মাফিক পরদিন সক্কালে হাজির হই বুবুর বাড়িতে। যথাযথ নির্দেশনা অনুসরণ করায় বাড়ি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়নি। সাতসকালে দরজার সামনে আমাকে দেখে বুবু যেন চাঁদ হাতে পায়। মাত্র একরাতের ব্যবধানে আমাকে পাবে, ভাবতেও পারেনি। এমন অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে বুবুর চোখে মুখে খুশির ঝলকানি বয়ে যায়। উল্লেখ্য বুবুর এমন আন্তরিকতা ভিতরে ভিতরে আমাকে মুগ্ধ করে। আমিও আমার শৈশবে হারানো বুবুকে ফিরে পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।
কথা বলতে বলতে চোখ পড়ে ওর ঘরের অন্দরমহলে। ঘর না বলে ঘুমটি বলাই ভালো। চারদিকে বাঁশের দরমা দিয়ে ঘেরা, মাথার ওপর ত্রিপলের ছাউনী। তারি একপ্রান্তে রান্নার জিনিসপত্র থরেথরে সাজানো। আপাতদৃষ্টিতে দারিদ্রতার ছাপ থাকলেও পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো ঘুমটিকে দেখে যথার্থই 'শান্তি কুটির' বলেই মনে হলো। এরইমধ্যে আমাকে কোথায় বসতে দেবে তা ভেবে বুবু শশব্যস্ত হয়ে পড়ে।বুবুর উদ্বিগ্নতা দেখে আমি বেশ লজ্জায় পড়ি। মুখ দিয়ে বলেও ফেলি সে কথা,
-এত ব্যস্ত হওয়ার কি আছে রে? আমি কি বিরাট কিছু হনু হয়ে গেছি যে তোকে এতটা ব্যস্ত হতে হবে?
কিন্তু কে শোনে কার কথা। বুঝলাম কথায় কোনো কাজ হবে না। যথারীতি সে ইতিউতি খুঁজতে লাগলো। এবার নিরুপায় হয়ে তার দুই হাত ধরে দরজার মুখে দাঁড় করিয়ে গলা বাড়িয়ে সামান্য ভিতরে উঁকি দিতেই হাতের কাছে একটা চেয়ার পেয়ে যাই।ওটাকে বাইরে টেনে বসে পড়ি।চেয়ারটির মধ্যেও ছিল দারিদ্রতার ছাপ। একটা পা ভাঙ্গা থাকায় সরু একটা কাঠ দিয়ে জায়গাটা শক্ত করে বাঁধা ছিল। একবার দেখেই বিষয়টি নজরে আসে। এমন চেয়ারে পড়ে যেতে পারি ভেবে বুবু ওটিকে কেড়ে নিতে এগিয়ে আসে। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে শাসনের সুরে বলি,
-তুই এত ব্যস্ত হোস না তো। সাবধানে বসছি আমি। পড়বো নাকো, বলে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার চেয়ারটিকে খুঁটিয়ে দেখে নিই। সত্যিই একটা গোটা পা-ই ভাঙ্গা। ভাঙ্গা জায়গাটা অবশ্য কাঠ দিয়ে বাঁধা ছিল। তবে ঐ অংশটা বাদ দিলে বাকি চেয়ারটিকে বেশ শক্তপোক্ত বলেই মনে হলো। কাজেই চেয়ার ভাঙ্গার বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে আসল কথায় আসি,
-আচ্ছা বুবু গতকাল থেকে একটা প্রশ্ন সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাকে বিষয়টি বোঝাত তো দেখি।মুজাহিদের সঙ্গে তোর বিয়ে হল। তারপর দীর্ঘ দিন ধরে থাকলি নিরুদ্দেশ হয়ে। আজ এতো বছর পর এমন একটি অচেনা জায়গায় তুই এলি কীভাবে? আর সেই মুজাহিদই বা গেল কোথায়?
