মুজাহিদ প্রথম দুদিন আমার সঙ্গে ছিলো। বেশ ভালো কেটেছিল ওর সঙ্গে ওই দুদিন। শুধুমাত্র ও সঙ্গে থাকায় অচেনা অজানা শুষ্ক রুক্ষ জায়গাটাও খারাপ লাগেনি। শুরুতে ঘরটা সম্পর্কে দু-চার কথা না বললেই নয়। যে ঘরে আমরা ছিলাম সেটা ছিল বসবাসের জন্য একেবারেই অযোগ্য।ঘরটির দরজা-জানালা না থাকারই মতো। একটা দরজা ও ছোট্ট একটা জানালা থাকলেও আর যাই হোক সেটাকে কোনভাবেই বাসগৃহ বলা যায় না। আমরা গ্রামের মানুষ, মাটির বাড়িতে জন্মেছি বড় হয়েছি। কত আলো-বাতাস ছিল ওখানকার ঘরগুলোতে। পাকা বাড়িতে থাকার সুযোগ কখনো হয়নি তাই এই বাড়িটির দরজা জানালাটা কম বলে মনে হলেও উচ্চবাচ্য করার সাহস পাইনি। যাইহোক শুরুতেই যে কারণে মনের মধ্যে একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ছোট্ট বদ্ধ জানলাটিকে প্রথম দিন একবার খোলার কথা ভেবেছিলাম। পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সবে জানালায় হাত দিতেই মুজাহিদ মুখ থেকে অস্ফুটে এমন একটা শব্দ করে রেরে করে আমার দিকে ছুটে আসে, যেন আমি কোনো মহাপরাধ করে ফেলেছি। আঙ্গুল উঁচিয়ে সাবধান করে, ভবিষ্যতে যেন কখনোই জানালা না খুলি। ওর অমন ছুটে আসার ভয়ানক দৃশ্যটি আমার কাছে নতুন ঠেকে।পরে আর কখনও যে কারণে জানালা খোলার কথা মাথায় আনিনি।
ওখানে পৌঁছে প্রথম থেকে রান্নাঘর খুঁজছিলাম। ওকে সেকথা বলাতে জানিয়েছিল,
- ও সবের প্রয়োজন হবে না। যখন যা দরকার হবে বাইরে থেকে আনিয়ে নেব।
মনে মনে খুশি হই এই ভেবে যে আমাকে তাহলে রানী করেই রাখবে।
শুধু মুখের কথা নয় কাজেও মিল পাই। প্রথমদিন থেকেই খাবার-দাবার আসতো সব বাইরে থেকে। জীবনে কখনোও বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ফলে বাইরের খাবারের সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না। মুজাহিদের কল্যাণে জীবনে প্রথম এমন সুযোগ পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। বাইরের খাবার খেতে খারাপ লাগতো না। তবে অসুবিধা ছিল তিনবেলা অমন মোটা মোটা রুটি কিছুতেই যেন গলার ওপাশে যেতে চাইতো না। এমন রুটি বাপের জীবনেও দেখিনি। ওকে জিজ্ঞেস করতেই জানিয়েছিল, মোটামোটা রুটিগুলোকে নান রুটি বলা হয়। দ্বিতীয় দিন অবশ্য মুজাহিদ ওদেশের একটা বিশেষ ভাতের ব্যবস্থা করেছিল।নাম বলেছিল আফগান পোলাও।বেশ ভালো লেগেছিল পোলাও খেতে। তবে পরিমাণটা ছিল বেশ কম। পেট ভরাতে চাইলে মূলত মোটা মোটা রুটিই খেতে হবে। আমার তো আবার এমন মোটা রুটি পরের দিকে দুচোখের শত্রু হয়ে ওঠে।
তৃতীয় দিন সকাল থেকেই মুজাহিদকে খুব অস্থির লাগছিল। দুপুরে কোন এক সময় জানালো,
- আমাকে আজ সন্ধ্যায় বের হতে হবে। ও চলে যাবে জানতাম তাই বলে আজি সন্ধ্যায় বের হবে শুনে আঁতকে উঠি। এমন অপরিচিত জায়গায় ওকে ছেড়ে একাকী থাকতে হবে ভেবে ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠি। বাইরে যেখানে প্রায়ই গোলাগুলির শব্দ কানে আসে। গত তিনদিনে যা অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে। এক্ষণে নিজের দুর্ভাবনাকে প্রকাশ না করে অন্যভাবে বায়না ধরি,
