খিলগাঁও, বাগিচা এলাকায় আমরা আড্ডা দিতাম।
বাগিচা মসজিদের ঠিক উলটো পাশেই চুন্নুর চায়ের দোকান। এই চায়ের দোকানে একসময় রোজ আড্ডা দিতাম, আমরা চার পাচজন বন্ধু মিলে। বিকাল থেকে রাত আট টা পর্যন্ত আমাদের আড্ডা চলতো। কয়েক ঘন্টায় ৩/৪ শ' টাকা আমাদের চা সিগারেটের বিল হতো। চায়ের দোকানের পাশেই রেললাইন। রেললাইনের পাশেই বস্তি। খুব ঘনবসতি এলাকা। অবশ্য পুরো ঢাকা শহরই লোকজনে ভরা। কোথাও নিরিবিলি পরিবেশ নেই। বন্ধুদের নিয়ে চায়ের দোকানে চা সিগারেট খেতাম আর জমিয়ে আড্ডা দিতাম। আমাদের আড্ডার বিষয় ছিলো- রাজনীতি, সাহিত্য, মেয়েমানুষ, ইতিহাস এবং চলমান দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম গুলো। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমাদের আড্ডা চলতো।
দীর্ঘদিন ঐ এলাকায় আড্ডা দেওয়ার ফলে-
আশে পাশের সমস্ত লোকজনের সাথে আমাদের একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে রেললাইনের পাশে বস্তি এলাকায় লোকজনদের শীতের জামা, কম্বল ইত্যাদি দিতাম। ঈদের সময় ছোট বাচ্চাদের নতুন জামা কাপড় কিনে দিতাম, অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসার জন্য টাকাও দিতাম, এমন কি একজনকে একটা ভ্যানগাড়িও কিনে দিয়েছিলাম। এছাড়া রেললাইনে হাত, বা পা কাটাপরা অনেকেই আমাদের কাছে সাহয্যের জন্য আসতো। আমরা আমাদের সাধ্য মতো যাকে যা পাড়তাম, দিতাম। যাই হোক, এই রেললাইনে নিজের চোখে দেখা একটা ঘটনা আজ আপনাদের বলব। খুব মর্মান্তিক ঘটনা। দুঃখজনক ঘটনা। অশিক্ষা, ধর্মীয় গোড়ামি আর কুসংস্কার একটি জাতির জন্য অভিশাপ।
একদিন আমি একা রেললাইনে বসে আছি।
সময় আনুমানিক সকাল এগারোটা হবে। রেললাইনের পাশে বস্তিতে থাকা এক মহিলাকে জ্বীনে ধরেছে। মহিলার বয়স হবে ২০/২২ বছর। মহিলার দুই সন্তান আছে। স্বামী একজন রিকশাচালক। মহিলা বিকটভাবে চিৎকার দিচ্ছে, লাফাচ্ছে, অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছে, কাউকে কাউকে রেললাইন থেকে পাথর উঠিয়ে মারতে যাচ্ছে। ভয়াবহ অবস্থা। শেষমেষ চার পাঁচজন পুরুষলোক মহিলাকে ঝাপটে ধরে রেখেছে। মহিলা আর নড়াচড়া করতে পারছে না। তবে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়েই যাচ্ছে। এই বস্তির পাশেই একটা মাজারের মতো করেছে। লাল কাপড় বিছানো হয়েছে। সেখানে মানুষ দান খয়রাত করে। উক্ত মাজারের লোকজন মাঝে মাঝে ওরস টরস করে। মাহফিল করে। জিকির হয়,গান বাজনাও হয়। সেখান থেকে একজন পীর বাবাকে ডেকে আনা হয়েছে। জ্বীন তাড়াবার জন্য। জ্বীন তাড়াবার জন্য উনি অতি ওস্তাদ লোক। তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা।
পীর বাবা এসেই হুকুম দিলেন-