বুবু আমার কথা শুনতে পেল বলে মনে হলো না। অথচ আমি বেশ জোরে জোরেই কথাগুলো বলেছিলাম। অবশ্য শুনতে পেলেও হয়তো বা প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছে। সম্ভবত একারণেই নিজে থেকেই অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। স্নেহের সুরে বলল,
-এই মনা একটা ভুল হয়ে গেছে রে।
আমি মুখ তুলে তাকালাম।ঘরের আবছা অন্ধকারের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে আবারো বলল,
- এ মনা ও হল রেহেনার আব্বা।
বুঝলাম বুবুর মেয়ের নাম রেহেনা।বুবুর কথা মতো কুশল বিনিময় করতে ভদ্রলোকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেও ওনার আমাদের দিকে সামান্যতম আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না। নিজের মতো শুয়ে আছেন ঠিকই কিন্তু মাঝে মাঝে তীব্র কাশি ওনাকে তিন/চার ইঞ্চি উপরে তুলে ছুড়ে ফেলছিলো। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে উনি ভয়ানক অসুখে ভুগছেন।
আমি সারল্যতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করি,
-বুবু উনার কি হয়েছে?
-ওর ফুসফুসে একটা ঘা হয়েছে। কতো বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। আগে তবু একটু হাঁটাচলা করতে পারতো কিন্তু এই মাসখানেক হলো আর উঠতে বা দাঁড়াতে পারেনা। একটুতেই ভয়ানক হাঁপাতে থাকে। সঙ্গে কাশি তো আছেই। মাঝে মাঝে কাশিতে রক্ত আসে। একবার শুরু হলে যেন থামতেই চায় না। রাতের বেলা ঘুম ওর হারাম হয়ে গেছে মনা। সারাক্ষণই কেবল কেশেই চলে। ভোরের দিকে যদিওবা একটু ঘুমায় তবে তা বেশিক্ষনের জন্য নয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে আবার যা তাই। আজও যেমন সারারাত কেশে কেশে নিস্তেজ হয়ে ভোরবেলা থেকে একটু ঘুমাচ্ছে। সারাদিন এক প্রকার শুয়েই থাকে। মাঝে মাঝে ধরে বসিয়ে দেই।
-কি আশ্চর্য! একজন জলজ্যান্ত মানুষ চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ সেই অর্থে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো না? আমার কথা শেষ হতেই, বুব নীরবে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকে।পরে ধীর স্থিরভাবে বলল,
-ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা যে করিনি তা নয়, তবে টানতে পারিনি।আর টানবোই বা কেমনে? সামান্য উপার্জন করে যে কটা টাকা জমিয়েছিলাম সব খরচ হয়ে গেছে। আগে ও সাগরে যেত মাছ ধরতে।ঘাট থেকে শয়ে শয়ে ট্রলার ছাড়তো। দেড়/দুমাস ট্রলারে কাটিয়ে অনেক অনেক মাছ নিয়ে ওরা বাড়ি ফিরত। ওরা ফিরলে গোটাপাড়ায় উৎসব লেগে যেত।আর উৎসব লাগবে নাই বা কেন, ওদের ফেরার জন্য পাড়া শুদ্ধ সবাই যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম। মরশুমে জেলেপাড়ার কোনো বাড়িতে পুরুষ থাকতো না। সে একদিন গেছেরে মনা।
শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে রীতিমতো বুবুর গলা ধরে আসে। শাড়ির আঁচলটা মুখে পুরে বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আবারো বলতে লাগলো,
