somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাষ্ট্র, প্রতিনিধিত্ত্ব ও শ্রেণী: ১৯০৫ সালে ইতিহাসের ট্রেন মিস

১৯ শে মে, ২০১০ বিকাল ৪:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব Click This Link

দ্বিতীয় পর্ব:
আগের পর্বে কথা বলছিলাম, নওরোজির কংগ্রেস জন্মের পরবর্তী বিশ বছর সম্পর্কে। নওরোজি ১৮৮৬, ১৮৯৩ ও ১৯০৬ পরপর তিন বছর কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। বলছিলাম, বৃটিশ-ভারত কলোনী থেকে বৃটেনে সম্পদ পাচারের বৃটিশ নীতি, ফলে সম্পদ পুনর্বিনিয়োগের অভাব ভারতে দারিদ্রের কারণ - নওরোজির কেবল এতটুকু বুঝের উপর দাঁড়িয়ে বৃটিশদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন। কিন্তু এই চিন্তা থেকে তিনি করণীয় হিসাবে বৃটিশদের উৎখাত করা দরকার, এর জন্য তাঁর রাজনীতি সাজানো দরকার এতদুর সিদ্ধান্ত পৌছাতে পারেন নি। তাঁর চিন্তা এতদূর প্রসারিত হয়নি। তিনি বৃটেনে বসে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সহযোগে লেখালেখি করে বৃটিশদের মনোযোগ ফেরাতে, নীতি প্রভাবিত করতে সময় ব্যয় করেছেন। একাজে দেনদরবার ও তদবির করে গেছেন ফলাফলে যা স্বভাবতই পন্ডশ্রম বলে হাজির হয়েছিল।
নওরোজির কংগ্রেসের চিন্তার এই সীমাবদ্ধতা বা অভাব কাটিয়ে উঠতে চাইলে সেক্ষেত্রে প্রথমত বৃটিশ শাসন উৎখাত করার কথা ভাবতে হত। দ্বিতীয়ত, সেকাজে গেলে দেশের সম্ভাব্য মিত্র শ্রেণী কারা হতে পারে, কৃষির সংস্কার করে দারিদ্র কীভাবে ঘুচানো সম্ভব একথা ভেবে জমিদার-প্রজা সম্পর্কের অর্গলে কৃষক কী হালে আছে - এতদূর ভাবনা গড়ানোর মত চিন্তার হিম্মৎ নওরোজির কংগ্রেসেকে দেখাতে হ্ত। কিন্তু শ্রেণীগত বিচারে প্রজা-কৃষকের সাথে কোন ক্লাসএ্যালি, রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে তোলার কোন বোধ, উদ্যোগ, প্রচেষ্টা সেখানে ছিল না। বরং উল্টোটাই ঘটিয়েছেন পরবর্তীতে আমরা দেখব।
আসলে একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বাভাবিক মিত্র কৃষক এই সহজ তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ থেকে কোন হুশ, সচেতনতার ছাপই সেখানে ছিল না। এছাড়া অপর গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়: নতুন ভাবনায়, নতুন মানুষ ভারতীয় বা অন্য কোন একক পরিচয়ে সবাইকে নতুন এক রাষ্ট্রের আকাঙ্খায় নতুন রাষ্ট্রে সংগঠিত করার চিন্তার বিনির্মাণ - সেসব কাজের কথা ভাবা ছিল অনেক দূরের কথা।
মূলত নওরোজি ও তাঁর সাথীসঙ্গীরা পন্ডশ্রমে সময় ব্যয় করেছেন, তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করতে গেছেন, কেন বৃটিশ শাসক নীতি ভারতের পক্ষে অনুকুল করে ঢেলে সাজানো দরকার, আর এরই পক্ষে তদবির। লাগাতর এই পন্ডশ্রমের আরও প্রমাণ আমরা পাই - ১৮৯২ সালে [অর্থাৎ ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস পার্টি গঠন করার পরও] নওরোজি সেন্ট্রাল লন্ডনের Finsbury কমিউনিটির প্রতিনিধি হিসাবে বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্য (British House of Commons) নির্বাচিত হতে গিয়েছিলেন ও হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এতে বৃটিশ নীতিকে প্রভাবিত করার সুযোগ পাবেন। ভেবেছিলেন একজন বৃটিশ ও একজন কলোনী ভারতীয়র মধ্যে কোন তফাৎ নাই। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, বৃটেনের সাথে বৃটিশ-ভারতের সম্পর্ক রাজা-প্রজার, কলোনী লুন্ঠন সম্পর্ক; এমন কী স্বাভাবিক ব্যবসা, বিনিময় লেনদেনের সম্পর্কও সেটা নয়। ফলে সম্পদ লুন্ঠিত হয়ে ভারত থেকে বৃটেনের দিকেই গড়াবে এটাই স্বাভাবিক ছিল সেখানে; ফলে নওরোজির তৎপরতার এই পরিস্হিতিটা ছিল বিড়ালকে মাছ না খাবার জন্য আবদার জানানোর মত।
[প্রসঙ্গত একটা ছোট তথ্য জানিয়ে রাখি। ১৮৯২ সালের ঐ নির্বাচনের ক্যাম্পেনের সময় নওরোজি বৃটেনে পড়তে আসা বা বসবাসকারী তরুণ ভারতীয়দের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। মোহম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন এরকম আপ্লুত হয়ে সাড়া দেওয়াদেরই একজন। পরবর্তীকালে জিন্নাহ নওরোজির পলিটিক্যাল সেক্রেটারী হয়েছিলেন; এবং ১৯১৩ মুসলিম লীগে যোগদানের আগে পর্যন্ত নওরোজির কংগ্রেস রাজনীতি করে গেছিলেন।]

