আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম।
এযুগের ছেলে মেয়েরা ছয় বছর বয়সে কি চালাক চতুর হয়। আমি ছিলাম প্রচন্ড বোকা। তখন তো মোবাইল ছিল না, ল্যাপটপ ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। ডিশ লাইন ছিল না। যাই হোক, স্কুল থেকে ফেরার পর মা আমাকে গোসল করিয়ে দেয়। গোছল তো না, মারাত্মক অত্যাচার। নারকেলের সোবা দিয়ে ডলে আমাকে লাল বানিয়ে দিত। মাথায় এক গাদা তেল দিয়ে দিত। কপালের ডান পাশে আঙ্গুল দিয়ে এত্ত বড় একটা টিপ দিয়ে দিত। গোছলের পর আমি দুপুর পর্যন্ত খেলি। সেদিন গোসল করার পর খেলা করার জন্য পাশের বাসার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হই। কিন্তু পাশের বাসায় না গিয়ে এক পাগল এর পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন চলে যাই। চারিদিকে শুধু গাড়ি, বাস, রিকশা আর দোকান-পাট। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও আমাদের বাসা খুঁজে পেলাম না। এদিকে ক্ষুধায় পেট চু চু করছে। হঠাৎ রাস্তার পাশে এক মাইকের দোকানের লোক আমাকে কোলে নিয়ে বলল- বাবু তোমার বাসা কই?
আমি বললাম -জানি না।
ঠিকানা কি?
আমি বললাম- জানি না।
তোমার বাবার নাম কি?
আমি বললাম- মনে করতে পারছি না।
থাকো কোথায়?
আমি বললাম - বাসায়। আমার খুব ক্ষুধা লাগছে।
লোকটি আমাকে রুটি সন্দেশ কিনে দিলো।
আমি লক্ষ্মীর ছেলের মতন সবটুকু রুটি-সন্দেশ খেয়ে নিলুম। তারপর লোকটি আমাকে তার দোকানের পেছনে বস্তিতে একটা ভিক্ষুক বুড়ির কাছে রেখে এলো। (আমার এখনও চোখে ভাসে- বস্তির সেই নোংরা পরিবেশ। ছোট ছোট বাঁচা গুলো কাঁদায় মাখা-মাখি করে খেলছিল। তাদের গায়ের জামা গুলো ভীষন ময়লা)
সময় তখন মধ্যদুপুর।
আমি বাসা থেকে বের হয়েছিলাম সকাল এগারো টায়। মাইকের দোকানের লোক সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ যেটা করেছে- তা হলো, উনি রিকশা করে মাইক দিয়ে আশে-পাশে এলাকায় ঘোষনা করেছেন। একটি ফরসা ছেলে পাওয়া গিয়াছে। বয়স আনুমানিক ৫/৬। হাফ প্যান্ট, হাফ শার্ট পরা। পায়ে কালো জুতো। কপালে ইয়া বড় টিপ। মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটা।
সেই সময় বাসার পরিস্থিতি কি হয়েছিল সেই কথা একটু বলি-
আমার মা জানতেন আমি যেখানেই থাকি না কেন, একটু পর-পর বাসায় ঘুরে এসে মাকে দেখে যেতাম। মা বারোটার দিকে আমার প্রথম খোঁজ করেন। দুপুর একটার দিকে আমাকে না পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। আবার জ্ঞান ফিরে, আবার আমাকে দেখতে না পেয়ে জ্ঞান হারান। দুপুরবেলা আমাদের বাসার আশে পাশের এলাকায় মাইক দিয়ে জানানো হলো- রাজীব নামে একটি ছেলে হারানো গিয়াছে। গায়ের রং ফর্সা। মোটা করে। হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্ট পরা। কোনো সহৃদয়বান ব্যাক্তি পেয়ে থাকলে সন্ধান দিন। সন্ধ্যা পর্যন্ত রিকশা নিয়ে মাইক ঘুরল- খিলগা, ফকিরের পুল, মালিবাগ, শান্তিনগর, কমলাপুর ইত্যাদি এলাকায়। কিন্তু কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
রাত ১১ টা।
মা যায় যায় অবস্থা। সবাই ধরেই নিলো রাজীবকে আর পাওয়া যাবে না। এই ব্যাপারটা সবাই মাকে বুঝাতে চেষ্টা করলো। প্রতিবেশীরা মাকে বলল, আল্লাহর মাল আল্লহ নিয়ে গেছে। আর কান্না-কাটি করো না। তখন আমার বাবা নিখোঁজ। মার সাথে রাগ করে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। আর নানা-নানী'ও কিছুদিন আগে মারা যান। আমার বাবা থাকলে আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করতে পারত। বাবার কাছে কোনো সমস্যাই কোনো সমস্যা নয়।
আমি সারাদিন পার করে দিলাম বস্তিতে।
আমার'ই বয়সি বেশ কয়েকটা ছেলে মেয়ের সাথে আমার খাতির হয়ে গেল। সন্ধ্যার পর ইয়া বড় বড় মশা আমাকে কামড়াতে শুরু করলো। অবশ্য সারারাত আমাকে মশা কামড়াতে পারেনি। রাত এক টায় আমি বাসায় ফিরি। মা কোলে করে আমাকে বস্তি থেকে বাসায় নিয়ে আসে। বাসায় ফেরার পর মা আমাকে এক বালতি দুধ আর দুবলা দিয়ে গোছল করায়। পুরো মহল্লার মানূষকে মিষ্টি খাওয়ালো। বস্তির বুড়ি মহিলা ও মাইকের দোকানদারকে টাকা-পয়সা দেওয়া হলো। তখন মার কাছে টাকা ছিল না। টাকার জন্য মাকে গলার চেনটা বিক্রি করতে হয়েছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৯ বিকাল ৩:১১