-এই সময়ে সংসারে যথেষ্ট সুদিন এসেছিল। কিছু পয়সা জমিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটাকে একটা ভালো জায়গায় বিয়ে দেব।পরে যা হাতে থাকবে তা দিয়ে দু কামরার একটি ইঁটের বাড়ি করার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার সে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। মেয়ের মন মজে ছিল পাড়ারই এক ছেলের সাথে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অমত করিনি। একমাত্র মেয়ে পাশেই থাকবে বলে মেনে নিয়েছিলাম।আজ মেয়েটাও যদি থাকতো সব কষ্ট লাঘব হয়ে যেতো। সাধ্যমত খরচ করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম।কিন্তু ওর কপালে সুখ লেখা ছিল না। প্রথম থেকেই শ্বশুর বাড়ির লোকজন ওকে খুব জ্বালা যন্ত্রণা দিত।প্রায়ই বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দিতো। প্রথম প্রথম বেশ কয়েকবার সামান্য হলেও সে আবদার মিটিয়েছি। কিন্তু একসময় সে চাপ অত্যধিক বেড়ে যায়। আচ্ছা তুই বল দেখি মনি কাহাতক এইভাবে দিয়ে দিয়ে পারা যায়? এই নিয়ে রাতদিন লেগেই থাকতো অশান্তি। বিয়ের মাস পাঁচেক পর একদিন বৈকালে খবর আসে মেয়ে নাকি ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে।
কিছুক্ষণ দম নিয়ে বুবু আবারো বলতে লাগল,
-খবর পেয়ে ছুটে গেছিলাম তক্ষুনি। কিন্তু গিয়ে দেখি সব শেষ! চোখের সামনে মেয়ের নিথর দেহ নিয়ে লোকটা পাগলের মত আচরণ করতে থাকে। নিজের বুক চাপড়াতে থাকে।মেয়ে হারানোর শোক ওর বাপ নিতে পারেনি। হাসিখুশি লোকটা এরপর একদম বদলে গেল। বাইরে বের হতো না। সারাক্ষণ ঘর আর ঘরের মধ্যে কাটিয়ে দিত। একদম চুপসে গেছিল লোকটা। পাঁচটা কথা বললে একবার উত্তর দিত, কখনোবা দিতোই না। এ সময় থেকেই একটু একটু করে কাঁশতে থাকে। প্রথমে বিষয়টিকে পাত্তা দেইনি। পরের দিকে কাশি বাড়লে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। পরে আরও বড় ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। ফুসফুসের ইনফেকশন অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে। ডাক্তার বাবু ওষুধ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঔষধে কাজ না হলে আর কিছু করার নেই বলে জানায়। অন্য আরেকজনের কাছেও গেছিলাম। তিনিও একই কথা বলে দিয়েছেন। এদিকে দিনকে দিন ওর স্বাস্থ্য ক্রমশ ভাঙতে থাকে। এখন এই ভাবেই যে কটা দিন যায়।
এসেছিলাম বুবুর পূর্ববর্তী জীবন সম্পর্কে জানতে। শিশুকালের সেই প্রাণোচ্ছল মেয়েটার বর্তমান জীবন যে এতোটা বেদনার; এতোটা যন্ত্রণাক্লিষ্ট শুনে তার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে নতুন করে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে মন সায় দিলো না। চুপচাপ বসে রইলাম। আর সামান্য দূরে রেহেনার বাপের ঘনঘন কাশির শব্দ ছাড়া এক প্রকার নিঃশব্দেই সময় অতিবাহিত হতে থাকে। আমার মন পড়ে ছিল তার ফেলে আসা জীবনের উপর। পরিবেশ অনুকূলে না থাকা সত্ত্বেও একসময় একপ্রকার নির্বোধের মতো জিজ্ঞেস করি,
- আচ্ছা বুবু তোর এই অবস্থা হল কীভাবে?