এছাড়া নওরোজির কংগ্রেসের অন্যান্য তৎপরতাগুলোর মধ্যে ছিল, বৃটিশ-ভারতের শাসন কাঠামোতে স্হানীয় সরকার পৌরকাউন্সিল জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভারতীয়দের অংশগ্রহণ, বৃটিশ সরকারী চাকরিগুলোতে নেটিভদের অন্তর্ভুক্তি - এসব নিয়ে দরবারের একটা দল হিসাবে টিকে ছিল নওরোজির কংগ্রেস।

১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ এই বিশ বছর নওরোজির কংগ্রেসের জন্য কম সময় ছিল না। কিন্তু নিজেকে অপ্রস্তুত, অগোছাল, বিভ্রান্ত রাজনৈতিক চিন্তায় আচ্ছন্ন করে রাখলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না; কড়ায় গন্ডায় প্রাপ্য আদায়ের প্রতিশোধ সে নিয়ে বসে। নওরোজি একদিকে বৃটিশ শাসকদের কাছে দেনদরবার করে দিন কাটিয়েছেন অন্যদিকে,ততই যেন বৃটিশ-শাসন উৎখাতের লক্ষ্যে কোন শত্রুমিত্রের ভেদাভেদের কোন লাইন খাড়া করতে পারা এবং নতুন কোন একক পরিচয়ে জনগোষ্ঠিকে সাথে নিয়ে সংগঠিত করার কাজ করা - এগুলোর গুরুত্ত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন; তাঁর চিন্তায় আসেনি। এই মারাত্মক অভাব নওরোজিসহ তাঁর কংগ্রেসকে পরবর্তীকালের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কর্তা নয় বরং ঘটনার পিছনে ছুটে কেবল হয়রানই হতে হয়েছিল।

পাঠক হয়ত লক্ষ্য করেছেন ১৯০৫ সালকে ইতোমধ্যেই একটা মাইল ফলক মানার চেষ্টা করছি। হ্যা তাই, ১৯০৫ সাল বিভ্রান্ত ও স্হবির রাজনৈতিক চিন্তার পালাবদলের সময়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুন হতে দেখার মত।

