প্রতিদিনের মতো আজও অফিস যেতে দেরী করে ফেলেছে রাশেদুল ইসলাম। এটা তার নিত্যদিনের একটি অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। প্রতিদিনই সে ভাবে আর অফিসে দেরী করে যাবে না। কিন্তু তা আর পেরে ওঠা হয় না। অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার সাথে সাথেই মৌসুমী তার কোলে এসে ঝাপিয়ে পড়ে। একমাত্র মেয়ে তার। অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী। অবশ্য সব বাবা-মার কাছেই তার ছেলে-মেয়ে সুন্দর। কিন্তু মৌসুমীকে সে একা সুন্দরী বলেন না।আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়াপ্রতিবেশী সবাই তার সৌন্দর্যের প্রশংসায় লিপ্ত। এটা নিয়ে তার আনন্দের কোনো সীমা থাকে না। তিনি বা তার স্ত্রী রাহেলা খুব একটা সুন্দর না। দু'জনের গায়ের রং শেমলা। কিন্তু তাদের মেয়ের গায়ের রং টা দুধে-আলতা। এই মেয়েটির সাথে সারা রাত খেলা করে সময় কেটে যায় রাশেদুলের। ফলে ঘুম থেকে সকাল সকাল উঠতে তার খুব কষ্ট হয়ে যায়।
আজ মৌসুমীর জন্মদিন। দেখতে দেখতে সাতটি বছর হয়ে গেল। আজ তার জন্মদিনে বাসায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়াপ্রতিবেশী সবাইকে তিনি দাওয়াত করেছেন। বড় একটা কেকের ওয়ার্ডার দেওয়া হয়েছে। তার বিশাল ফ্লাটটিকে সাজানো হয়েছে। তার ভাই-বোন আর রাহেলার দুই কাজিন মিলে ঘরটিকে সাজিয়েছে অপরূপ ভাবে। ঠিক তার মেয়ে যে সব জিনিস পছন্দ করে, সে সব দিয়েই ঘরটিকে ডেকোরেশন করা হয়েছে। এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে যে, রাশেদুলের মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। খুব ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে এই চারজনকে। কিন্তু সারা রাত পরিশ্রম করে তারা সবাই ঘুমিয়ে আছে। তাই আর দেওয়া হলো না। বিকেলে বাসায় ফিরে এসে তারপর তাদেরকে ধন্যবাদ জানাবেন। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো আজও তিনি গেলেন তার মেয়ের রুমে। তার মেয়েটি ঘুমাচ্ছে। তার গালে একটা চুমু দিয়ে তিনি বের হয়ে আসেন। রাহেলা তার জন্য ব্যাগ হাতে দাড়িয়ে আছে।
-আজকে কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবা।
-আচ্ছা।
-তোমার মেয়ের জন্য কি কি আনতে হবে মনে আছে।
-হুম আছে।
-আর কেকটাও নিয়ে আসবা।
-ওটা ওরা দিয়ে যাবে। আমি পেমেন্ট করে রেখেছি। নিয়ে নিও।
-সাবধানে যাবা। রাস্তাঘাট ভালো না। দেখেশুনে গাড়ি চালাবা।
-আচ্ছা। বলেই বের হয়ে যান রাশেদুল।
আজ রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। অফিস যেতে অনেক লেট হয়ে যায় তার। কপাল ভালো যে, বস তার মামা। অন্য কেউ হলে এতোদিনে তার চাকরি চলে যেত। তবে কাজের দক্ষতা আছে রাশেদুলের মধ্যে। তাই অফিসের সবাই তাকে খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে তার মামা। আর প্রতিদিন অফিসে এসে সে আগে তার মামার সাথে দেখা করেন। আজ রুমে ঢুকার সাথে সাথেই মামা বললো-
-আজ না মৌসুমীর জন্মদিন।
-হ্যাঁ মামা।
-তোর মামী আগেই চলে যাবে। আমি আর তুই একসাথে বের হবো।তুই কখন বের হবি?
