গ্রামের নাম রহমতপুর।
গ্রামটি একেবারে বাংলাদেশের শেষ মাথায়। রাত এগারোটা। খুব বেশি রাত নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে গভীর রাত। আমি বসে আছি দেবজানি খালের উপর লম্বা একটা কালভার্টে। রাতে খাবার খেয়ে এসেছি। সাথে করে ফ্লাক্সে নিয়ে এসেছি চা। আর সিগারেট। চা সিগারেট ছাড়া এত লম্বা রাত পার করবো কিভাবে? দেবজানি খালটা বেশ রহস্যময়। রহস্য উদঘাটন করতেই আমি এসেছি। আমি থাকি ঢাকা। বন্ধুর সাথে এ গ্রামে বেড়াতে এসেছি। এই দেবজানি খালের নানান রহস্যময় কথা শুনেছি। গ্রামবাসী নিজ গ্রামের রোহমর্ষক বানোয়াট কাহিনি বলতে পছন্দ করে। ছোট, অতি তুচ্ছ কাহিনি একসময় ডালপালা মেলে দেয়। তিল থেকে তাল হয়ে যায়। এসব কাহিনি বিশ্বাস করার কোনো কারন নেই। আমি কুসংস্কার বিশ্বাস করা লোক না। ধার্মিকেরা কুসংস্কার বিশ্বাস করে। আমি ধার্মিক নই। আমার কপালে কোনো দাগ নেই।
দেবজানি খালের কিছু রহস্যের কথা এখন বলব।
গত দুই যুগ ধরে এইখালের ধারে কাছে কেউ আসে না। এখানে যে আসে সেইই মারা যায়। খুব করুন মৃত্যু। একটা মেয়েকে এই দেবজানি খালের আশে পাশে ঘুরে বেড়াতে দেখায় যায়। মেয়েটি মাঝে মাঝে কাদে-হাএ। আশে পাশের গ্রামের সবাই এই দেবজানি খালের কথা জানে। তারপরও ভুলক্রমে কেউ কেউ এই খালে এসে পড়ে। এবং তার মৃত্যু হয়। গত বছর দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। ভূত মাথা থেতলে দিয়েছে। তারপর মৃত্যু হয়েছে। এবং মৃতও লাশকে গাছের আগায় ঝুলিয়ে রেখেছে। গ্রামবাসী দিনের বেলা গিয়ে লাশ নিয়ে এসেছে, সাথে পুলিশ ছিল। আরেকজন বাইক চালিয়ে দেবজানি খালের উপর দিয়ে যাচ্ছিল রাত্রির বেলা। কালভার্ট ভেঙ্গে বাইক নিয়ে দেবজানি খালে পড়ে মৃত্যু হয়েছে। পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে, দু’টা মৃত্যুই দূর্ঘটানা। কিন্তু গ্রামবাসী এই দূর্ঘটনার সাথে আরো অনেক কিছু যোগ করে নিজ গ্রামকে মহামানিত্ব করতে চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের সব গ্রামেই এরকম দু'চারটা ঘটনা আছে।
চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
ঝিঝি পোকা সমানে ডেকেই যাচ্ছে। বেশ বাতাস আছে। আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না। ভয় পায় পাপীরা। আর যাদের মধ্যে নানান কুসংস্কার আছে তারা ভয় পায়। আমি একজন আধুনিক মানুষ। আসুক আজ ভূত। ভূতের কানটা টেনে ছিড়ে ফেলবো। রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেল। ভূতের দেখা পাচ্ছি না। অথচ গত বছরও এই দেবজানি খালে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। বছরের পর বছর এখানে রহমতপুরবাসী আসে না। আচ্ছা, এখন যদি। সত্যি সত্যি একটা ভূত এসে আমার সামনে দাঁড়ায়! হা হা হা! তাও আমি বিশ্বাস করবো না। এর পেছনের কারন অনুসন্ধান করবো। লজিক খুঁজে বের করবো। রাত দুইটা। তবু ভূত এলো না। মাই ব্যাড লাক। একা একা চা খাচ্ছি। মনে মনে ভাবছি, ভূত আসুক একটা। তাহলে ভূতকে চা খাওয়াবো।
সারারাত থেকে ভূতের সন্ধান পেলাম না। মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম।
পরের দিন সমস্ত গ্রামবাসী আমাকে দেখতে এলো। আমি যখন দেবজানি খালে যাচ্ছি, পুরো গ্রাম আমাকে যেতে মানা করেছে। কিন্তু আমি তো কারো ভুলভাল কথা শোনার মানুষ নয়। রহমতপুর প্রাইমারী স্কুলের হেড মাস্টারের সাথে দেখা করলাম। স্যার বুড়ো মানুষ। চোখেও কম দেখেন। এখন আর ক্লাশ নেন না। তার রুমে চুপ করে বসে থাকেন। স্যারের কাছ থেকে জানতে পারলাম, কে বা কারা স্যারের একমাত্র মেয়ে ঐশীকে দেবজানি খালের কাছে নিয়ে গিয়ে ধর্ষন করে, গলা টিপে হত্যা করে। হেড স্যারের ধারনা এখন তার মেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দেবজানি খালে কেউ গেলেই তাকে মেরে ফেলে। স্যার মেয়ের দুঃখে হু হু করে কাঁদতে থাকলেন। বাংলাদেশের সব জাগায়'ই দুষ্টলোক আছে। অবশ্য আগে দুষ্টলোকের সংখ্যা কম ছিল। এখন অনেক বেড়েছে। দুষ্টলোক কোথায় নেই? নবিজির দেশ মক্কা মদিনায়ও আছে।
আমার হাতে সময় নেই। আমাকে ঢাকা যেতে হবে।
দেবজানি খালের কোনো দোষ নেই। সেখানে কোনো ভূতও নেই। কালভার্টের কাছে দূর্ঘটনায় দুই একজন মারা গেছে। প্রতিদিন পৃথিবীর সব দেশেই একসিডেন্ট হয়। এবং মানূষের মৃত্যুও হয়। তাতে ভূতের কোনো হাত নেই। এই আধুনিক যুগে এসেও গ্রামবাসী আধুনিক হলো না। তারা আজও ভূতপ্রেত বিশ্বাস করে। হেড স্যারের মেয়ে ঐশীকে এই গ্রাম বা পাশের গ্রামের বখাটে ছেলেরা ধর্ষন করে হত্যা করেছে- এটা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই চিটাগাং বা ঢাকা শহর থেকে কেউ এসে দেবজানি খালে ঐশীকে ধর্ষন করেনি। পুলিশ আশে পাশের কয়েকটা গ্রাম খুব তালাশ করলে অপরাধীদের ধরা সম্ভব। আমি এই গ্রামে থাকলে আর পুলিশ আমাকে বললে আমি নিজেই ওদের ধরে থানায় দিতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ২:২৭