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
- একদম ভালো না লাগে না রে মনা পিছনে ফিরে তাকাতে। জীবনে যে টুকু সুখ শান্তি পেয়েছি তা রেহেনার বাপের জন্য। কিন্তু উপরওয়ালা সেটুকুও এখন কেড়ে নিতে চলেছে। তাই এসব নিয়ে আর ভাবতে ভালো লাগে না। কপালে যা আছে তাই হবে।
খানিক বাদে বুবু আবার মুখ খোলে,
-ছোট থেকে তোর বড় বুবুর সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। সেই কোন ছোটবেলায় ওকে সই বলেছিলাম। সারাক্ষণ তো তোদের বাড়িতেই পড়ে থাকতাম। এক ক্লাসে পড়লেও প্রাইমারির গন্ডি টপকালে আব্বা আর স্কুলে যেতে দেয়নি। মুসলমানের মেয়ে সেয়ানা হচ্ছি, ফ্রক পড়ে ড্যাংড্যাং করে স্কুলে গেলে বেআব্রু হয়ে যাবে। উল্টে আব্বা এখন থেকে আরো বেশি করে বাড়ির ভেতরে পর্দানশীন হয়ে থাকতে বলতো।আব্বার কথা অমান্য করিনি। তবে তোর বুবুকে স্কুলে যাওয়া দেখে আমারও একবার খুব সাধ জেগেছিল অমন করে বই খাতা নিয়ে স্কুলে ভর্তি হই।দাদিকে একথা বলতেই এমন করে বুড়ি হম্বিতম্বি শুরু করে যে না জানি আমি মহা কোনো অপরাধ করে ফেলেছি। সাথে জানালো, তোর বুবুই নাকি আমার মাথা খেয়ে ফেলছে।আব্বাকে বলে তোদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করার হুমকি দিলে আমি সেদিন খুব ভয় পেয়ে যাই। ছোট মনে তোদের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ নষ্ট হবে ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। তাই আর কখনো মুখে স্কুলে যাওয়ার কথা আনবো না বলাতে সে যাত্রায় দাদির হাত থেকে রেহাই পাই। তবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলেও বাড়িতে কোরআন শিক্ষা চলতে থাকে।বেশ কয়েকবার এই সময়ে কোরআন শরীফ শেষ করি। আমার গলার সুরেলা কোরআন তেলাওয়াত দাদি খুব পছন্দ করত।প্রায়ই বুড়ি বায়না করতো যাতে একটু কোরান পড়ে শোনাই। ঠাট্টা করে বলতো একমাত্র হাফেজ জামাই নাকি আমাকে যথাযথ মূল্য দেবে। আমি লজ্জায় অন্যদিকে পালিয়ে যেতাম।
বুবু আরও বলতে লাগলো,
-আমার এক খালাতো ভাই রফিক, উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরে হেফজো পড়তো। মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে আমগাছে বালির বস্তা বেঁধে ঘুষি মারত। আমরা হাসতাম ওর কান্ডকারখানা দেখে।ওর কাছ থেকেই প্রথম শুনি এটা নাকি ক্যারাটে শেখার কৌশল। খালি হাতে শত্রুকে ঘায়েল করতে হলে ক্যারাটে জানা দরকার।মাদ্রাসায় হেফজো পড়ার পাশাপাশি নাকি ওদের ওসব কিছুরও শিক্ষা দেওয়া হতো। রফিক ভাই যখনই বাড়িতে আসে আমাদের বাড়িতেও দেখা করতে আসত। একবার রাতে আসে সঙ্গে বিরাট লম্বা আলখাল্লা পরিহিত এক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে। নাম ওনার মুজাহিদ।বাড়ি বাংলাদেশের কালীগঞ্জে হলেও অত্যধিক ধর্মপ্রাণ মানুষটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সুদূর আফগানিস্থানে লড়াইয়ে ব্যস্ত।এমন একজন লোকের বিবি হতে পারা মানে আখেরাতে বিরাট নেকি হাসিল করার সুযোগ পাওয়া। বাড়ির লোক পারলে প্রথম দিনেই ওনার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। আমার মতামতের কোনো দাম ছিল না। যদিও আমার দিক থেকে এমন লোককে বিয়ে তো দূরের কথা প্রথম দেখাতেই আমি ভয় পেয়ে যাই।পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা এত লম্বা একজনকে বিয়ে করতে রাজি নই বলাতে দাদি আমাকে এমন ধমক দিল এবং সাথে জানালো, বিয়ের কথা মেয়েদের মুখে আনা মানে চূড়ান্ত বেশরম নির্লজ্জের কাজ। সেদিন দাদির কাছে ধমক খেয়ে আমি আর টুঁশব্দটি করার সাহস করিনি।
