গতকাল সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে সকাল থেকে রাজধানী ঢাকা তথা সারা বাংলাদেশে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত সন্দেহভাজন ৮০ দুর্নীতিবাজের নামের লিস্ট। সাংবাদিক মহল এবং বাংলাদেশের সচেতন ভোটাররা মানসিকভাবে রবিবার ৩০ সেপ্টেম্বরে এই লিস্ট দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
কিন্তু সাংবাদিকরা কোনো এক স্থান থেকে এই লিস্ট পেয়ে গেলেন বৃহস্পতিবার ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়। আর পত্রিকা পাঠকরা সংবাদটি পেলেন শুক্রবার ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে। প্রত্যাশিত সময়ের তিন দিন আগেই এই লিস্ট প্রাপ্তিতে সবাই প্রথমে হতচকিত হলেও পর মুহূর্তে ঝাপিয়ে পড়েন আলোচনায, সরাসরি অথবা ফোনে।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কেটে যাবার পর আলোচকরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন আরব্য রজনীর সৎ ব্যক্তি আলীবাবা ও প্রমাণিত ৪০ চোরের মতো এই ৮০ জন প্রমাণিত দুর্নীতিবাজ নন। যদিও এদের অনেকের নামেই দুর্নীতির অভিযোগ বাংলার বাতাসে মিশে ছিল।
কিন্তু এরা সবাই কি দুর্নীতিবাজ? মানুষ বুঝতে পারে এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আরো কিছু মাস অপেক্ষা করতে হবে। যেমনটা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে এর আগে সন্দেহভাজন ১৪২ জনের বিষয়ে।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় প্রথম ৫০ সন্দেহভাজন দুর্নীতি-বাজদের লিস্ট।
তারপর আরো চারটি লিস্টে, ৫১, ৩৯, ১
ও ১-এ মোট ১৪২ সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজের লিস্ট প্রকাশিত হবার পর এই বিশেষ কার্যক্রমটি কেন যেন থমকে দাড়ায়। হতে পারে অভাবিত বন্যা (সিরিয়াস), অপ্রত্যাশিত ছাত্র-শিক্ষক বিক্ষোভ (ভেরি সিরিয়াস), অবারিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি (ভেরি ভেরি সিরিয়াস) প্রভৃতি ইসুর মোকাবিলায় দুর্নীতিবাজদের লিস্ট তৈরির কাজটি আলীবাবা পেনডিং রেখেছিলেন। অথবা এটাও হতে পারে দুর্নীতি দমনে কর্মক্লান্ত আলীবাবা টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য কিছুদিন কর্মবিরতি নিয়েছিলেন। সে যাই হোক, কেন যে দুর্নীতিবাজ লিস্ট প্রণয়ন ও প্রকাশ প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে স্থগিত ছিল সেটা সাধারণ মানুষ কোনোদিনই জানবে না। যেমন তারা জানবে না বাংলাদেশি আলীবাবার প্রকৃত পরিচয়। অথচ গতকালই ছিল আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। ভাগ্যিস স্বদেশে তথ্য আদায়ের জন্য কেউ গতকাল উদ্যোগী হয়নি। হলে পরে আলীবাবা কি করতেন?
তবে সেই অজ্ঞাত পরিচয় সূত্রের কল্যাণে মানুষ মোট ছয় দফায় এখন জেনেছে ২২০ সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজের নাম। কিন্তু এখানেই কি ফুল স্টপ?