মহিলাকে বেঁধে ফেলো। মহিলার হাত এবং পা খুব শক্ত করে বাধা হলো। মহিলার শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে। চারিদিকে উৎসাহী জনতার বেশ ভিড়। এই ভিড়ের মধ্যে আমিও আছি। আছে, মহিলার স্বামী ও দুই সন্তান। পীর বাবা বললেন, এই মহিলার উপরে খুব খারাপ জ্বীন আসর করছে। পীর বাবা মহিলার গলা টিপে ধরলেন। বেশ কয়েকটা থাপ্পড় মারলেন। ফু-টু দিলেন। বললেন, যা তুই যা। এই মহিলার কাছ থেকে দূরে চলে যা জ্বীন। তা না হলে আজ তোকে শিক্ষা দিয়ে দিবো। জ্বীনে ধরা মহিলার মুখ দিয়ে তখন ফেনা বের হচ্ছে। যাই হোক, পীর বাবার হুকুমে একটা শুকনা মরিচ পুড়িয়ে আনা হলো। পীর বাবা জ্বীনে ধরা মহিলার নাকের ফুটো দিয়ে গরম শুকনা মরিচ ঢুকিয়ে দিলেন। জ্বীনে ধরা মহিলা কাটা মূরগীর মতো লাফাচ্ছে। যদিও ঠিকভাবে লাফাতে পারছে না। তার হাত পা বাধা। পীর বাবা, অদৃশ্য জ্বীনের উদ্দ্যেশে বললেন, এখন যা। না গেলে তোর জন্য আরো বড় শাস্তি অপেক্ষা করছে।
পীর বাবার শাস্তি এখানেই শেষ না।
এরপর পীর বাবা জ্বীনে ধরা মহিলার হাতের আঙ্গুল সর্বশক্তি দিয়ে উল্টো দিকে টেনে ধরলেন। সম্ভবত মহিলার হাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে গেছে। মহিলাটি আল্লাহ গো বলে বিকট চিৎকার দিলেন। পীর বাবা বলে চলেছেন, যাবি কিনা বল? যাবি? শরীর থেকে বের হবি? পীর বাবা মহিলার বুকের উপর দাড়ালো। মহিলা বিকট চিৎকারে আমার বুকে হাহাকার করে উঠলো। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম- থামেন। অনেক হইছে। আশে পাশের বেশ কয়েকজন মানুষ আমার উপর রেগে উঠলো। তারা মজাদার একটা খেলা দেখছিলেন। সেই খেলা তারা দেখতে চান। একজন মহিলা ব্যথায় ছটফট করছে। আর একদল মানুষ তা দেখে আনন্দ পাচ্ছে! মানুষ এত নিষ্ঠুর! আমি পীর বাবাকে বললাম, থামেন। অনেক হইছে। এই মহিলাকে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। তখন আশে পাশে থেকে আওয়াজ উঠলো। পীর বাবাকে তার কাজ করতে দেন। এটা ডাক্তারের কাজ না। এর আগেও পীর বাবা অনেক জ্বীনে ধরা রোগীর চিকিৎসা এইভাবে করেছেন। এবং তারা সেরে উঠেছেন।
(নোটঃ আমাদের দেশটা দরিদ্র। বেশির ভাগ লোকজন মূর্খ। এই অমানবিক আর মূর্খ লোকজনদের বেশির ভাগই আবার পিশাচ শ্রেনীর। মন মানসিকতা অতি নিম্মমানের। একজন মানুষের উপর অমানবিক অত্যাচার হচ্ছে। তা তারা দেখে আনন্দ পায়। বিনোদন পায়। অত্যাচারিত মানুষকে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। একজন সুস্থ মানূষেরও যদি হাতের আঙ্গুল পুরো শক্তি দিয়ে উলটো দিকে টানা হয়- সেই মানুষ ব্যথায় ছটফট করবে, বিকট চিৎকার দিবে। এবং তখন তাকে যা বলতে বলা হবে সে তাই বলবে। নাকের মধ্যে গরম শুকনা মরিচ ভরে দিলে কেমন লাগে তা কি কেউ ট্রাই করতে চান? হায় জ্বীন!)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:৩৬