মুজাহিদ দুদিন থেকে চলে যায় নিজের দেশে।ফেরে এক সপ্তাহ পরে। সঙ্গে প্রচুর গয়নাগাটি নিয়ে আসে। যা দেখে বাড়ির সকলের মত আমারও মাথা ঘুরে যায়। সাক্ষাৎ রানী হওয়ার স্বপ্নে তখন থেকে বিভোর হয়ে উঠি। শুধু গয়নাগাটি নয় বিয়ের যাবতীয় খরচপাতিও মুজাহিদ বহন করে।আব্বাকে নাকি সে আরও অনেক টাকা দিয়েছিল। খুব প্রশংসা করত আব্বা মুজাহিদের। এমন একজন ভালো ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ায় আব্বা রীতিমতো গর্বিত ছিল। যাইহোক মুজাহিদ বিয়ের পর কিছুদিন আমাকে শ্বশুর বাড়িতে রাখার কথা বলে। পরে সুযোগ সুবিধামতো আফগানিস্তানে নিয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেয়। আব্বাকে জিজ্ঞেস করে একাকী কালীগঞ্জে রাখতে আপত্তি আছে কিনা। কিন্তু বিয়ের পর মেয়েদের যাবতীয় দায়দায়িত্ব স্বামীর উপর পড়ায় আব্বা, ও তোমার নিজস্ব ব্যাপার; এতদিন মেয়েকে নিয়ে অনেক ভেবেছি এখন ভাবনা তোমার বলে সাফ জানিয়ে দেয়। পরে আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমিও জানিয়েছিলাম, তুমি যেখানে নিয়ে তুলবে সেখানেই যাবো। তবে একাকী থাকতে রাজি নই। আসলে মুজাহিদের অমায়িক ব্যবহারে এত অল্প সময়ের মধ্যে বাড়িসুদ্ধ আমরা সকলেই এতটাই ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম যে ওর কোনো কথা কখনোই সন্দেহের বলে মনে হয়নি।
কালীগঞ্জে যেতে বলেছিল ঠিকই কিন্তু ও চাইছিল আমি যেন ওর সঙ্গেই থাকি।তাই সে যেখানেই থাকুক।ফলে ওকে ছাড়তে রাজি না হওয়ায় ও খুব খুশি হয় এবং আমাকে নিয়ে আফগানিস্তানের পথে রওনা দেয়।আর এখান থেকেই শুরু হয় আমার জীবনের বিভীষিকাময় পর্ব। অসম্ভব ঠান্ডা মাথার লোক ছিলো মুজাহিদ। মেপে মেপে খুব ছোট ছোট করে ধীর স্থির ভাবে কথা বলতো। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনতাম। ওর কথা বলার গুনে বাড়ির সকলকে ও বশ করে ফেলেছিল। জানিয়েছিল ওর নাম যেমন মুজাহিদ তেমনি ওরা যুদ্ধও করছে মুজাহিদ নামে। আরো জানিয়েছিল, কেন ওরা নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সুদূর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছে? বিদেশি শক্তির অত্যাচারে ওদেশের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত; বিপন্ন ইসলাম।আর তাই ওরা মরণপণ সংগ্রাম করছে। যে করেই হোক বিদেশী শক্তির উৎখাত ওরা করবেই।
বুবুকে একটু থামিয়ে দিয়ে বলি,
