রোজিনা আপা দেখতে একেবারে সুবর্না মোস্তাফার মতোন।
ঠিক সেই রকম হাসি। কথা বলার ভঙ্গিও একই রকম। রোজিনা আপারা ছয় ভাই বোন। ভাই বোনের মধ্যে রোজিনা আপা'ই সবার বড়। এই ঢাকা শহরেই তারা ছোট্র একটা ভাড়া বাসায় থাকতেন। বাবা-মাসহ সবাই বেশ ভালো ভাবেই ছিল ছোট বাড়িটাতে। রোজিনা আপার বাবা ফলের ব্যবসা করতেন। প্রতিদিন তিনি দুই হাত ভরতি করে বাসায় ফল আনতেন ছেলে মেয়েদের জন্য। একদিন হুট করে রোজিনা আপার বাবা মারা গেলেন। রোজিনা আপার বাবা মারা যাওয়ার পর দেখা গেল- সংসার আর চলে না। তারা পাঁচ জন ভাই বোন। রোজিনা আপা ছাড়া সব ভাইবোন ছোট ছোট। সবাই স্কুলে পড়ে। শুধু মাত্র রোজিনা আপা অনার্স শেষ করেছে। বাবা মারা যাবার পর রোজিনা আপা আর লেখাপড়া করলেন না। সংসারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন।
অনেক গুলো টিউশনি যোগার করে ফেললেন।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টিউশনি করতে থাকলেন। সারা ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে টিউশনি করতে থাকলেন। টানা পনের বছর টিউশনি করলেন। ভাই বোনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নিজে বিয়ে করলেন না। অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তত দিনে ভাই বোন বড় হয়ে গেছে। প্রতিটা ভাই বোনকে রোজিনা আপা মাস্টার্স পাশ করিয়েছেন। প্রতিটা ভাই বোন এখন বড় বড় চাকরি করে। অনেক টাকা ইনকাম করে। এমন কি রোজিনা আপার সব ভাই বোন বিয়ে করে ফেলেছে, তাদের ঘরে সন্তানও এসেছে। একসময় তাদের সীমাহীন অভাব গিয়েছে। তিনবেলা ঠিকভাবে খাবারও জুটতো না। রোজিনা আপা শক্তভাবে সংসারের হাল না ধরলে এই সংসারটি ভেসে যেত।
একদিন আমি আর রোজিনা আপা বিকেলে রমনা পার্কে হাঁটতে গিয়েছিলাম।
আমার সামনেই এক বয়স্ক লোক রোজিনা আপাকে বললেন, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই রোজিনা। যদিও আমি বহু আগেই বিয়ে করেছি। আমার ছেলে মেয়ে সবাই আছে। এমন কি ছেলে মেয়েরও সবার বিয়েও হয়ে গেছে। আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি ছেলে মেয়েদের নামে লিখে দিয়েছি। এখন আমার টাকা পয়সা কিচ্ছু নেই। রোজিনা আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। প্লীজ আমাকে মানা করে দিও না। রোজিনা আপা আমাকে বললেন, আমাদের পরিচয় আজ ছয় মাস হলো। রাজীব আমি কি লোকটাকে বিয়ে করবো? আমি বললাম, পাগল হয়েছেন আপনি আপা? নো নেভার। লোকটা পা ছড়িয়ে বসে কাঁদলে লাগলো। রোজিনা আপা বললেন, আমি আজই বিয়ে করবো এবং তুই আমাদের বিয়ের সাক্ষী থাকবি।
রোজিনা আপা ওই বুড়োকে বিয়ে করে ফেললেন।
রোজিনা আপার ভাই বোন সবাই ব্যাপারটা বেশ সহজ ভাবেই নিলো। ভাই বোনেরা বলল, আপা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। সময় মতো বিয়েটাও করেনি। নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেনি। যাই হোক, বিয়ের এক বছর পর রোজিনা আপার ঘরে এক ফুটফুটে মেয়ে হলো। মেয়েয় বয়স যখন বারো বছর তখন রোজিনা আপার স্বামী মারা গেল। তারপর রোজিনা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখা গেল নানান অসুখ তার শরীরে। চিকিৎসার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। রোজিনা আপার হাতে কোনো টাকা নেই। তার ভাই বোনেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেউ তাকে সাহায্য করছে না। অথচ তিনি নিজের জীবন তেজপাতা করে, সীমাহীন কষ্ট করে টিউশনি করে ভাই বোনদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। মানুষ করেছেন। আজ তার ভাই বোন তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
সেদিন মহাখালি বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোজিনা আপার সাথে দেখা।
তাকে দেখে আমি চিনতেই পারি নি। কি সুন্দর ছিলেন রোজিনা আপা। খুব সুন্দর করে কথা বলতেন। হাসিটা ছিল ভীষন মিষ্টি। আমি ছোটবেলা তার কাছে অনেকদিন পড়েছিলাম। রোজিনা আপা কুচকুচে কালো হয়ে গেছেন। পুরো শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চেহারা ও পোশাকে দরিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। ভাই বোনেরা তার খোজ নেয় না। অথচ তার ভাই বোনেরা সবাই বড় বড় চাকরী করে। ছুটি কাটাতে যায় লন্ডন আমেরিকা। একসময় তিনি যাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াতেন, তারা রোজিনা আপাকে চিকিৎসার জন্য সাহায্য সহযোগিতা করছে। রোজিনা আপার মেয়ে বিবিএ করে বসে আছে। কোথাও চাকরী পাচ্ছে না। রোজিনা আপার জীবনটা আনন্দময় হওয়া দরকার ছিল। সারাটা জীবনই তার কষ্টে কষ্টে গেল ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ২:২৭