- আমি একাকী থাকতে পারবো না। তারচেয়ে বরং তুমি যেখানেই যাও আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো।
আমার কথা শুনে মুজাহিদ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। কয়েক মূহুর্ত নীরব থেকে বলে,
- আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করতে এখানে আসিনি। এসেছি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। আমার কাজে বাঁধা দিও না।আর তোমার কাজও ঠিক করা আছে।
গত কয়েক দিনে যে লোকটারে আদর স্নেহ ভালোবাসায় হৃদয়ের গভীরে স্থান দিয়েছি আজ এক্ষণে তার মুখের কথা শুনে সেই আমিই যেন আকাশ থেকে পড়ি। কানের মধ্যে সমানে বাজতে থাকে ' আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে এখানে বসবাস করতে আসিনি'...আর তা যদি নাই বা হবে তাহলে আমার কাজটিই বা কি? তা নিয়ে মনের মধ্যে ঝড় বইতে থাকে। যার হাত ধরে বাবা-মা-ভাই-বোন ছেড়েছি; কয়েকশো মাইল দূরে পাড়ি জমিয়েছি; সেই লোকটি বলে কিনা আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য আলাদা। যাইহোক ঘটনার পর থেকে খুবই দুশ্চিন্তার পড়ি। হে আল্লাহ! এখান থেকে বের হবো কেমন করে- মনের মধ্যে এই প্রশ্ন সারাক্ষণ ঘুরপাক খেতে থাকে।
পূর্বঘোষণা মতোই সেদিন রাতের বেলা মুজাহিদ চলে যায়। যাওয়ার আগে একটা কথা বলে,
- যদি বেঁচে থাকি তাহলে আবার দেখা হবে....
মনে হলো একবার ওর পায়ের উপর আছড়ে গিয়ে পড়ি। শেষবারের মতো আটকে দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সংযত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। দুপুর থেকে মনে মনে নিজেকে তৈরী করছিলাম। কিন্তু বাস্তবে ও যখন চোখের সামনে চলে গেল তখন আমার পৃথিবীটা একেবারে শূন্য হয়ে পড়ে। আমি নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একবারও আমার চোখের দিকে বা মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে নি। নিজের সেই অসহনীয় ব্যথা কেমন করে যে বর্ণনা করি। কি ভয়ানক নিষ্ঠুর লাগছিল ওকে। অবশেষে সন্ধ্যা নামতেই লোকটা অন্ধকারে মিলিয়ে হয়ে গেলো।
ও চলে যাওয়ার পর শূন্য হৃদয়ে গভীর বেদনায় ঘরের ভিতরে চুপচাপ বসে থাকি। এমন সময় হুরমুড়িয়ে এক লোক ঘরে ঢোকে। শুরুতে আমি হতচকিত হয়ে যাই। একজন পরপুরুষ অন্যের ঘরে ঢোকেই বা কোন আক্কেলে? মুজাহিদের মতোই আলখাল্লা পরা লোকটা ঘরে ঢুকেই আমার কপালে বন্ধুক ঠেকিয়ে ওদের ভাষায় কি সব বলতে থাকে।
বুবুকে সাময়িক থামিয়ে দিয়ে বললাম,
- বুবু ওদের ভাষাটার নাম পুশতুন।