-বুবু মুজাহিদ তোকে এমন বোঝালেও ওটা সবটা বিদেশী শক্তি ছিল না।১৯৭৮-৭৯ সালে ওদেশে ক্ষমতায় আসে 'পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্থান' নামে একটি কমিউনিস্ট দল। যাকে সংক্ষিপ্তভাবে পি ডি পি এ বলা হতো। এরা ছিল আমাদের রাজ্যের বামফ্রন্টের মতই একটি কমিউনিস্ট দল। এখন কমিউনিস্টরা ধর্ম মানে না বা তাদের অনুদার নীতি যে কারণেই হোক এই সরকারের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনগণ বিদ্রোহ করে। শুরুতে বিদ্রোহ দমন করতে সরকার যথেষ্ট বেগ পায়। নিরুপায় সরকার একসময় প্রতিবেশী কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যপ্রার্থী হয়। মূলতঃ কম্যুনিস্ট সরকারকে সাহায্য করতেই ও দেশে সোভিয়েত সৈন্যের প্রবেশ ঘটে। আর এই সোভিয়েত সৈন্যের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতেই ওদের সরকার বিরোধীদের সঙ্গে বিদেশি ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা মুজাহিদের তালিকায় নাম লেখায় ও গেরিলা যুদ্ধে নেমে পড়ে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য আফগানিস্তানে তৎকালীন সরকার বিরোধী এই মুজাহিদের অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছিল কিন্তু তৎকালীন বিশ্বের আরেক শক্তিধর দেশ আমেরিকা।
বুবু বিরক্ত হয়ে,
- আরে ধুর! আমি অত লেখাপড়া শিখিনি।এসব জটিল বিষয় আমার মাথায় ঢুকবে না। জেনেও আমার কোন কাজ নেই।
সাময়িক থেমে বুবু আমার বলতে লাগলো,
- মুজাহিদ আমাকে আরো বলেছিল,প্রতিটি মুসলমানের উচিত এই যুদ্ধে অংশ নেওয়া। তবে সবাইকে যে বন্দুক হাতে লড়াই করতে হবে তা নয়।কেউ অর্থ দিয়ে কেউবা সময় দিয়ে নিজেদেরকে যুদ্ধে শামিল করতেই পারে। এমনকি নারীরাও মুজাহিদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে যুদ্ধে অংশ নিতে পারে। মনে মনে আমি শিহরিত ছিলাম যদি কোনভাবে নিজেকে এই যুদ্ধে অংশ নিতে পারি তা ভেবে। ও জানিয়েছিল তাড়াহুড়ার দরকার নাই। পরিস্থিতিই একজনকে ঠিক করে দেবে কখন তাকে যুদ্ধে নামতে হবে। আমাকে সতর্ক করে বলে, বিধর্মীদের শাসন চলায় ওদেশে গিয়ে খুব ঘেরাটোপের মধ্যে থাকতে হবে। ইচ্ছামত বাইরে বের হওয়া যাবেনা। যদিও ওর মুখে এসব কথা শুনে মনে মনে প্রচন্ড ভয় পাই।এ আল্লাহ কোথায় যাচ্ছি! বাস্তবে একসময় আমরা শুষ্ক রুক্ষ বালুর দেশে পৌঁছায়। বুঝতেই পারি আবহাওয়া আমূল বদলে গেছে। বাতাসে যেন গা পুড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। সঙ্গে কানে আসতে থাকে ঘনঘন ভারী কিছুর শব্দ। মুজাহিদ জানায়, ওগুলো গোলাগুলির আওয়াজ। ওসবে কান না দিতে। জিজ্ঞেস করতেই বুঝি,হ্যাঁ আমরা আফগানিস্তানে ঢুকে গেছি। একটা সময় ও আমার যাবতীয় গয়নাগাটি নিয়ে নেয়। বিদেশে মেয়েলোকের কাছে গয়নাগাটি রাখা নিরাপদ নয় বলাতে এক কথায় ওর কাছে জমা দেই।এর মধ্যে আমার মা ও দাদির দেওয়া সামান্য গয়নাও ছিল। অবশেষে এক সন্ধ্যারাতে আমরা একটা পুরানো বাড়িতে হাজির হই। মুজাহিদ টর্চ ফেলে আমাকে পথ দেখাতে থাকে। উল্টো দিক থেকে আরেকটি টর্চের আলো পড়ে আমার মুখে। শুরুতে অন্ধকার ঘরটিতে ঢুকতেই আমার গা ছমছম করে ওঠে। গোটা বাড়িতে আর কোন জনপ্রাণী আছে বলে মনে হলো না। আর থাকলেও তাদের কোন টুঁ-শব্দ আমার কানে এলো না।
তো
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২২ রাত ১০:১৩