হায়! সাধারণ মানুষের সেটাও জানার উপায় নেই। কারণ পরিচিত সূত্র দুদক থেকে বলা হয়েছে, তারা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন। অর্থাৎ ভবিষ্যতে তাদের কল্যাণে আরো কিছু দুর্নীতিবাজের নাম প্রকাশিত হতে পারে। সুতরাং বহু পলিটিশিয়ান, বিজনেসম্যান, ইনডাসট্রিয়ালিস্ট ও বুরোক্র্যাটরা গতকালের প্রকাশিত সর্বশেষ লিস্টে না থেকেও স্বস্তি পাচ্ছেন না।
তবে তারা স্বস্তি পেতে পারেন, যদি তারা বিষয়টির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যান। নির্বাচনে জয়-পরাজয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভ-ক্ষতি এবং চাকরিতে প্রমোশন-ট্রান্সফারের মতো জীবনের সঙ্গে এখন ওতপ্রতোভাবে যুক্ত হয়েছে এনবিআর ও দুদক।
এই দুই প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব স্বীকার করে চলতে হবে সবাইকে। এটাই ২০০৭-এর সবচেয়ে বড় লেসন।
দুদকের সচিব বৃহস্পতিবারে জানান, তার সংস্থা এখনো এই সর্বশেষ লিস্টটি পায়নি। বিষয়টি বেশ আশ্চর্যের নয় কি? সাংবাদিকরা যখন লিস্টের ফটোকপিংয়ে ব্যস্ত তখনও দুদক সচিব লিস্টের অপেক্ষায় ছিলেন। কোনো দুর্নীতির কারণে কি এই লিস্ট প্রাপ্তিতে বিলম্ব হয়েছিল? নাকি সমন্বয়হীনতার কারণে? দুদকের কাজের সূচনা হয় লিস্ট প্রাপ্তির পর থেকেই। সুতরাং লিস্ট প্রাপ্তির বিলম্ব মানে দুর্নীতি দমনে বিলম্ব। দুদক সচিব জানান, তার প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে লিস্ট পাওয়ার পর রুটিন কাজ শুরু করবে।
তারা নোটিশ দেবে সন্দেহভাজনদের সম্পদ বিবরণী (ওয়েলথ স্টেটমেন্ট) তাদের কাছে জমা দেয়ার জন্য। এই নোটিশ প্রাপ্তির সাত কার্যদিবসের মধ্যে যদি সন্দেহভাজন কোনো কারণে সম্পদ বিবরণী দিতে অপারগ হন তাহলে আরো সাত কার্যদিবসের আবেদন তিনি করতে পারবেন। যদি এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সন্দেহভাজন তার সম্পদ বিবরণী পেশ করতে ব্যর্থ হন তাহলে দুদক তার বিরুদ্ধে তখন আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
বাংলাদেশ এখন মামলাদেশ। বাংলাদেশের রাজনীতি ইচ্ছুক, ব্যবসা মনস্ক এবং চাকরিজীবী মানুষকে আইনের এসব খুটিনাটি দিকগুলো জেনে নিতে হচ্ছে। আশা করা যায়, এসব জেনেশুনে ভবিষ্যতে তারা রাজনীতি, ব্যবসা ও চাকরির পথে পা বাড়াবেন। আর সেই বিপদসঙ্কুল পথে যদি তারা এগোতে না চান তাহলে টোয়েন্টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে মনোনিবেশ করতে পারেনÑ দেখায় নয়, খেলায়। সাউথ আফ্রিকাতে টোয়েন্টি টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খুবই সফল হয়েছে। বলা হচ্ছে ক্রিকেট এখন শুধু আনোয়ার চৌধুরীর রানীর অধীনস্থ কমনওয়েলথের ডজনখানেক দেশেই শুধু নয় গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়বে। প্রচুর টাকা আয় করা সম্ভব হবে শুধু ক্রিকেট খেলেই।
সুতরাং পলিটিক্স, বিজনেস, ইন্ডাস্ট্রি, চাকরি সব বাদ দিয়ে বঙ্গসন্তানরা ক্রিকেট খেলায় পারদর্শী হবার পথে যেতে পারেন। তখন কৃতী বঙ্গসন্তানরা টু টোয়েন্টি টু সন্দেহভাজনের লিস্টে নয় তারা উইসডেন বুকে টোয়েন্টি টোয়েন্টির কৃতী ক্রিকেটারদের লিস্টে স্থান পাবেন। গুড চ্যালেঞ্জ।
সে তো ভবিষ্যতের কথা।
কিন্তু এখন কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ৮০ সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজের সর্বশেষ লিস্ট প্রকাশের পর?
গতকাল গুলশান মসজিদে অভিজাত শ্রেণীর সমাবেশ থেকে শুরু করে বায়তুল মুকাররমের শ্রেণীবিহীন মানুষের সমাবেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।
বড় দুই পার্টিতে যারা সংস্কার বিরোধী তারা স্মাইল করেছেন, মৃদু হেসেছেন। তাদের সেই হাসি গ্রামীণ ফোনের স্মাইলের মতো কৃত্রিম ডিজাইন ছিল না।
অকৃত্রিম সেই হাসির ফাকে আওয়ামী প্রাচীনপন্থী এক নেতা জানতে চান, এখন তোফায়েল আহমেদ সুধা সদনের প্রতি একশ পার্সেন্ট আনুগত্য প্রকাশ করবেন কি?
