বিদায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা
যুগান্তর রিপোর্ট
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের পরিবারের সদস্যরা এখন শত কোটি টাকার মালিক। গত চার বছরে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য ছাড়াও দখল এবং চাঁদাবাজিতে লিপ্ত ছিল তার পরিবারের প্রায় প্রতিটি সদস্য। শুধু অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করেই কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পরিবারের কেউ কেউ। পরিবারের সদস্যদের অপকর্মের বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভয়ে কেউ এতদিন টু-শব্দটি করতে পারেননি। মন্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হারানোর পর চুপসে গেছে তার পরিবারের সদস্যরা। ব্যাপক খোঁজখবর নিয়ে, অনুসন্ধান চালিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তেজগাঁও থানা সংলগ্ন এয়ারপোর্ট রোডে ৩৪ তেজকুনিপাড়ায় অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের পৈত্রিক নিবাস। তবে তিনি এ বাড়িতে থাকেন না। ওই বাড়িতে তার পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন। ওই বাড়ির ছাদের ইম্পেরিয়াল গেস্ট হাউসে রয়েছে ভিওআইপি সরঞ্জাম। গত তিন বছর ধরে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করে তার পরিবারের সদস্যরা কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আগে ভিওআইপি ব্যবসাটি দেখভাল করতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সৎ ভাই খোকন। কয়েক মাস আগে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারি সফরসঙ্গী হয়ে আমেরিকা চলে যান খোকন। এর পর থেকে ওই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নে সরোয়ার। ভিওআইপি ব্যবসা ছাড়াও পুলিশে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে তিনি কামিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। গত কয়েক বছরে তার সুপারিশ ছাড়া পুলিশে বদলির ঘটনা ছিল হাতেগোনা। দক্ষিণখান, বিমানবন্দর, উত্তরা (পূর্ব), ভাষানটেক, ধানমণ্ডি, কাফরুল, মতিঝিল, তুরাগ, কোতোয়ালি এবং ওয়ারীসহ ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার অন্তত ২০টি থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) তার কথায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। নিয়োগপ্রাপ্ত এসব ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সরোয়ারকে প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা মাসোহারা দিয়ে থাকেন বলে একাধিক সূত্র অভিযোগ করেছে। এছাড়া উত্তরা জোনের একজন সহকারী কমিশনারের (এসি) সঙ্গে সরোয়ারের রয়েছে দহরম-মহরম সম্পর্ক। প্রতি রাতেই ওই সহকারী কমিশনারের সঙ্গে সরোয়ার আড্ডা জমান উত্তরার একটি ফ্ল্যাটে। আড্ডা শেষে গভীর রাতে পুলিশের গাড়িতেই ওই সহকারী কমিশনার সরোয়ারকে ফার্মগেটের বাসায় পৌঁছে দেন।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সরোয়ার মিরপুর-১১ নম্বর সেকশন, বসুন্ধরা সিটির পেছনে কাজীপাড়া, উত্তরা, দক্ষিণখান ও উত্তরখান এলাকায় বেশ কয়েকটি বিরোধপূর্ণ বাড়ি দখল করেছেন। প্রায় বছরখানেক আগে দক্ষিণখানে কাতার প্রবাসী দম্পতি মেজবাহ উদ্দিন ও হোসনে আরার জমি দখল করে নেয় হারুন অর রশিদ নামে এক ব্যক্তি। এর পেছনে প্রভাব খাটিয়েছেন ভাগ্নে সরোয়ার। এছাড়া ক্ষমতার অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গাড়ি এবং পার্কিং ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন সরোয়ার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরে গত কয়েক বছরে সবচেয়ে ক্ষমতাবান লোক ছিলেন তার ভাগ্নে সরোয়ার। এ খবর ওই মন্ত্রণালয়সহ সবাই জানেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বোন সুমিও ছিলেন পুলিশ প্রশাসনে পরিচিত একটি নাম। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে বদলি আর নিয়োগ বাণিজ্যে গত কয়েক বছর তিনিও ছিলেন আলোচনায়। বড় বোন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে দিয়ে বদলি আর নিয়োগ বাণিজ্যে তিনিও কামিয়েছেন দু’হাতে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইম্পেরিয়াল গেস্ট হাউসের (হোটেল) কর্মকাণ্ড নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। হোটেলটিতে দেহ ব্যবসার অভিযোগ অনেক পুরনো। বছরখানেক আগে র্যাব-২-এর একটি টিম ওই হোটেলে অভিযান চালিয়ে পতিতাসহ ৩৯ জনকে গ্রেফতার করে। এর আগে ওই হোটেল থেকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের আপন ভাই ইস াফিলের ছোট ছেলে আনিস ও তার সহযোগী নাসিরকে জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ আটক করে র্যাব। পরে র্যাব সদস্যরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চাপে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপর ভাগ্নে আরমান ও ভাতিজা দীপু ফার্মগেট ব্যাংক গলিতে ২৮/১ তেজকুনিপাড়ায় মমতাজ গার্ডেন নামে একটি নির্মাণাধীন ভবনের তিনটি ফ্লোর জোর করে দখল করে নিয়েছেন। দখলকৃত এসব ফ্লোরে গড়ে তুলেছেন জুয়ার আড্ডা। দিনেরাতে এ জুয়ার আসরে লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয়। আরমানের ঘনিষ্ট সহযোগী শিপন অবৈধ এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া তেজকুনিপাড়া কনকর্ড টাওয়ার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ফুটপাতে চাঁদাবাজি করে শিপনসহ আরমানের সহযোগী আনোয়ার হেলাল, মনির ও রাহাত। তেজকুনিপাড়ায় টেম্পোস্ট্যান্ডটিও আরমান ও তার সহযোগীদের দখলে। এখান থেকে প্রতিদিন মোটা অংকের চাঁদা আদায় করছে চক্রটি। আরমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফার্মগেট এলাকায় চলছে নীরব চাঁদাবাজি। চক্রটি ফার্মগেট এলাকায় কোন বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গেলেই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে মোটা অংকের চাঁদা ধার্য করে দেয়। এর আগে তেজকুনিপাড়া এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের সময় আনোয়ারা গার্ডেন থেকে মোটা অংকের টাকা নেয় এ চক্রটি। ফার্মগেট কনকর্ড টাওয়ারের তৃতীয় তলায় একটি কেমিক্যাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সম্প্রতি ওই চক্রটি দুই লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছে। চাঁদার টাকা না দেয়ায় মালেক টাওয়ারের নিচতলায় একটি ওষুধের দোকান থেকে কম্পিউটার নিয়ে যায় চক্রটি। পরে দোকান মালিক ৩০ হাজার টাকার চাঁদা দিয়ে বিষয়টি আপসরফা করেন। কয়েক মাস আগে আরমান ও তার লোকজন চাঁদা না পেয়ে ফার্মগেট এলাকার দুটি কোচিং সেন্টারে ভাংচুর চালায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই যুগান্তরকে বলেছেন, তেজকুনিপাড়া ও ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দারা গত কয়েক বছর ধরে ‘আরমান বাহিনীর আতংকে’ ভুগেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নে হওয়ায় সবকিছু জানার পরও প্রশাসনও চোখ বন্ধ করে ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, শুধু পরিবারের সদস্য নয়, গত কয়েক বছর যারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশপাশে থেকেছেন, তারা সবাই এখন কোটি টাকার মালিক। প্রটোকল অফিসার আসলাম থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সহকারী এমনকি গানম্যান পুলিশের হাবিলদার জাহাঙ্গীর এবং এএসআই জমিরেরও রয়েছে ঢাকায় একাধিক বাড়ি, ব্যাংক একাউন্ট এবং ফ্ল্যাট।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


