২০১৬ সালের কথা। আমি তখন গুলশান ১নং ডিসিসি মার্কেটে ব্যবসা করি। আমার দোকানের এক কর্মচারী ছিলো, নাম তার জনি। জনি জানতো গ্রামের দিকে বাড়ি করার আমার খুব ইচ্ছে আছে। তো আমার দোকান থেকে চাকরি ছেড়ে যাওয়ার পরে জনি জয়দেবপুরের দেউলিয়া গ্রামে সোয়া চার কাঠা জমি কিনেছিলো। যার কিছু অংশ বায়না করা ছিলো, টাকা পরিশোধ করে নাই। এর মধ্যে জনির স্ত্রী তার বাবার বাড়ির ওয়ারিশ থেকে কিছু জমি পায় নরসিংদীতে। সেখানে বাড়ি করার জন্য টাকা দরকার তাই দেউলিয়ার জমিটুকু কেনার জন্য আমাকে এসে ধরে।
২০১৬ সালের মে মাসের ১৩ তারিখ। আমি আর ইস্রাফীল জনির সাথে রওনা হই জমি দেখতে। বাড্ডা থেকে এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে থেকে বাসে গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে জয়দেবপুর শিববাড়ি। সেখান থেকে জয়দেপুর রেল ক্রসিং পার হয়ে সিএনজিতে করে কালনি বাজার হয়ে দেউলিয়া গ্রাম। তারপর ৫-৭ মিনিট হেঁটে জমিতে যখন পৌছাই তখন ঘড়িতে সময় ১টা বেজে ১০ মিনিট।
গ্রামের এক পাশে বাড়ির ভিটার অংশের জমি। পাশেই জমির মূল মালিকের বাড়ি। ভিটার পাশের অংশ থেকেই বিক্রি করেছে, এখনই বাড়ি করার উপযোগী জমি। জমি পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তা আছে ৬ ফুট, তবে তা এখনো সলিং হয়নি। কাঠাল গাছ-তাল গাছ-কলা গাছ, লেবু ঝোপ, আর অনেকগুলি একাশিয়া বা আকাশমনি গাছে একেবারে জঙ্গল হয়ে আছে। পাশেই ধানি জমি। বর্ষায় বেলাই বিলের জল এসে এই জমি পর্যন্ত পৌঁছায়। জমি ভালো, কিন্তু ঢাকা থেকে দূরুত্ব অনেক। পৌছানো মেলা ঝক্কি।
আমরা পৌছানোর মিনিট ১০ এর মধ্যেই দক্ষিণ আকাশ অন্ধকার করে কালো মেঘেদের বিশাল এক দল এগিয়ে আসতে শুরু করলো ঠিক যেনো রবীবাবুর গানের সুরে তাল মিলিয়ে।
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥
বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো, আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,
কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহি রে॥
ঠান্ডা বাতাস গা জুড়িয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে বুঝতে পারছি এখনই ঝুম বৃষ্টি নামবে। পাশেই আছে বেণুবন (বাঁশ ঝার), বাতাস তাদের মাঝে ঢেউ তুলেছে, মাঝে মাঝেই মটমট-পটপট বিকট শব্দ করছে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে গো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।
ঝরো-ঝরো ধারে ভিজিবে নিচোল, ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল--
ওই বেণুবন দোলে ঘন ঘন পথপাশে দেখ চাহি রে॥
যদিও বেলা তখন আছে যথেষ্টই। ঘড়িতে তখন দেড়টা বাজেনি। কিন্তু আকাশের ঘনকালো রূপ দেখে তা বুঝার কোনো উপায় নেই। মনে হচ্ছে সন্ধ্যা শেষে বুঝি রাত নমলো বলে। আমরা আশ্রয়ের জন্য জমির মালিক জালাল উদ্দিনের বাড়ির দিকে চলে গেলাম। জালাল উদ্দিন যে ঘরে থাকে সেটির অবস্থা অতি করুন। উঠনের উলটো পাশে তার ছোট ভাই বিল্লালের মাটির দেড় তলা ঘর। বেশ সুন্দর দেখতে। বিল্লাল থাকে সৌদি আরব, তার স্ত্রী-বাচ্চারা থাকে শহরের ঘর ভাড়া করে। আমরা খালি বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিলাম। শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি।
এক সময় বৃষ্টি থামলো, আমরা গ্রামের কর্দমাক্ত পিচ্ছিল মেঠপথে ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। আমি তখন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি- এ জমি কিনবো না। কিন্তু জনি খুব করে ধরলো, টাকাটা ওর খুবই দরকার। একমুঠে না দিলেও হবে। বাড়ির কাজ করার সময় দুই তিন দফায় দিলেও চলবে। অন্যদিকে বন্ধু ইস্রাফীলেরও জমি পছন্দ হয়েছে। সেও জমি কেনার পক্ষে তার মতামত দিলো। জমি আমারও পছন্দ হয়েছে, কিন্তু দূরুত্বের কারণে আমি রাজি হচ্ছিলাম না।
জামি দেখে এসে বাসায় জানিয়ে দিলাম জমি কিনবো না, অনেক দূর। (ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার, জয়দেবপুর রেল স্টেশন থেকে ৬ কিলোমিটার।) তারপরও কি মনে করে কয়েকদিন পরে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে বড়বোনের গাড়ি ধার নিয়ে চলে গেলাম আবার সেই দেউলিয়াতে। নিজস্ব গাড়িতে যাওয়ার কারণে স্ত্রী-কন্যা পথের দূরুত্ব আর ঝক্কির বিষয়টা বুঝলো না। আর আমার কন্যা সাইয়ারা সবুজ মাঠ আর ঝোপ-জঙ্গল দেখে খুশী হয়ে ঘোষণা করলো- এই জমি আমরা কিনবো। বিবি সাহেবারও পছন্দ হয়েছে জমি। সিদ্ধান্ত হলো দেউলিয়ার এই জমিটুকু আমরা কিনবো। ফাইনাল।
সোয়া চার কাঠা দিয়ে শুরু করে এখন শেষ পর্যন্ত সেখানে জমি কেনা হয়েছে প্রায় ৩২ কাঠা। একটি গ্রামের বাড়ি তৈরি করবো ওখানে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ৮:৪০