ভাইসরয় অফ বৃটিশ-ইন্ডিয়া, লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে ১৬ অক্টোবর বেঙ্গল প্রভিন্সকে ভেঙ্গে দুই আলাদা প্রশাসনিক প্রদেশে ভাগ কার্যকর করেন। "বঙ্গভঙ্গ" নামে খ্যাত এই ঘটনায়, পূর্ববঙ্গের সাথে আসামকে জুড়ে নতুন প্রদেশের নাম হয়, "ইষ্টার্ন বেঙ্গল এন্ড আসাম", ঢাকা যার রাজধানী। ওদিকে অবশিষ্ট বেঙ্গল অর্থাৎ ওয়েষ্ট বেঙ্গল উড়িষ্যার কিছু অংশ সাথে নিয়ে বেঙ্গল হিসাবে থেকে যায়, কলকাতাও ওর রাজধানী থেকে যায়।

বৃটিশ-রাজের "ডিভাইড এন্ড রুল" পলিসির কথা আমরা অনেক শুনেছি। প্রবাদটাকে আমাদের পছন্দ করার কিছু নাই; মনে হয় নিজের অযোগ্যতাকে ঢাকা দেবার চেষ্টা করছি আমরা। আমি যদি চোরের সিঁদ কাটার সব উপাদান নিজেই সংগ্রহ করে রেখে দেই তবে চুরি হয়ে যাবার পর চোরের বদলে প্রথমে নিজের অযোগ্যতার দিকে তাকানো দরকার - তাই নয় কি? আমি যদি ডিভাইড হয়ে যাবার সব উপাদান উপেক্ষা করে নিজের অযোগ্যতায় খোলা ফেলে রাখি তবে কেউ আমাকে ডিভাইড করে শাসন করলে সেটা কী সেই শাসকের দোষ? আসলে এটা অকর্মন্নদের আত্মপ্রসাদ লাভের হাস্যকর প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। ডিভাইড এন্ড রুলের কোন চিন্তা বৃটিশদের থাক আর নাই থাক, বঙ্গভঙ্গের কারণে ভারতীয় রাজনীতিতে মহা ওলটপালট ঘটে যায়। ভারতীয় জনগোষ্ঠি এক অনাকাঙ্খিত মেরুকরণ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষ এভাবে মোটা দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কোন একক পরিচয়ে বৃটিশ কলোনী শাসনের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে নতুন রাষ্ট্রে সংগঠিত হবার জন্য দাঁড়াবার বদলে উল্টা বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে সব সম্ভাবনা এখানেই শেষ হয়ে যায়।

মুল কারণ: বঙ্গভঙ্গকে পূর্ববঙ্গের প্রজাকৃষক প্রজামুক্তির সম্ভবনা পথে আলো হিসাবে দেখেছিল। ফলে সমর্থন জানিয়েছিল। পক্ষান্তরে কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু জমিদার, এলিট শ্রেণী জমিদারী হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যায়।
নওরোজির কংগ্রেস ২০ বছর সময় পেয়েছিল পূর্ববঙ্গের জমিদার-প্রজার সংঘাতময় সম্পর্কের ভিতর কৃষক প্রজার পক্ষে অবস্হান নেবার। যে কোন গণতান্ত্রিক মৈত্রী জোটে শেষ পর্যন্ত আপোষহীন লড়াইয়ে থাকে যারা সেই কৃষকদের পক্ষে দাঁড়াতে কংগ্রেস ব্যর্থ হয়। উপনিবেশী শাসকের ঔরসজাত ভূমি মালিকানা ব্যবস্হায় কৃষিতে জমিদারী প্রথার সুবিধাভোগী জমিদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার প্রয়োজন তাঁরা বুঝে নাই। অথচ কৃষক-প্রজারাই হতে পারত তার আপোষহীন লড়াকু সমর্থক, বন্ধু। বৃটিশ শাসকের বিরুদ্ধের লড়াইয়ে শত্রুমিত্র ভেদাভেদের মৌলিক লাইন তাঁরা গ্রহণ করে পারে নাই। কলোনী শাসনে বৃটিশ শাসকের সাথে ব্যবসায়ী হিসাবে নওরোজির সম্পর্কটা যে একমাত্র উৎখাতের এই মৌলিক তবে সরল প্রশ্নে সে আপোষের পথ ধরেছিল। ফলে নিজের কর্তব্য-কর্মে কোন ডিটারমাইন্ড অবস্হা তাঁর ছিল না - এটাই আমরা দেখতে পাই। একথার নীট মানে কর্তব্য কাজটা সে অবহেলা ও খাটো করে দেখেছিল। এটা অবশ্য নওরোজির কংগ্রেসের দেনদরবার করে বৃটিশ নীতি বদলাবার রাজনীতি ও খায়েশের সাথে মিল খায়। তাই , নওরোজির কংগ্রেসের এভাবে নতুন একক পরিচয়ের বিনুনি গেথে নতুন রাষ্ট্র গঠনের কাজের যে সুযোগ ছিল তা অবহেলায় হাতছাড়া করার শাস্তি কাফফারাসহ সুদে আসলে গুনা শুরু হয়ে যায় ১৯০৫ সাল থেকে। এটাই আমাদের আদি-পাপ শুরুর প্রথম পর্যায়।
বঙ্গভঙ্গের ঘটনা এই বয়ান এখানেই শেষ করে দিতে পারলে লেখার দৈর্ঘ কিছুটা কমত কিন্তু সেই সাথে তা বড় কিছু ভুল বুঝাবুঝি কারণ হবে, সেটা ভেবে - আরও একটু বিস্তারে যাবার দরকার অনুভব করছি।