- ওদের কথা আর বলিস না মনা। ওদের কোনো কিছুই আমার শুনতে ইচ্ছা হয়না,বলে বুবু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দেয়।একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো,
- যে কথা বলছিলাম মনা।পশুটা কপালে বন্ধুক ঠেকিয়ে রাখায় বুঝতে পারি আজ আমার শেষ দিন। আমি জোরে কেঁদে ওঠায় সপাটে মারে এক চড় আমার মুখ লক্ষ্য করে।চড় গিয়ে লাগে আমার বাম কানের গোড়াতে। মূহুর্তে চোখে সব অন্ধকার দেখি।এর পরের ঘটনা আমার আর মনে নেই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন টের পাই আমার জামাকাপড় কোনোক্রমে আমার শরীরের উপর ছড়ানো।আর লোকটা একটু দূরে কি কাজে ব্যস্ত ছিল। চোখাচোখি হতেই দেখি ভয়ানক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মূহুর্তে মুজাহিদের শেষ কথাটি মনে আসে,
"আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করতে এখানে আসিনি। এসেছি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। আমার কাজে বাঁধা দিও না।আর তোমার কাজও ঠিক করা আছে।" এতক্ষণে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় এখানে আমার জন্য কি কাজ ঠিক করা আছে।যে কাজে ইতিমধ্যে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মনে মনে ভাবতে থাকি যদি কোনো দিন মুজাহিদকে সামনে পাই তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো,
-আমার মতো গরিব ঘরের মেয়েদেরকে ভোগের বস্তু করতেই কি বিয়ে নামক নাটক করে এবং গরিব বাবার হাতে কিছু পয়সা গুঁজে একপ্রকার কিনে এখানে নিয়ে এসে ধর্মযোদ্ধার নামে ফুর্তি করা? উল্লেখ্য সেদিন সারারাত ঐ পশুটাকে পাশে নিয়ে নীরবে বসে কাটিয়েছি। যতবেশি রাগ পশুটার উপর হয় তার চেয়ে শতগুণ রাগ ক্ষোভ দুঃখ মুজাহিদের উপর গিয়ে পড়ে। শুধুমাত্র ওর জন্যেই আমার এতবড় সর্বনাশ ঘটেছে।এসব ভাবতে ভাবতেই ভোরের সময় একটু ঝিমুনি আসে। হঠাৎ দুই হাতে আবার চাপ অনুভব করি। এবার আর কোনো প্রতিবাদ করিনি। একটি মেয়ের সর্বস্ব লুট হওয়ার পর আর বাধা দেওয়ার কিছুই থাকেনা। সর্বস্ব খুইয়ে নিজেকে তখন দুনিয়ার সবচেয়ে সহায় সম্বলহীন অভাগী বলেই মনে হয়। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি পশুটা আমার দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে দিচ্ছে। শরীর আমার; হাত পা আমার অথচ তাকে ইচ্ছামত ব্যবহার করার অধিকার আমার নাই। আমি এখন মুজাহিদদের কেনা পুতুল আর কি। মনে মনকে শান্ত করি, আমি তো ইতিমধ্যে নিজেই মরার উপায় খুঁজছিলাম। এবার যদি ওরা আরেকটু দয়া করে আমাকে শেষ করে দেয় তাহলে এই অভিশপ্ত জীবন আর বয়ে বেড়াতে হবে না। কিন্তু আমি ভাবলেই তো আর হবে না।তারা তো আমাকে নিয়ে আগে থেকেই ভেবে রেখেছে। হ্যাঁ ভোরবেলা পিছমোড়া করে বেঁধে ও ঠোঁটে আঠালো কাগজ চেপে বেরিয়ে যায় লোকটা। কষ্ট হলেও তার কোনো কাজে বাঁধা দেয় নি। আমার মনে তখন একটাই চাওয়া, এসবের ফলে যদি আমি মরে যাই তাহলে তার জন্য তো একটু কষ্ট সহ্য করতেই হবে।
