somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ - পর্ব ১, ২, ৩

১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ৩:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ - পর্ব ১: ড. রমিত আজাদ

গত ১০ই আগষ্ট আমার কলেজের এক ছোট ভাইয়ের একটা ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো! তিনি লিখেছেন যে ক্যাডেট কলেজগুলোতে কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ অনেক কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এবং তিনি উষ্মা ও দুঃখ প্রকাশ করে প্রশ্ন রেখেছেন যে, 'এই হারে যদি কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ কমিয়ে আনা হয় তাহলে সেটা আর ক্যাডেট কলেজ থাকবে কি না?'
তিনি বর্তমানে একজন খ্যাতিমান তরুণ চিত্র পরিচালক। উনার নাম খিজির হায়াত। উনার কর্মদক্ষতার সাথে আমার পরিচয় আছে। আমরা দুজন একই টিমের হয়ে সাগর-পাহাড়ের ভূমি চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম, সেখানে উনার শিল্পানুরাগ ও কাজের নৈপূণ্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তিনি বলেছিলেন যে এটা উনার ক্যাডেট জীবনের কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ-এর সুফল।

ক্যাডেট জীবনের এই বিশেষ কার্যক্রমটির দ্বারা আমি নিজেও যারপরনাই উপকৃত হয়েছি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি যে ক্যাডেট কলেজ থেকে যদি এটা উঠে যায় তাহলে ক্যাডেট কলেজের উদ্দেশ্য ও সার্থকতা দুটিই ম্লান হয়ে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এই বিষয়ে ধারাবাহিক লিখবো।

অমর দার্শনিক প্লেটো তাঁর প্রস্তাবিত আদর্শ রাস্ট্র 'রিপাবলিক'-এ একটি ভিন্নধর্মী শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি শিশুদের নিয়মিত পড়ালেখার পাশাপাশি আরো দু'ধরনের শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন - ১। শিল্পকলা চর্চা ২। শরীর চর্চা। তিনি মনে করতেন যে এই তিন ধরনের শিক্ষা পেলে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরী হতে পারবে।

ছোটবেলায় আমি পড়তাম ঢাকার একটি সাধারণ স্কুলে। সেখানে নিয়মিত পড়ালেখার বাইরে আর তেমন কিছুর চর্চা ছিলোনা বললেই হয়। বছরে একবার স্পোর্টস ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ব্যাস এইটুকুই।

বাংলাদেশে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিলো ১৯৭৮/৭৯ সালে। বিতর্ক একটি সুস্থ চর্চা। এই সুস্থ চর্চাটি তখন দেশে জমজমাট হয়েছিলো। শিশু বয়সে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। সেখানে ঝলমলে ইউনিফর্ম পরিহিত তেজোদ্দীপ্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত স্মার্ট ক্যাডেটদের বিতর্কের স্টাইল দেখে মুগ্ধ হতাম, মনের কোনে প্রচ্ছন্ন বাসনা জেগেছিলো - 'ইস! আমিও যদি ওদের মতো হতে পারতাম!' সাধারণ স্কুলে পড়ার সময় সেই চর্চার সুযোগ পাইনি, ক্লাসের ছাত্ররা মিলে আয়োজন করেছিলাম বিতর্কের, ক্লাসরূমের ভিতরে নিজেরা নিজেরাই (নিজেরাই বক্তা, নিজেরাই সভাপতি, নিজেরাই বিচারক)। আমার অভিভাবকের দূরদর্শিতায় ও উপরওয়ালার কৃপায় আমার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছিলো। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কোচিং করতাম আশরাফুল হক স্যারের কাছে (বর্তমানে তিনি হলি-চাইল্ড স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা)। একবার স্যারের কাছে এক ছাত্রের মা এসে বললেন, "স্যার আমি শুনলাম, ক্যাডেট কলেজে নাকি পড়ালেখার চাইতে অন্যান্য এক্টিভিটিজ বেশী! তাহলে আর ওখানে দিয়ে লাভ কি? আসল জিনিস যে পড়ালেখা সেটাই যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে কেমন হলো?" এই কথা শুনে আমাদের প্রগতিশীল স্যার কিছুটা বিমর্ষ হলেন। স্যার বললেন, "দেখুন শুধু তো পড়ালেখা নয়, সবকিছু মিলিয়েই শিক্ষা। ক্যাডেট কলেজে সবকিছুই শিখানো হয়। সমালোচনা তো যেকোন কিছুরই করা যায়। দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য তো থাকতেই পারে। তবে আমার মতামত যদি জানতে চান, তো আমি বলবো পড়ালেখার পাশাপাশি আদার্স এক্টিভিটিজ-এরও প্রয়োজন আছে। তা নইলে শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ হয়না।" কোচিং-এ আমরা ছাত্ররা যারা বসে ছিলাম তারা সবাই ছিলাম কচি কচি শিশু, কিইবা বুঝি জীবনের? তবে আমাদের নিবেদিতপ্রাণ তরুণ শিক্ষক আশরাফুল হক স্যারের প্রজ্ঞাময় কথাগুলো খুব মনে ধরেছিলো।

