'পার্থিব' উপন্যাসের লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
উপন্যাসটি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশি হয় ১৯৯৪ সালে। এর আগে ধারাবাহিক ভাবে 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে লেখক মানুষের নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন অত্যন্ত চমতকার ভাবে। 'পার্থিব' মানে- পৃথিবী-সংক্রান্ত, জাগতিক, ইহকাল বুঝায়। 'পার্থিব' বিশাল এক উপন্যাস। ৭১৩ পৃষ্ঠা। এত বড় উপন্যাস কিন্তু পড়তে একটুও বিরক্ত লাগে না। আমি উপন্যাসটি এবার নিয়ে তিনবার পড়লাম। যত পড়ি তত ভালো লাগে। লেখক সহজ সরল ভাবে কি সুন্দর করেই না লিখে গেছেন! আমাদের দেশে কি বর্তমানে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাথে তুলনা করা যায় এমন কোনো লেখক আছেন?
পুরো উপন্যাসে অনেক গুলো চরিত্র।
অথচ কোথাও একটুও জট পাকায় নি। এই বিশাল উপন্যাসে কে যে কেন্দ্রিয় চরিত্র সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। প্রতিটা চরিত্রই আমাকে মুগ্ধ করেছে। যখন যার অংশ পড়েছি তাকেই প্রধান চরিত্র বলে মনে হয়েছে। উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলেই বুঝা যায় লেখক খুব দরদ দিয়ে, পরম মমতায় চরিত্র গুলো তৈরি করেছেন। প্রতিটা চরিত্রের প্রতি লেখক সমান ভালোবাসা দেখিয়েছেন। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে এমন হয়েছে- আমি যেন চরিত্র গুলোর সাথে মিশে গিয়েছি। তাদের আনন্দে আনন্দ পাই। তাদের কষ্টে পাই। লেখকের লেখার গুনের জন্য মনে হয় উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্র যেন আমি নিজ চোখে দেখছি।
উপন্যাসটি শুরু হয় বিষ্ণুপদকে দিয়ে।
তিনি তার গ্রামের ভাঙ্গা ঘরের উঠানে বসে ভাবেন। ভাবতে থাকেন। তার ভাবতে বড় ভালো লাগে। বিষ্ণুপদ'র অনেক গুলো ছেলেমেয়ে। কিন্তু কোনো ছেলে মেয়ে'ই তেমন লেখাপড়া হয় হয়নি। তবে তার বড় ছেলে কৃষ্ণবিশ্বাস একজন পরিবেশ বিজ্ঞানী। তিনি তার বউ আর ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকেন কোলকাতায়। তিনি জীবনে সাফল্য পায় শতভাগ। পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরে বেড়ায় কৃষ্ণবিশ্বাস। বিখ্যাত সব ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দেন। কৃষ্ণবিশ্বাস একটা বই লিখেন 'ডার্লিং আর্থ’ প্রকাশিত হয় আমেরিকা থেকে। কৃষ্ণবিশ্বাসের এক বোনের নাম বীনাপানি। সে যাত্রাদলের সাথে জড়িত। বীনাপানির স্বামী নিমাই। নিমাই খুব ধার্মিক এবং সৎ লোক।
উপন্যাসে একটা চরিত্র আছে 'চয়ন' নাম।
বড় দুঃখী ছেলে। তার মৃগী রোগ আছে। ইংরেজি আর অংকে সে বেশ পটু। টিউশনি করে বেশ কয়েকটা। কৃষ্ণজীবনের মেয়ে সোহানীকে পড়ায়। টিউশনি করেই সে অনেক টাকা জমিয়ে ফেলে। এই টাকা দিয়ে সে পৃথিবীর ভালোর জন্য কিছু করতে চায়। চয়নের দাদা আর বৌদি আছে। তারা অনেক দুষ্টলোক। তারা চয়নকে অনেক অপমান করে। এমন কি খুব মারে। চয়নকে হাসপাতালে ভরতি হতে হয়। অনিন্দা নামের একটা মেয়ে চয়নকে খুব পছন্দ করে ফেলে। চয়নকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে নাটক সিনেমা দেখায়। চয়ন নাটক সিনেমা দেখে কোনো আনন্দ পায় না। চয়ন শুধু চায় কোনো রকমে বেঁচে থাকতে। বেঁচে থাকাটাই তার কাছে অনেক বড় ব্যাপার।
হেমাঙ্গ নামে দারুন একটা চরিত্র আছে।
হেমাঙ্গ বড় অদ্ভুত মানুষ। সে শুধু ইলেকট্রিক জিনিসপত্র কিনে। নদীর ধারে সে ছোট্র একটা বাড়ি কিনে। অফিস বাদ দিয়ে সে নদীর পাড়ের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকে। এদিকে হেমাঙ্গের বাবা মা চিন্তায় অস্থির। ঘটনা চক্রে হেমাঙ্গের রশ্মি নামে একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। রশ্মির সাথে বিয়ে হতে হতে হয় না। রশ্মি শিক্ষিতা আধুনিক মেয়ে। বিদেশ থেকে লেখাপড়া করেছে। হেমাঙ্গের এক বোন চারুশীলা সে মনে প্রানে চেয়েছিলো রশ্মির সাথে হেমাঙ্গের বিয়ে হোক। চারুশীলা অদ্ভুত এক নারী। তার স্বামী বিরাট ধনী। চারুশীলা কোনো উছিলা পেলেই বাসায় পার্টি দেয়। যাই হোক, অনেক নাটকীয়তার পর ঝুমকি নামে একটা মেয়ের সাথে হেমাঙ্গের বিয়ে হয়।
উপন্যাসে আরো অনেক চরিত্র আছে।
মনীশ। মনীশের স্ত্রী। তাদের ছেলে মেয়ে। কাকা, আপা, কুসুম, বাসন্তী, বাকা মিয়া, সজল, পটল, গোপাল। আরো অনেকে। বহু ঘটনা। বহু চরিত্র। এবং সবার সাথে সাথে সবার একটা কাকতালীয় ভাবে যোগাযোগ আছে। লেখক মানুষের জীবনের নানা টানাপোড়েন, উত্থানপতন, ঘাত-প্রতিঘাত ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুন হাতে। পার্থিব উপন্যাসের প্রথম লাইন হচ্ছে- "বাদামতলায় রামজীবনের পাকা ঘর উঠছে ওই ।" আর শেষ লাইন হচ্ছে- "এসো আমার সঙ্গে তুমিও কাঁদো, এসো কান্নায় একাকার হয়ে যাই। একাকার হয়ে যাই।" উপন্যাসটি বুঝিয়ে দেয়- জীবন কি। জীবনের অর্থ কি। মানুষ কি চায়। মানুষের শেষ পরিনতি কি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০২০ রাত ১:৩৬