ওদিকে বিএনপি প্রাচীনপন্থী এক নেতা প্রশ্ন রাখেন, এখন সাদেক হোসেন খোকা সংস্কার ভবনে যাবেন কি?
তবে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল উদ্দীপক প্রতিক্রিয়া সঞ্চারিত হয়েছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের মালিক ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাম লিস্টে থাকায়।
একজন ইউনিভার্সিটি টিচার বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আলো-স্টার অভিযান শুরু করেছিল। তাদের সেই অভিযান এখন কি থেমে যাবে?
গণিতের এই টিচার বলেন, গণিত প্রতিযোগিতার উদ্যোক্তা প্রথম আলোর গাণিতিক হিসাব কি ভুল হয়ে গেল?
একজন আওয়ামী পলিটিশিয়ান বলেন, প্রথম আলো তো সবই জানে। তারা জানে কোন পলিটিশিয়ানের বাড়িতে কটা কুকুর, বিড়াল, ময়ূর, হরিণ, শাড়ি, ঢেউ টিন, লোহা, পেরেক, ইত্যাদি আছে। আর তারা জানতো না তাদের মালিকের প্রকৃত কর্মকা-ের কথা! এটা কি বিশ্বাস করা যায়?
এই পলিটিশিয়ান এরপর গড় গড় করে আবৃত্তি করে যান রবি ঠাকুরের কবিতা, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে...
কিন্তু একজন বিএনপি পলিটিশিয়ান তার ক্ষোভ চেপে না রাখতে পেরে বলেন, ম্যাডাম খালেদা জিয়ার অপরাধ প্রমাণিত হবার আগেই তার বিরুদ্ধে প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক। তার পরেই ম্যাডাম জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। এখন সেই সম্পাদক তার মালিক সম্পর্কে কি লিখবেন?
এসব মন্তব্যে বোঝা যায় গতকাল ইফতারি পর্যন্ত যেসব আলোচনা হয়েছে তাতে একটিই রায় এসেছে। আর সেটি হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক অধিকার সর্বতোভাবে হারিয়েছে আলো-স্টার।
একজন ইংরেজি ল্যাংগুয়েজ প্রফেসর বলেন, স্টারের স্লোগান হচ্ছে উইদাউট ফিয়ার অর ফেভার। তাদের এই স্লোগানের এসিড টেস্ট হবে এখন। তারা কি দুদককে ফিয়ার করবে? নাকি লতিফুর রহমানকে ফেভার করবে?
সাধারণ পাঠকের এই অনুভূতি প্রতিফলিত হয় একজন পথচারীর মন্তব্যে। তিনি একটি বিলবোর্ড দেখিয়ে বলেন, ওই যে ওখানে লেখা, যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো। আসলে ওখানে লেখা উচিত যা কিছু কালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো।
এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী প্রতিক্রিয়া ছিল একজন মানব অধিকার কর্মীর। তিনি প্রশ্ন করেন, প্রমাণিত হবার আগেই কারো গায়ে দুর্নীতিভাজনের লেবেল এটে দেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? লিস্ট প্রকাশের পর কোনো পরিবারে নেমে এসেছে হতাশা, ভীতি এবং অনিশ্চয়তা। আবার অনেকে আশা করছেন বাংলাদেশ শিগগিরই দুর্নীতিমুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু যে কোনো সমাজেই তো মৌলিক মানব অধিকার রক্ষার দায়িত্ব সবারই।
ওই প্রতিক্রিয়াটি শুনে পাশেই দাড়ানো বাজারের থলি হাতে এক ব্যক্তি বললেন, আরে মিয়া রাখেন আপনার দুর্নীতি, মানব অধিকার এসব প্যাচাল। বাজারের দামের কথা বলেন। সেখানে আমার কি অধিকার আছে সেটা বলেন।
(বিঃদ্রঃ- বহুদিন পর আজকের যায়যায়দিনে শফিক রেহমানের এই লেখাটা পড়লাম। সময়োপযোগী এ লেখাটা বেশ ভালো লাগায় অন্যান্য ব্লগারদের জন্য তা এখানে দিলাম। )