আসলে পূর্ববঙ্গ মানে কী? মানে হোল, ১. কলকাতায় বসবাসকারী বেশীরভাগ জমিদারদের জমিনদারী অঞ্চল, প্রজা-কৃষকরা যেখানে ফসল ফলিয়ে না খেয়ে হলেও খাজনা পরিশোধ করে জমিদার-প্রজা সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখে। ২. যাতায়াত ব্যবস্হা যোগাযোগের দিক থেকে দুর্গম অবহেলিত অঞ্চল। ৩. বঙ্গভঙ্গের ফলে দেখা গেল পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মুসলমান, ফলে এবার ঢাকা রাজধানী হওয়াতে তা হয়ে গেল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ নতুন প্রদেশ।
তাই সবমিলিয়ে বঙ্গভঙ্গকে পূর্ববঙ্গ দেখেছিল এক ইতিবাচক প্রাপ্তি হিসাবে। আর ঠিক উল্টোটাই, কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু জমিদার, এলিট শ্রেণী; বঙ্গভঙ্গ তাদের সমুহ ক্ষতি বয়ে আনবে মনে করেছিল। কারণ, জমিদার যদি কলকাতায় থেকে যায় আর জমিদারী জমিন যদি থেকে যায় পূর্ববঙ্গে অথবা জমিদার নির্বিশেষে পূর্ববঙ্গে বসবাস করলেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গে কী জমিদারী টিকানো যাবে - এটা ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু জমিদার, এলিট শ্রেণীর সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। এই উদ্বেগ কেবল জমিদারদের নয়, জমিদারদের আয়ের উপর নির্ভরশীল সারা অর্থনীতিতে সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্বেগের বিষয় ছিল। কারণ গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জমিদারী কৃষিভিত্তিক পূর্ববঙ্গ ছিল অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতার কাছে ছিল কৃষির উদ্বৃত্ত্ব কলকাতায় সংগ্রহ ও জড়ো করার রেডি উৎস। রাজধানী কলকাতা ছিল সম্পদ কেন্দ্রিভুত হওয়ার স্হান; কলকাতার জৌলুসের উৎস, লাইফ-লাইন হলো পূর্ববঙ্গ। এটা কোন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নয়, পুঁজির আদি স্বভাব, খাসিলত। শহরে নতুন নতুন ব্যবসা-কারবার গড়ে তোলার সম্পদের যোগানদাতা সবসময় হয় কৃষির উদ্বৃত্ত্ব, আর নিজে থাকে অবহেলিত। পুঁজির এই খাসিলতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পদক্ষেপ না নিলে এটা এমনই ঘটে। এজন্য বলা চলে কৃষির উদ্বৃত্ত্বকে শুষে নিয়ে যেখানে পাহাড় জমিয়ে নতুন নতুন ব্যবসা-কারবার, নতুন উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় সে স্হানকেই বলে শহর । অবশ্য সাথে বাইজি নাচানো ধরণের বিনোদন-সর্বস্ব অপব্যয়, পয়সা উড়ানোর ঘটনাও সেখানে থাকে।
আর একটা কথা মনে করিয়ে দেই, কলকাতা তখন শুধু অবিভক্ত বাংলার রাজধানী ছিল না বরং ছিল সারা ভারতবর্ষের রাজধানী, ক্লাইভের আমল থেকেই কলোনী মাষ্টারের হেড কোয়ার্টার। দিল্লী নতুন রাজধানী হিসাবে উদ্বোধন হয় ১৯৩১ সালে।

কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু জমিদার, এলিট শ্রেণীর যারা "বঙ্গভঙ্গ রোধের আন্দোলন" করছিলেন (স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ) এরা কেউই তাদের আপত্তির কারণ হিসাবে জমিদারী হুমকির মুখে পড়া বা জমিদারী ঘটিত কোন ক্ষতির কথা কোথাও উল্লেখ করেন নি; দাবীও তুলেননি।
তাঁদের প্রকাশ্য আপত্তিটা ছিল বড়ই ট্রিকি এক ব্যাখ্যায়। কংগ্রেসসহ কলকাতার বিদ্বান এলিটরা এই প্রথম রাস্তায় নেমে দাবী করছিলেন, এটা বৃটিশ শাসকের আমাদের জনগোষ্ঠিকে ভাগ করার কৌশল (ডিভাইড এন্ড রুলের ব্যাখ্যা এখান থেকে শুরু) তাই তাঁরা এর বিরোধীতা করছেন।
আপাত দৃষ্টিতে আমাদের অনেকের কাছে এদাবী সঠিকই মনে হতে পারে। শুধু তাই না রাস্তার এই আন্দোলনকে আরও রেডিক্যাল করে দেখাতে বৃটিশ বিরোধী এক ন্যাশন্যালিষ্ট আন্দোলন হিসাবে এই প্রথম "ডাইরেক্ট এ্যকশনে" বৃটিশ পণ্য বিশেষত পোষাক বর্জনের আন্দোলন এর সাথে যুক্ত করা হয়েছিল।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় রাজধানী বেঙ্গল কেন্দ্রিক ভারতীয় জনগোষ্ঠি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করার কারণেই প্রথম বিভক্ত হচ্ছে এটা ডাহা মিথ্যা কথা। কলোনী শাসকদের হাতে জমিদারী ধরণের ভুমি মালিকানা ব্যবস্হা (১৭৯৩ সালের চিরস্হায়ী বন্দোবস্ত আইন) চালু হবার শুরু থেকে জমিদার বনাম প্রজা স্বার্থ তো বিভক্ত। জমিদার-প্রজা সম্পর্কের আষ্টেপৃষ্ঠে বাধায় চোখে পড়ার মত দগদগে ভাবে বিভক্ত হয়ে ক্বষক প্রজা তো আগে থেকেই ধঁকে মরছে। বৃটিশ শাসক ও এর স্হানীয় ভার্সন জমিদারদের স্বার্থ নিশ্চয় কৃষক প্রজার স্বার্থ নয়। এই বিভক্তি দেখতে না চাইলে দেখা যাবে না। জমিদার শোষণ, নিস্পেষণ, চাবুক মেরে নীল চাষে বাধ্য করা এগুলোর কথা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। তিতুমীরের ১৮৩১ সালে বাঁশের কেল্লায় জমিদার-বৃটিশ সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ ও মৃত্যুবরণ থেকে শুরু করে ফরায়েজী পর্যন্ত ধর্মীয় ডাকনাম নিয়ে বারবার ঘটেছে কৃষক বিদ্রোহ। আমরা চাইলে এগুলো আমাদের মনে থাকারই কথা। এই পশ্চাদপদ সম্পর্কগুলো না ভেঙ্গে কোন নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা ভাবা অসম্ভব। এবং কলোনী প্রভুর স্বার্থের সাথে গাটছাড়া বেধে আছে এমন থেকে থাকা স্হানীয় শ্রেণীগুলোসহ বৃটিশ শাসকের বিরুদ্ধে বাকি সবাইকে নিয়ে নতুন পরিচয়ে সংগঠিত হলে তবেই নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা ভাবা সম্ভব। তবেই ১৭৯৩ সাল থেকে চলে আসা বিভক্তিকে একটা ইতিবাচক রাজনৈতিক মেরুকরণে নেয়া যেত।