যে সহ-পাঠক্রম কার্যক্রম-এর সুযোগ সাধারণ স্কুলে থাকতে পাইনি ক্যাডেট কলেজে প্রবেশের পর তার দ্বার খুলে গেলো। আমার আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, কলেজে প্রবেশের কয়েকদিন পরেই, একটি অনুষ্ঠানের শেষে, কলেজের প্রিন্সিপাল শ্রদ্ধেয় বাকিয়াতুল্লাহ স্যার বললেন, "দেখি আমার নতুন ছেলেরা কে কি পারে?" আমার সহপাঠি হেমায়েত গান গাইতে পারতো কিন্তু লজ্জ্বায় কুঁকড়ে গিয়ে গান গাইতে চাইলো না। অমনি ভাইস-প্রিন্সিপাল আবদুল্লাহ আল আমীন স্যার এসে এক ধমকে ওকে স্টেজে তুলে ফেললেন। তারপর সে সুর করে গাইলো "তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই"। ওর গান শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম, পরে আমরাই বলেছিলাম, "তুই এতো সুন্দর গান গাস আর লজ্জা পেয়ে স্টেজে উঠতে চাইছিলি না!" এভাবেই কলেজে সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করার প্রচেষ্টা চালাতেন শিক্ষকরা।

আমার সহ-পাঠক্রম শুরু হয়েছিলো উপস্থিত বক্তৃতা দিয়ে। দুরুদুরু বুকে উঠেছিলাম মঞ্চে। লটারিতে যা উঠবে তার উপরেই তাৎক্ষণিক বক্তব্য রাখতে হবে! ওরেব্বাস! পারবো কি আমি? তারপর আমি জুনিয়র মোস্ট ক্লাসের ক্যাডেট হয়েও সেদিন উপস্থিত বক্তৃতায় প্রথম হলাম। অনুষ্ঠান শেষে আমার বন্ধু মুক্তাদির আনন্দের অতিশয্যে আমাকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলো, সেইযে অনুপ্রেরণা পেলাম, আর থেমে থাকতে পারিনি। উপস্থিত বক্তৃতা, নির্ধারিত বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি, সাধারণ জ্ঞান, অভিনয়, কালচারাল কম্টিটিশন সব প্রতিযোগিতায়ই অংশ নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, পুরস্কারও পেয়েছি। এই জীবনে অনেক কিছুই শিখেছিলাম ক্যাডেট কলেজ থেকে। ওয়াল ম্যাগাজিনে কবিতা-গল্প-আর্টিকেল লেখা, ওয়াল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদও এঁকেছি, হাতে খড়ি দিয়ে শুরু করে কনফিডেন্স অর্জন পর্যন্ত গিয়েছি। এথলিট ভালো ছিলাম না, তবে পিটি কম্পিটিশন ও অবস্টাকল প্রতিযোগিতায় ভালো করতাম। এইখানেই ক্যাডেট কলেজের কৃতিত্ব - একটা ইভেন্টে ভালো না করো তো কি হয়েছে? তোমার হয়তো অন্য বিষয়ে ট্যালেন্ট আছে, সেই প্রতিভাকে কাজে লাগাও; কি চমৎকার দর্শন! শ্রদ্ধেয় ভাইস-প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মাসুদ হাসান স্যার বলেছিলেন (তিনি নিজে একজন খুব ভালো ক্রিকেট প্লেয়ার ছিলেন ও ন্যাশনাল ক্রিকেট টীমের প্লেয়ার সিলেকশন কমিটিতে ছিলেন), "পড়ালেখা তো সবাই করে, এটা কমোন বিষয়। কিন্তু পড়ালেখার পাশাপাশি আর কি কি পারো সেটা ইমপর্টেন্ট। আমি চাই প্রতিটি ক্যাডেট পড়ালেখার পাশাপাশি অন্ততপক্ষে একটি জিনিস পারবে।" তারপর স্যার একজনকে দাঁড় করিয়ে বললেন, "তুমি বলো, তুমি এক্সট্রা কি পারো?" শান্ত-নিরীহ ক্যাডেটটিকে দেখে স্যার হয়তো ভেবেছিলেন, ও এই বিষয়ে দুর্বল। স্যারকে অবাক করে দিয়ে সে উত্তর দিয়েছিলো, "স্যার আমি ক্রস-কান্ট্রিতে সেকেন্ড হয়েছি। স্যার খুব খুশি হলেন। বললেন, "ওয়েল ডান! আশা করি ভবিষ্যতে অলিম্পিকে তুমি দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।" অত উচ্চচিন্তা তখন আমরা তখন করতে পারতাম না, কিন্তু জ্ঞানী ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক আমাদের মধ্যে সেই প্রেরণা জাগিয়ে দিয়েছিলেন। স্যার আরো বলেছিলেন, "আজকালকার পড়ালেখা মানে তো মেমোরাইজিং ক্যাপাসিটি চর্চা। ওতে আমার আস্থা নেই। বরং পড়ালেখার পাশাপাশি কো-কারিকুলার এ্যাক্টিভিটিজ চর্চা করো, তাতেই মেধা চর্চা হবে।"

