রাহেলা এক নিমিষে বুঝে ফেলে কি ঘটেছে। মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। ভেবে পায় না একটা মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে নিজের বউ আর বাচ্চাকে না খাইয়ে নিজের ফুর্তির টাকা যোগায়। আজ একটা কিছু রফা করবেই স্বামীর সঙ্গে। গোঁজ হয়ে বসে থাকে আরমানের ফেরার অপেক্ষায়। রাত বাড়ে। এক সময় আরমানের খটখটি শোনা যায়। দরজা খুলে রাহেলা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না, আরমান একা নেই। নিজের সঙ্গে আরেকজন মেয়ে নিয়ে এসেছে! লোকমুখে শুনেছিলো কিন্তু এই কথাটা রাহেলা কখনো বিশ্বাস করে নি। আজ আরমান অনেক শান্ত মেজাজে আছে, ঠান্ডা মাথায় ঠান্ডা গলায় দ্বিধাহীনভাবে রাহেলাকে তাই বলতে বাধেনা,
-- আমি অনেক ভেবে দেখেছি তোমার আমার সংসার করার আর কোন দরকার নাই ... রোজ রোজ তোমার জ্ঞানী জ্ঞানী উপদেশ শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত। আমি নিজের জীবনের তালই রাখতে পারি না আরো বাড়তি দুইটা মানুষ! শোন রাহেলা, তোমার মেয়েকে নিয়ে তুমি কালকে চলে যাবা তোমার বাপের বাড়ি। আমি একলা শান্তিতে, ফুর্তিতে জীবন কাটাবো। বিশেষ দরকার হলে আমার ময়নাপাখীদের এইখানে আমার বাসায় নিয়ে আসবো।
সাথের মেয়েটিকে রাহেলার সামনেই জড়িয়ে ধরে পাশের ঘরে ঢুকে যায় আরমান। রাহেলার মুখে কোন কথা সরে না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে স্বামীর চলে যাবার দিকে। অবিশ্বস্ত, বড় অবিশ্বস্ত মনে হয় পৃথিবীটাকে। কতটা সময় চলে গেছে খেয়াল হয় পাশের ঘরের আওয়াজে। চটকা ভেঙে পাথর রাহেলা ছুটে যায় মেয়ের দিকে। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জাপটে ধরে তাকে, ভেঙে পড়ে মেঝের ওপর ঝড়ে ওপড়ানো গাছের মতো। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। সমস্ত শক্তি নিশেঃষিত হলে একের পর এক বিভীষিকা চোখের ওপর ভাসতে থাকে। পাশের ঘর থেকে হাসির শব্দ খান খান হয়ে ছড়িয়ে পরে অন্ধকারে।
কেমন করে কেটেছিলো ওই বিভতস রাত, আজ ভেবে তার কোন কূল পায় না রাহেলা। পরদিন সকাল হবার সাথে সাথেই ছুটে গিয়েছিলো বাপের বাড়িতে। সংসার ভাঙ্গার জন্য কোন কষ্ট নয়, বাস্তবিক সে যেন মুক্তি পেয়েছিলো অসুস্থ এক জীবন থেকে। বহুদিন পর নিজের চেনা পরিবেশে বাবা-মা আর ভাইয়ের সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কথা বলে সে। ছোট্ট মেয়ে নীলা বড় হতে থাকে একটু একটু করে। তারও কিছুদিন পর ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে সে কি আনন্দ রাহেলার! কদিনের জন্য ভুলেই যায় নিজের অভিশপ্ত জীবনের কথা। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়,নতুন ভাবী আসে ঘরে। বিয়ে উপলক্ষ্যে পাওয়া আনন্দ বেদনায় পরিণত হতে সময় লাগে না খুব বেশি দিন। নতুন ভাবীর নিত্য খোটা ছন্দপতন ঘটাতে থাকে দিনযাপনে। নিজের বাবার বাড়িতে প্রতি পদে পদে অপমানিত হতে হতে রাহেলার জীবন আবার দুর্বিষহ হয়ে উঠে। ইচ্ছা করে আবার পড়াশোনা করে চাকরী করে বাঁচতে। মেয়েটাকে যেন তার মতো অবস্থায় না পড়তে হয়। কিন্তু পড়ার খরচটাই বা দিবে কে?
অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, এইখানে এইভাবে আর নয়। কিছু একটা করবে। কিন্তু কি যে করবে তাই ভেবে পায় না। একদিন ভাইয়ের ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভাবীর কথা কানে আসে। তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। অবাক হয় রাহেলা। একটু পরেই বুঝতে পারে আসল ঘটনা। পয়ষট্টি বছরের এক বিপত্নীক বৃদ্ধ-- তার দুই ছেলে, দুই মেয়ে, সবাই বিবাহিত। ভাবী চাইছে এই বিয়েটা দিয়ে আপদ বিদায় করতে। রাহেলা নিজের মনে কিছুক্ষন ভাবতে থাকে। পয়ষট্টি বছর! এ যে বাবার বয়েসী। তবু তো সেখানে তার নিজের সংসার হবে, মেয়ের ভবিষ্যতের একটা ব্যবস্থা হবে। রাহেলা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। একটাই কেবল শর্ত থাকবে এই বিয়েতে রাজী হবার, তার মেয়ের দায়িত্ব নিতে হবে। এই শর্তে নিঃসংগ বৃদ্ধের আপত্তির কোন কারন ছিলো না। বিয়েটা হয়ে গেলো তাদের।