তাহলে দাড়াল, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ নতুন বিভক্তি নয় বরং পুরানো বিভক্তিকে ইতিবাচক রাজনৈতিক মেরুকরণ রোধ করে জন গোষ্ঠিকে অনাকাঙ্খিত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া। এবং সেই সাথে কংগ্রেস ও কলকাতার মাখন খাওয়া পরগাছা এলিট শ্রেণীর জমিদারদের পক্ষ নেয়াটাকে হটাৎ "জনগণ" বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে বলে নাকিকান্নায় জুড়েছিল।
এই বিষয়টাই অর্থাৎ বঙ্গের জমিদারী প্রসঙ্গে কংগ্রেসর অবস্হান কী - এটাই সবসময় কংগ্রেস অনুল্লেখে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। কলকাতার জমিদার যদি নওরোজির কংগ্রেসের কোলে চড়ে সত্যিই বৃটিশ বিরোধী রেডিক্যাল ন্যাশনালিষ্ট আন্দোলন করতে চায় আর প্রজাকে সে লড়াইয়ে পাশে পেতে চায় তবে আগে জমিদার-প্রজা সম্পর্কের কী হবে সেটা অবশ্যই পরিস্কার করে বলতে হবে। কমপক্ষে স্বাধীন নতুন রাষ্ট্র কায়েম হলে জমিদারী রদ করা হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। জমিদাররা নিজ স্বার্থে না পারুক কংগ্রেসকে তা পারতে হত। অথচ ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গে কংগ্রেস এমন ভাব করেছে যেন জমিদারী ভুমি ব্যবস্হা কোন জ্বলন্ত সমস্যাই নয়, কৃষক প্রজারা কোন নিস্পেষণে নাই। পরগাছা শ্রেণী যেভাবে জমিদারের পক্ষে নিয়েছে কৃষক প্রজারাও সেভাবে নিজের স্বার্থ ভুলে জমিদারের পক্ষ নেয়।
বৃটিশদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে কেউ সত্যি সত্যিই দাড়াতে চাওয়ার একটাই অর্থ হতে পারে তা হলো, একই সাথে বৃটিশদের ঔরসজাত জমিদারসহ সকল পরগাছা শ্রেণীর বিরুদ্ধে সে দাড়িয়েছে।

যেখানে এই সমস্যাটা নওরোজির কংগ্রেস বিশ বছর সময় পেয়েও পরিস্কার করেননি, কোন পদক্ষেপ নেননি, কোন কৃষি সংস্কারের কথা ভাবেনি জমিদারী উচ্ছেদের প্রশ্নে অবস্হান নেননি, শত্রুমিত্রের ধারণা পরিস্কার করেন নি সেখানে গরীব প্রজা তথাকথিত ন্যাশনালিষ্ট আন্দোলন তাঁর আন্দোলন নয় - এটা মনে করাই স্বাভাবিক।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ১৯০৫ সালে ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটে গেছে। বৃটিশ ঔরসজাত জমিদারসহ অন্যান্য সুবিধাভোগী শ্রেণী ও বৃটিশ-রাজ এর বিরুদ্ধে নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ে বাকি সবাই - এইভাবে কোন মেরুকরণ নওরোজির কংগ্রেস সময়ে না করার কারণে ১৯০৫ সালের অনাকাঙ্খিত মেরুকরণ বৃটিশ শাসকরা ঘটিয়ে দিতে পেরেছিল; বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সবল শক্তিজোট তৈরি হওয়াটা ভেস্তে দিতে পেরেছিল। ফলাফলে আরও ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ এই ৪২ বছর নিজের আয়ু বাড়িয়ে নিতে পেরেছিল। আর এক এই সাম্প্রদায়িক বিভক্তি আমাদের রাজনীতিতে স্হায়ী করে দিতে পেরেছিল।
১৯০৫ সালে নওরোজির কংগ্রেসের হঠাৎ র‌্যাডিক্যাল হয়ে ভাব ধরার চেষ্টা আর একে "ডিভাইড এন্ড রুল" পলিসির বিরোধিতা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা মূলত জমিদারী বাঁচানো, জমিদার-প্রজা সম্পর্ককে টিকানোরই প্রচেষ্টা। আমরা হয়ত তাদের দাবি মেনে নিতে পারতাম, বিশ্বাসও করতে পারতাম যদি দেখতাম জমিদারীর বিরুদ্ধে বক্তব্য, অবস্হান জানিয়ে সে এদাবি করছে, কৃষক প্রজাকে আহ্বান জানাচ্ছে।