এই গত পরশু দিনও ঢাকার গুলশানে আমার ছেলেদের স্কুলে গিয়ে পরামর্শ দিয়েছি, যাতে তারা কো-কারিকুলার এ্যাক্টিভিটিজ চর্চা বাড়ায়। কারন হিসাবে বলেছিলাম যে, ভবিষ্যৎ পেশাগত জীবনে পড়ালেখার চাইতে ওটাই কাজে দেয় বেশী। স্কুলের প্রিন্সিপাল ও শিক্ষকরা আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুনেন ও গুরুত্ব দিয়ে তা কাগজে লিখে রাখেন। প্রিন্সিপাল বলেন, "অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা কারাতে সহ বেশ কিছু কো-কারিকুলার এ্যাক্টিভিটিজ শুরু করতে যাচ্ছি।" ক্যাডেট কলেজ নামক যে প্রতিষ্ঠান থেকে আমি এই মূল্যবান বিষয়টি শিখেছিলাম, আজ সেখান থেকেই নাকি, এগুলো তুলে দেয়া হচ্ছে। মনে খুব আঘাত পেলাম। কোন পথে যাচ্ছি আমরা? কোন পথে যাচ্ছে দেশ?
(চলবে)

কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ - পর্ব ২: ড. রমিত আজাদ

আমরা কথায় কথায় বলি 'বাংলাদেশী কালচার, বাংলাদেশী কালচার'; 'আমাদের বাংলাদেশী কালচার টিকিয়ে রাখতে হবে', ইত্যাদি, ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো এই বাংলাদেশী কালচার সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? আমি মাঝে মাঝে একটা টেস্ট নেই, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশ্ন করি, "কালচার কি?" বেশীরভাগই উত্তরটা দিতে পারেনা। তারপর বলি, "বাংলাদেশী কালচার কি?" অনেকেই উত্তর দেয়, "পহেলা বৈশাখ, পহেলা বৈশাখ"। আমি বলি, "ব্যস, এইটুকুই? বাংলাদেশী কালচারে আর কিছু নেই?" ছাত্র-ছাত্রীরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর বলি, "ঠিকআছে এই টপিকটার উপর লিখুন"। ওরা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে, তারপর বলে, "টপিকটা চেইঞ্জ করা যায়না? অন্য কোন কিছুর উপর লিখি?" আমি বলি, "না, এই টপিকটাই থাকুক, বুঝতে চাই, আমরা আমাদের কালচার সম্পর্কে কতটুকু জানি"। অনেককেই দেখি কলম ধরে অনেকক্ষণ বসে থাকতে। যারা লেখে তারাও খুব বেশী লিখতে পারেনা।

যাহোক, আমি মূল যে বিষয়টি বলতে যাচ্ছি তা হলো, প্রতিটি জাতিরই স্বকীয়তা থাকে। এই স্বকীয়তার সবলতা থাকে দুর্বলতাও থাকে। আমাদের জাতির এমন একটি দুর্বলতা হলো লাইব্রেরী কালচারের অভাব। এই বিষয়ে সরকারী উদ্যোগ কম থাকায় কোন কোন হৃদয়বান মানুষ ব্যাক্তি উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসে। এরকম একজন ব্যাক্তির সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম পত্রিকায়। তিনি বলেছেন, উনার টাকা-পয়সা না থাকায়, উনাকে ধনীদের কাছে যেতে হয়েছিলো টাকা সংগ্রহের জন্য। অনেকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে, আবার অনেকেই শূণ্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। এরকম একজন প্রশ্ন করেছিলো, "ভাই আপনার ঐ লাইব্রেরী দিয়ে কি হবে?" তিনি উত্তরে বলেছিলেন, "বিশ্বের বড় বড় সাহিত্য থাকবে ঐ লাইব্রেরীতে, আমাদের ছেলে-মেয়েরা ওগুলো পড়বে"। ঐ ধনাঢ্য ব্যাক্তি জবাবে বললেন, "দূরো, ঐগুলো পড়ে পড়ে শুধু শুধু পড়া নষ্ট"। উত্তরে তিনি বললেন, "ভাই আপনার কথার মধ্যে ব্যাকরণগত ভুল আছে। পড়ে পড়ে কখনোই পড়া নষ্ট হয়না।"
বিষয়টা ওখানেই। এখনো আমাদের দেশের একটা অংশ মনে করে, পড়ালেখা মানেই বোর্ডের কারিকুলামে যে টেক্সট বইগুলো আছে, শুধু ঐগুলোই যথেষ্ট। এর বাইরে আর যা কিছু আছে তা পড়ালেখা নয়। কিন্তু বোর্ডের ঐ বইগুলো কেবল শুরু (স্টার্টার) ওরা চিন্তা করতে শেখায়। উদ্দেশ্য - ঐ বইগুলো পড়ে পড়ে ছাত্র-ছাত্রীরা যেন একটি চিন্তার জগতে প্রবেশ করে, আর তারপর তারা যেন নিজেরাই পথ চলতে থাকে। বোর্ডের বইগুলো নিয়মিত লেখাপড়া, আর ওর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা যে পথে চলতে শুরু করলো ওগুলো কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ।

একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে এই পর্ব শেষ করছি। শিশু বয়সে একবার বাড়ীর কাছের একটা স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক মজার মজার জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছে, যার সাথে আমি ক্লাসরূমে কখনোই পরিচিত হতে পারিনি। একজনকে প্রশ্ন করলাম, "এটা কি?" উনি বললেন, "এটা টেলিগ্রাফ"। টেলিগ্রাফ শব্দটি বহুবার শুনেছি, কিন্তু দেখিনি কখনো। খুব আগ্রহ জাগলো, বললাম, "দেখান"। তিনি খুব যত্ন করে আমাকে দেখালেন, কিভাবে বিদ্যুতের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সংকেত পাঠানো যায়। আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনার এটা কি?" তিনি বললেন, "এটা কম্পিউটার"। আমি তো হতবাক! কম্পিউটার শব্দটি শুনেছি অনেক, তবে কখনোই চোখে দেখিনি। তবে টিভিতে দুএকবার দেখেছি। টিভির দেখা কম্পিউটার ও বিজ্ঞানমেলার এই কম্পিউটার-এর মধ্যে কোন মিলই খুঁজে পেলাম না। এই কম্পিউটার-এ দেখি একটা হার্ডবোডের উপর একটা সাদা আর্ট পেপারে দুই কলামে কিছু লেখা আর তাদের পাশে টর্চ লাইটের ছোট ছোট বাল্ব। আমি বললাম, "দেখান"। তিনি বললেন, "এই যে দেখো এই কলামে কিছু দেশের নাম আছে, আর এই কলামে আছে রাজধানীর নাম। তুমি কোন দেশের রাজধানীর নাম জানতে চাও?" আমি বললাম, "ইংল্যান্ড দেখান"। তিনি একটি তারের এক প্রান্ত ইংল্যান্ড লেখার পাশে ধরলেন, তার আরেক প্রান্ত অন্য এক জায়গায় ধরলেন, সাথে সাথে লন্ডন লেখার পাশে বাল্ব জ্বলে উঠলো। আমি অবাক হয়ে বললাম, "কি করে করলেন?" তিনি বললেন, "খুব সহজ"। তারপর বোর্ডের উল্টা পিঠে আমাকে দেখালেন। সেখানে কিছু তার দিয়ে সঠিক উত্তরের সাথে কানেকশন দেয়া আছে। বিদ্যুৎ খেলে গেলো আমার মগজে। মেকানিজমটা ধরে ফেললাম, এবং সাথে সাথেই মনে হলো এভাবে তো যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ-ও করা যাবে। ক্যালকুলেটর-কম্পিউটার তখন আমার কাছে আর কোন রহস্যই মনে হলো না। বিজ্ঞানমেলার এই দু'টি প্রজেক্ট দেখে আমি সেদিন মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছিলাম। ঐ কো-কারিকুলার এক্টিভিজিজ থেকে সেদিন আমি যা শিখেছিলাম ও যে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম তা আমি ইতিপূর্বে কোনদিন কোন ক্লাসরূম পাঠ থেকে পাইনি।
(চলবে)

কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ - পর্ব ৩: ড. রমিত আজাদ

ছোটবেলায় ঢাকায় পড়া সেই সাধারণ স্কুলটিতে একঘেয়ে ক্লাসের বাইরে আর তেমন কিছুই হতোনা। একদিন খবর রটে গেলো যে, 'স্কুলে যাদু দেখানো হবে'। খবরে শুনে তো হৈ হৈ রৈ রৈ। কবে কখন দেখানো হবে জেনে নিয়ে দিন-ক্ষণ সব মুখস্থ করে রাখলাম। নির্দিষ্ট দিনে সময়মতো স্কুলের মাঠে গিয়ে হাজির হলাম। আমাদেরকে মাঠে গোল করে বসানো হলো। স্যাররা সবাই চেয়ারে বসলেন আর আমরা বসলাম মাটিতে। সাব্বির নামে আমার একজন সহপাঠি ছিলো। শান্ত-শিষ্ট এই ছেলেটি আমাকে খুব ভালোবাসতো। ক্লাসে সবসময় আমার পাশেই বসতো। একই ক্লাসে পড়তো আমার এক কাজিন, নাম রনি (ছদ্মনাম)। মাঠে আমার বামপাশে বসেছিলো সাব্বির আর ডানপাশে বসেছিলো রনি। অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি আমরা, যাদু দেখবো বলে। এর আগে লাইভ যাদু কখনো দেখিনি। তবে আমাদের ছেলেবেলার সবচাইতে সেরা যাদুকর জুয়েল আইচের যাদু দেখতাম টেলিভিশনে। বাঙালীদের মধ্যে পিসি সরকারের পর তিনিই সম্ভবত বড় ও জনপ্রিয় যাদুশিল্পী। এবার চোখের সামনে যাদু দেখবো সেই রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। একটু পরে পিসি সরকার বা জুয়েল আইচ-এর মত নবাবী আমলের ঝলমলে পোষাক পড়ে প্রবেশ করলেন যাদুকর। তিনি বিখ্যাত কেউ ছিলেন না তাই তার নামটা আর মনে রাখা হয়নি। তবে তিনি শুরুতে কয়েকটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন, যা আমাদের শিশুমনে গভীর প্রভাব ফেলেছিলো, এবং তার দরকার ছিলো। কথাগুলো ছিলো এরকম, "অনেকেই মনে করে থাকে যে, যাদু মানে অলৌকিক কিছু, মন্ত্র-তন্ত্রের ব্যাপার। আমি বলি যে, না যাদু সেরকম কিছু নয়। এটা আসলে এক ধরনের বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেই কিছু কৌশল প্রয়োগ করে এগুলো দেখিয়ে মনোরঞ্জন করা হয়। আপনাদের মধ্যে থেকে হয়তো বুদ্ধিমান কেউ কেউ আমার যাদু ধরেও ফেলতে পারবেন। আমি অনুরোধ করবো, যারা আমার যাদু ধরতে পারবেন, তারা অনুগ্রহপূর্বক ঐ মুহূর্তে হৈচৈ না করে, শো শেষে আমার সাথে দেখা করুন। আমি আপনাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবো।" আমরা উনার কথা শুনে রীতিমত বিস্মিত হলাম, ইতিপূর্বে কোন যাদুকরের মুখ থেকে এরকম শুনিনি। যাদু বলতে তো মন্ত্র-তন্ত্রই বুঝতাম! যাহোক, শুরু হলো উনার খেলা। মজার মজার অনেক কিছু তিনি দেখালেন তিনি। যে কয়টি যাদুর কথা মনে আছে তার কয়েকটি উল্লেখ করছি - লাল ও নীল রঙের দুটি রুমাল বেধে একটা কাঠের বাক্সের একটি প্রকোষ্ঠে রাখলেন, তারপর একটা হলুদ রঙের একটি রুমাল রাখলেন আরেকটি প্রকোষ্ঠে, এরপর বাক্সটির উপর একটি টোকা দিলেন, ব্যাস খোলার পর দেখা গেলো প্রকোষ্ঠে হলুদ রুমালটি নেই, এরপর অন্য প্রকোষ্ঠ খুলে দেখালেন সেখানে লাল আর নীল রুমালের মাঝখানে হলুদ রুমালটি বাধা। করতালীতে ফেটে পড়লাম আমরা। এরপর একটি খালি সিলিন্ডার দেখালেন, তারপর সেটা ঢেকে দিলেন; আবার ঢাকনা খুললেন, সিলিন্ডার আর খালি নেই, সেখানে দুটি জড়ির মালা; ঐ মালা দুটি পড়িয়ে দিলেন হেডস্যার ও এসিসটেন্ট হেডস্যার-এর গলায়। একটি আঙটি রাখলেন ছোট একটি কাঠের বাক্সে। বাক্সের দরজা বন্ধ করে ঝাকি দিয়ে আমাদের শোনালেন যে ভিতরে আংটিটি আছে। তারপর বাক্সের দরজা খুললেন, ওমা আংটি ভিতরে নেই! বেমালুম গায়েব! কোথায় গেল আংটিটি? তিনি একটি আস্ত কাঁচা পেপে দেখালেন, এরপর ছুড়ি দিয়ে ওটার মুখের কাছে কাটলেন। ওমা পেপের ভিতরে সেই আংটি। আবারো করতালীতে ফেটে পড়লাম আমরা। একটা কাঁচের গ্লাস ভরতি ছাই নিয়ে এলেন; তারপর একটি চোঙ দিয়ে গ্লাসটি ঢাকলেন; চোঙটি উঠানোর পর দেখা গেলো, গ্লাসের ভিতর কোন ছাই নেই, বরং গ্লাস ভরতি সাদা মুড়ি; আমাদেরকে খেতে দিলেন সেই মুড়ি; যাদুর মুড়ি, কিন্তু খেতে আসল মুড়ির মতই লাগলো! আবারো করতালী। এরকম আরো কিছু যাদু দেখিয়ে, হঠাৎ হাতে একটি শাণিত ছুড়ি নিয়ে তিনি বললেন, "এবার একটা ভয়ংকর যাদু দেখাবো। আমার একজন সাহসী ছেলে দরকার।" এরকম একটা আহবানের অপেক্ষা করছিলাম। হিরো হওয়ার ইচ্ছে জাগলো। আমি চট করে দাঁড়িয়ে গেলাম। একপা এগিয়েছি অমনি বন্ধু সাব্বির খপ করে আমার হাত ধরে ফেললো, করুন স্বরে বললো, "রমিত যাইয়ো না, তোমার গলা কাইটা ফালাইবো।" আমি বললাম, "ধুর! কিসের গলা কাইটা ফালাইবো?" ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ফাকা জায়গাটির ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবার দৃষ্টি তখন আমার দিকে। ওখানে উঁচু ক্লাসের অনেকেই ছিলো, তারা না গিয়ে ছোট শিশু এগিয়ে এসেছে, এই দেখে যাদুকরও একটু অবাক হলেন। যাহোক, তিনি ধরে নিলেন যে আমি সাহসী। আমাকে বললেন, "মাটিতে শুয়ে যাও"। গেলাম শুয়ে মাটিতে। এরপর যাদুকর একটা রুমাল দিয়ে আমার চোখ ঢেকে দিলো। এবার আমার ভয়ভয় করতে শুরু করলো, ভাবছি, 'ও রুমাল দিয়ে আমার চোখ ঢাকলো কেন? তবে কি ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে?' যাহোক তখন আর পিছু হটার পথ ছিলো না। হিরোইজম দেখিয়েছি, এরপর কাপুরুষতা করি কি করে? যাদুকর বললো, "আমি এই পেপেটিকে তিন টুকরো করবো। তারপর আপনাদের মধ্যে থেকে একজন এসে কালো কাপড় দিয়ে আমার চোখ বাধবেন। অন্য একজন এসে পেপের টুকরা তিনটি ছেলেটির গায়ের উপর বিভিন্ন অংশে রাখবেন। আমি চোখ বাধা অবস্থায় ছুড়ি দিয়ে ছেলেটির গা থেকে পেপের টুকরোগুলো তুলে নেবো।" সবাই শুনলাম ভয়ে ইশ ইশ করছে। আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। তারপর বুঝলাম, যাদুকরের চোখ বাধা হয়ে গেছে। আমি অনুভব করলাম যে, একজন এসে আমার শরীরের তিন জায়গায় তিনটি পেপে-টুকরা রাখলো, একটা ছিলো আমার হাটুর একটু উপরে, এক টুকরো আমার বুকে, আরেক টুকরো আমার বাম হাতের উপর। এরপর আমি মাটিতে শায়িত চোখ ঢাকা অবস্থায় শুধু শুনলাম, আহ-ওহ-ইশ-গেলো-ওরে ইত্যাদি ধরনের আতংকের আওয়াজ। আমি ভীত হলেও শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম, আর অনুভব করলাম, যাদুকর নির্ভুলভাবে একে একে তিনটি টুকরোই তুলে নিলেন। তারপর বিপুল করতালীর আওয়াজ, ও যাদুকরের সহকারী এসে আমার চোখের উপরের রুমালটি তুলে নিলো। আমি যখন উঠে দাঁড়িয়েছি, তখনও দেখি সবার দৃষ্টি আমার দিকে। স্বয়ং এসিসটেন্ট হেডমাস্টার স্যার বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছেন, তাঁর চোখ বলছে, 'ছেলেটা এত সাহস করলো কি করে?' ফিরে এসে যখন আমার জায়গায় বসলাম বন্ধু সাব্বিরের মুখে তখন ঝলমলে হাসি, যেন তার বন্ধু কিছু জয় করে ফিরেছে। আমার কাজিন রনিও আমাকে অক্ষত পেয়ে গাল ভরে হাসছে।