নাহা! এভাবে হাত-পা-মুখ বেঁধে রাখায় কষ্ট সহ্য করে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। কিছুক্ষণ যেতেই বেশ হাঁপিয়ে উঠি। আমার গোঙ্গানিতে বা অন্য যে কোনো কারনেই হোক অনেকক্ষণ পরে আরেকটি লোক ঘরে ঢোকে। লোকটি আমার চেনা। তিনবেলা খাবার দিতে আসায় দরজার ফাঁক দিয়ে আমি তাকে দেখেছি। লোকটি একে একে আমার সব বাঁধন খুলে দেয়। ভেবেছিলাম ও আমার সঙ্গে একই আচরণ করবে। কিন্তু নাহা! বাঁধন খুলে লোকটা আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে অবশেষে মাথা নাড়তে নাড়তে বাইরে চলে যায়।ঘন্টা খানেক যেতেই পশুটা আবার ফিরে আসে।মনে হয় এতক্ষণ বাইরে কোথাও ছিল। সেদিন সারাদিন পশুটা আমার ঘরেই কাটিয়ে দেয়। সন্ধ্যার অনেক পর পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।
সেরাতে আমি একাই কাটিয়ে দেই। পরেরদিন সন্ধ্যায় আবার একজন আলখাল্লা পরা লোক ঘরে ঢোকে। লোকটি ঘরে ঢুকতেই আমি বুঝে যাই আমার করণীয় কি। ট্রেনে আসার সময় মুজাহিদ বলেছিল চাইলে আমরা প্রত্যকেই নিজেদেরকে এই যুদ্ধে শামিল করতে পারি। তবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের পদ্ধতি নাকি সবার এক নয়। বাস্তবে মাত্র কদিনেই বুঝে যাই আমিও একজন মুজাহিদ। তবে আমাকে ওদের মতো বন্দুক কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়না এই যা। এইভাবে একদিন বা কখনও দু'দিন বাদে বাদে এক একজন মুজাহিদের শারীরিক চাহিদা পূরণের সঙ্গে ঠিকানা পরিবর্তন করতে সংযোগকারী হিসেবে ব্যবহার করা হতো আমার ঘরটিকে।
বেশ কয়েকদিন যেতেই অসহ্য গরমে ও দিনের পর দিন না ইচ্ছা করে না খেয়ে থাকায় আমি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। কথা বলার শক্তি পর্যন্ত এ সময় হারিয়ে ফেলি। যদিও কথা বলার প্রয়োজন হতো না। ওরা আসতো আমাকে ভোগ করতে, এক বা দুদিন থেকে চলে যেতে। এ সময় শরীরের দুর্বলতা মনের দুর্বলতাকে কয়েক কদম পিছিয়ে ফেলে আমার হাটা চলার শক্তিকে একেবারে শেষ করে দেয়। দুর্বল শরীরের দুর্বলতার সঙ্গে সমানে বেড়ে ওঠে চাকা চাকা একরকমের চর্মরোগ।যার সঙ্গে ছিল অসম্ভব চুলকানো। বেশ কয়েকটি জায়গায় চুলকানো রীতিমতো ঘা আকার ধারণ করে।যদিও আমার এই শারীরিক দূরাবস্থা ওদের ভোগের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কয়েকদিন যেতেই এবার নুতন করে যোগ হয় অসম্ভব বমি। গ্রামে নুতন বিয়ের পর এমন বমি করতে দেখলে দাদির মুখে শুনতাম সে নাকি পোয়াতি হতো। পরিবারে নুতন সদস্য আসতে চলেছে।আমার এমন অবস্থায় নুতন দুশ্চিন্তা আমাকে খেয়ে ফেলে। মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দেয়।এ আল্লাহ আমার পেটে এ কার বাচ্চা? নুতন ভাবনা আমার দু চোখে অন্ধকার নেমে আসে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৪:২৫