ঘটনা সেভাবে ঘটেনি, ফলে কংগ্রেস ও কলকাতার এলিটদের শঠতাপূর্ণ দাবি কৃষক প্রজার কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। ওরা ঐ আন্দোলনে কৃষক প্রজার স্বার্থকেও প্রতিনিধিত্ত্ব করতে চায় তা প্রমাণ করতে পারেনি। ফলে বঙ্গভঙ্গকে বাংলার উপায়হীন কৃষক-প্রজারা জমিদার-প্রজা সম্পর্ক থেকে ছুটকারা পাবার একটা সম্ভাবনা হিসাবে দেখেছে। সেইসাথে ততদিনে পড়তে বা চাকরি সূত্রে বসবাসকারী মুসলমান উঠতি মধ্যবিত্ত ভাল শিক্ষার ও চাকরী প্রাপ্তির সুযোগ হিসাবে বঙ্গভঙ্গকে ইতিবাচক দেখেছে।

নীট ফলাফল এক অনাকাঙ্খিত মেরুকরণে "মুসলমান পরিচয়ে" (কাজে কাজেই বিপরীতটা হিন্দু পরিচয়ে) রাজনীতি বিকশিত হতে শুরু করেছে, সাম্প্রদায়িক বিভক্তির পথে সে যাত্রা। এটাই আমাদের আদি পাপ।
পরের বছরে অর্থাৎ ১৯০৬ সালের অক্টোবরে ৩৫ জন মুসলিম ডেলিগেশনের একটা দল নতুন ভাইসরয় Lord Minto এর সাথে দেখা করে মুসলমানদের জন্য আলাদা ইলেকটরেট (অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য আলাদা সীট, আলাদা প্রার্থী ও কেবল মুসলমানেরাই সেখানে ভোটার) এর ডাবি জানিয়ে আসে। এর দুইমাস পর ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। ওদিকে ঐ ১৯০৬ সালেই লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসার কারণে নতুন ভারত বিষয়ক মন্ত্রী (Secretory of State for Indian Affairs) Lord John Morley মিলে Minto-Morley Reforms কমিশন গঠিত হয়। এর রিপোর্ট মোতাবেক Government of India Act of 1909 জারি হয়। এই আইন অনুসারে, হিন্দু, মুসলমান আলাদা ভোটের ব্যবস্হা চালু হয়। বঙ্গভঙ্গ রোধ হয়ে যায়, অর্থাৎ বেঙ্গল আবার জোড়া লেগে আগের জায়গায় ফিরে যায়। কিন্তু স্হায়ী ক্ষত চিহ্ন পিছনে ছেড়ে যায়। ১৯১৯ সাথে প্রথম আলাদা ইলেকটরেটে ভোট হয়। আমাদের ভাগাভাগির ব্যবস্হা, হিন্দু-মুসলমান ভাগের রাজনীতি পাকাপাকি স্হায়ী আকার নেবার পথে রওনা দেয়।

এরপর গান্ধীর "সত্যাগ্রহ" প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার ছিল। সেদিকে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। পাঠকের আগ্রহের উপর নির্ভর করে।
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×