সেদিনের যাদু শো মনে ভীষণ দাগ কাটলো। ঐ অস্বাভাবিক ঘটনাটির জন্য তেমন নয়। আমার মনে একটি বাসনা বাসা বাধলো, 'ইশ আমি যদি ওর মতো যাদু জানতাম!' দিনরাত শুধু ভাবছি কি করে যাদু শেখা যায়। এরমধ্যে একদিন দেখলাম, আমার চাচা তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের তাসের যাদু দেখাচ্ছেন। মজার-মজার কিছু যাদু দেখিয়ে তিনি বাহবা কুড়ালেন। এবার আমি ধরে বসলাম চাচাকে, আমাকে তাসের ম্যাজিক শিখাতেই হবে। আমার আবদার তিনি না রেখে পারলেন। তিনটি ম্যাজিক শিখিয়ে দিলেন আমাকে। ব্যাস, আর যায় কোথায়? দাদীমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনে আনলাম এক সেট কার্ড। ঘরে বসে তুমুল প্র্যাকটিস করলাম কয়েকদিন। তারপর একদিন স্কুলে নিয়ে গেলাম ঐ তাস। বন্ধুদের বললাম, "আজ স্কুলের পর থাকবি, তোদের যাদু দেখাবো।" একজন বললো, "এহ যাদু দেখাবে!" আমি বললাম, "আগে থাকনা স্কুলের পর, তারপর দেখবি।" যাদের আগ্রহ ছিলো তারা কয়েকজন রয়ে গেলো, বলা বাহুল্য যে তাদের মধ্যে বন্ধু সাব্বির ও আমার কাজিন রনিও ছিলো। মজা করে ওদের দেখালাম তাসের ম্যাজিক। সবাই হতবাক! বন্ধু সাব্বির তো রীতিমতো গর্বিত। তারপর সবাই যার যার বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু আমার কাজিন রনি রয়ে গেলো। আমি বললাম, "কিরে তুই বাড়ী যাবি না?" ও বললো, "না।" আমি বললাম, "না কেন?" রনি বললো, "আগে যাদু শেখা তারপর যাবো।" এরকম আবদার ও করে বসবে তা ভাবিনি। ভাবলাম ক্লাসের মধ্যে আমি একাই কাপ্তান থাকবো। এখন দেখছি ও ভাগ বসাতে এসেছে। নিজের কাজিন, আমার সুখ-দুঃখের সাথী, ওর অনুরোধ না রাখি কিভাবে? অগত্যা শিখালাম তাকে তাসের যাদু। খুব খুশী হলো ও।