-আমি আজকে একটু আগে বের হবো মামা। মৌসুমীর জন্য কিছু কেনেকাটা করতে হবে।
-ও। তাইলে তুই আগেই চলে যা। আমি পড়ে আসবো।
-আচ্ছা মামা। বলেই বের হয়ে আসে রাশেদুল।
আজ অফিসে কাজের চাপ খুব কম। তাই সে খুব রিলাক্স মুডে থাকে। তার মেয়েটিকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। মেয়েকে ডাক্তারী পরাবেন তিনি। সে যখন অসুস্থ হয়ে পরবে, তখন তার মেয়ে তার সেবা করবে। আর বলবে, "তোমাকে না বাহিরের খাবার খেতে মানা করেছি। আর বলেছি না বেশী করে হাটাহাটি করবে। এভাবে অসুস্থ হয়ে থাকলে কি চলে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে বাবা।" কথাটা চিন্তা করতে করতে চোখে জল এসে পরে। আসলেই আমি না থাকলে কি হবে আমার মেয়ের। আমাকে ওর জন্যই বাঁচতে হবে। বিকেল চারটার সময় অফিস থেকে বের হয়ে যায় রাশেদুল। সোজা চলে যায় বসুন্ধরা সিটি। এখান থেকে একটা বারবি ডল কিনবে। বারবি ডল খুব পছন্দ করে মৌসুমী। এবারে জন্মদিনে এটাই তার দাবি। খুব সুন্দর দেখে একটা বারবি ডল কিনেন তিনি। তারপর রাহেলার জন্য একটা শাড়ী কিনেন। নিজের দুই ভাই-বোন আর শালা-শালির জন্যও কিছুা কেনাকাটা করেন। এরপর বের হয়ে যান তিনি। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। গাড়ি নিয়ে বসে থাকতে খুব বিরক্ত লাগছে তার। কখন বাসায় ফিরবেন তা নিয়ে দুশ্চিনতা হয়। তাকে ছাড়া মৌসুমী কেক কাটবে না। তাই তার তাড়াতাড়ি পৌছানো জরুরি। কিন্তু আজকে রাস্তার জ্যাম যেন কোনো মতেই কমছে না। হঠাৎ করেই ফোন আসে রাহেলার।
-এই তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি আসছোনা কেন?
-আসছি আসছি। রাস্তায় অনেক জ্যাম।
-তোমার মেয়ের সাথে কথা বলো।
-দাও।
-বাবা, তুমি কোথায়?
-এইতো মা। কাছাকাছি।
-আমার ডল কিনেছো?
-হ্যাঁ মা। খুব সুন্দর একটা ডল কিনেছি তোমার জন্য।
-তুমি তাড়াতাড়ি আসো বাবা। তোমাকে ছাড়া আমি কেক কাটবো না।
-আসতেছি মা।
মেয়ের ফোন পেয়ে খুব ভালো লাগে রাশেদুলের। সে তাড়াতাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করে। গাড়ি চলে আসে ফার্মগেটে। এখান থেকে সোজা তিনি চলে যাবেন মিরপুরে। মেয়ের সাথে বসে কেক কাটবেন। বারবি ডলটা দিবেন। আর রাতে সেই বারবি ডল নিয়ে খেলা করতে করতে পরের দিন আবার অফিসে লেট করে যাবেন। কথাটা ভাবতেই হেসে ফেলেন তিনি। কিন্তু হাসিটা বেশীক্ষন স্থায়ী হয় না। বিপরিত দিক থেকে আসা একটি বাসের সাথে সজোরে ধাক্কা লাগে। সব কিছুই অন্ধকার হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় রাশেদুলের স্বপ্ন। শেষ হয় যায় তার আনন্দ। ফেরা হয় না আর।
সড়ক দুর্ঘটনায় এভাবেই অনেক রাশদুলকে প্রান হারাতে হয়েছে। থেমে গেছে তাদের জীবন, তাদের ভবিষ্যত। তারপরও আমরা থেমে থাকি না। বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে আমরা চলাচল করি। আর সেই স্বপ্ন পুরনের চেষ্টা করি। তবুও আর কতো প্রান দিতে হবে এই সড়ক দুর্ঘটনায়। এটা হয়তো আমাদের অজানা।
"নিরাপদ সড়ক চাই" - এটাই এখন আমাদের সবার দাবি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১১ দুপুর ২:১৭