এর কয়েক মাস পরে ওদের এলাকার এক ছেলের মুখে শুনলাম রনি এলাকায় নাম করেছে, ভালো যাদুকর হয়েছে। এলাকায় এখন ওকে বলে যাদুকর রনি। শুনে তো আমি বিস্মিত। তিনটা তাসের ম্যাজিক দেখিয়ে নামজাদা যাদুকর? ছেলেটিকে বললাম, "রনি কি যাদু দেখায় রে?" ছেলেটি উত্তর দিলো, "অনেক রকম। ছাই থেকে মুড়ি বানায়। পেপের ভিতর থেকে আংটি বের করে। হাত থেকে পয়সা উধাও করে ফেলে। দুই রুমালের মধ্যে তৃতীয় রুমাল পাঠিয়ে দেয় অজানা পথে।" আমি মনে মনে বললাম, "ওরেব্বাস! এতকিছু শিখলো কোথায়?"
গেলাম ওদের বাড়ীতে বিষয়-আশয় দেখতে। এলাকায় ওদের বাড়ীর কাছাকাছি আসতে আমাকে এক ছেলে জিজ্ঞেস করে, "কার বাইত্তে যাইবেন?" আমি বলি, "রনিদের বাড়ীতে।" ছেলেটি বলে, "যাদুকর রনি?" আমি বললাম, "হ্যাঁ"। মনের মধ্যে একটা হিংসাও কাজ করছিলো, 'ব্যাটা আমার কাছ থেকে তাসের ম্যাজিক শিখলি, এখন তুই হয়ে গেলি যাদুকর!" ওদের বাড়ীতে গেলে আংকেল-আন্টি খুব আদর করলো আমাকে। ওর বাবা সেই আমলের একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ, উঁচু কর্মকর্তা, তবে সৎ বলে সাধারণ জীবনযাপন করেন। উনাকে একবার কে যেন বলেছিলো, "ভাইসাহেব এত কষ্ট করেন কেন? একটু এদিক-সেদিক করলেই তো অনেক টাকার মালিক হতে পারেন।" উত্তরে আংকেল বলেছিলেন, "ঘুষের টাকায়, ছেলেমেয়ে মানুষ হয়না"। সেই অতি সজ্জনের ছেলে রনি। ওরা অনেক ভাইবোন, সবাইই খুব ভদ্র ও লেখাপড়ায় খুব ব্রিলিয়ান্ট। রনিও খুব ভদ্র কিন্তু লেখাপড়ায় ওর মন বসতো না। ওকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন আংকেল। রনিকে গিয়ে বললাম, "তুই নাকি বড় যাদুকর হয়েছিস?" রনি লাজুক হাসলো। আমি বললাম, "দেখা আমাকে তোর যাদু।" ও কয়েকটি যাদু আমাকে দেখালো। স্কুলের সেদিনের সেই যাদুকরের মতই অনেকটা। এই দেখে মনে মনে আমার মেজাজ খিচরে গেলো। বললাম, "কি করে শিখলি, এইসব যাদু?" ও বললো, "একটা বই কিনেছি, পিসি সরকারের লেখা। ঐটা পড়ে শিখেছি।" এবার বুঝলাম কাহিনী। বললাম, "যাদু শেখার প্রতি আগ্রহ জন্মালো কবে?" ও বলো, "যেদিন যাদু শো দেখলাম সেদিন। তবে আমি ভেবেছিলাম, ওটা আমাদের কম্ম নয়। আমরা যাদু শিখতে পারবো না। কিন্তু তুই যেদিন তাসের যাদু দেখালি তখন বুঝলাম যে না, কঠিন কিছু না, চাইলে আমরাও যাদু শিখতে পারবো। এরপর চেষ্টা-চরিত্র করে আমি অন্যান্য যাদুও শিখলাম।" এবার আমি ওকে ধরে বসলাম, "শেখা আমাকে যাদুগুলো।" ও বললো, "তোর কাছ থেকে প্রথম যাদু শিখেছি আমি। তোকে শিখাবো না মানে? এখনই সব যাদু শিখিয়ে দিচ্ছি।" ওর বিনয়ে তো আমি মুগ্ধ, এরকম হবে ভাবিইনি। পটাপট শিখে নিলাম সব যাদু। মনে পড়লো স্কুলের ঐ যাদুকরের কথা, "যাদু হলো এক ধরনের বিজ্ঞান। এখানে কোন মন্ত্র-তন্ত্র নেই সবই কৌশল।" এরপর এ্যামেচার হিসাবে মাঝে-সাঝে যাদু দেখাতাম। বিদেশের মাটিতে স্টেজেও যাদু দেখিয়েছি।

এতো গেলো আমার কথা। এবার আমার কাজিন রনির কথা বলি। পড়ালেখায় ওর মন নেই। ওকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আংকেল। উনার বিদূষী-বুদ্ধিমতি ভাবীর কাছে আসলেন পরামর্শ চাইতে, "ভাবী, সবগুলো ছেলেমেয়ে পড়ালেখায় ভালো। ওরা ডাক্তারী-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। আর রনি ছেলেটা টেনেটুনে এস.এস.সি. পাশ করলো। ওকে নিয়ে কি করি বলুন তো?" আংকেলের বিদূষী-বুদ্ধিমতি ভাবী বললেন, "রনি ভালো ছেলে। পড়ালেখায় হয়তো ও কোন আগ্রহ পায়না। তবে শুনলাম ও নাকি ভালো যাদু দেখাতে পারে। তার মানে ওর টেকনিকাল দিকে ঝোঁক আছে। ভাই, আপনি এক কাজ করেন, ওকে ইলেকট্রনিক্স-এর ডিপ্লোমা কোর্সে দিয়ে দিন, কোর্সটা দেশে নতুন চালু হয়েছে, আমার মনে হয় ঐ লাইনে ও ভালো করবে।" আংকেল উনার ভাবীর পরামর্শ অনুযায়ী তাই করলেন। আর যায় কোথায় ঝপঝপ করে সবকিছু শিখে নিলো রনি। ওর সাথে একদিন দেখা, বললাম, "কিরে তুই নাকি ইলেকট্রনিক্সে মাস্টার হয়ে গিয়েছিস?" ও লাজুক হেসে বললো, "খুব ইন্টারেস্টিং, আমি এখন যে কোন টেলিভিশন-রেডিও-ক্যাসেট প্লেয়ার-ভিসিআর-ইত্যাদি নিমিষেই সারাতে পারি। পার্টস জোড়া লাগিয়ে বানাতেও পারি।" যাহোক ওর প্রতিভা এই লাইনে ভালো কাজ করলো। শুনেছি ও এই লাইনে ব্যবসা করে শুনাম ও অর্থ দুটাই করেছে।

আমার এখন বারবার মনে পড়ছে ঐদিনের সেই ম্যাজিক শো। একটি কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ একটি মানুষকে দিক-নির্দেশনা দিলো। একটি মানুষের জীবন পাল্টে দিলো! আমি তো জানি কেবল একজনার কথা, হয়তো সেদিনের সেই যাদু-শো আরো অনেককেই দিক-নির্দেশনা দিয়েছে! বেঁচে থাকুক কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ!
(চলবে)

লেখা তিনটি ইতঃপূর্বে ১১, ১২ ও ১৪ ই আগষ্ট ফেইসবুকে আমার টাইমলাইনে প্রকাশ করেছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১০:০৮
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×