ফারুক তুরাণ
উঠনে রিক্সা চলে আসছে। জোরে বেল বাজাচ্ছেন ড্রাইভার মামা। ড্রাইভার মায়ের বংশের কেউ না তবুও মামা ডাকা। এই ডাকার মধ্যেও দরদ আছে। বেল বাজানোর অর্থ একটা শাড়ি এনে দিতে হবে মামাকে। রিক্সার চারপাশ শাড়ি পেছিয়ে একটা ভ্রাম্যমাণ কুঠির বানানো হবে। এই কুঠিরে আবৃত রাখা হবে একজন নারীর লজ্জা, সম্মান এবং গ্রামীণ মুসলিম সংস্কৃতি।
হাফ পেন্ট পরে আমি রেডি।
.
সারা শরীরে তেলে মাখামাখি। অতিরিক্ত উচ্ছাসে পড়ে গিয়ে হাটুতে যে মাটি লেগেছিল সেটা শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। ধোয়ার সময় নাই । তার থেকে রিক্সার গলা ধরে আরও তিন চারবার উঠনে ছক্কড় দেওয়া আনন্দের।
গলায় স্বর্ণের মোটা তাবিজ, কটকটে জামদানী শাড়ি, হাতে ছত্রাক্রান্ত ২০-১০০ টাকার নোট।
.
মা রিক্সায় উঠতে বাবাকে যে মুল্যবান কথা বললেন তা হল সন্ধ্যা হলে যেন মোরগ হাঁস ঘরে তোলা হয়। হাঁসের বাচ্চাগুলো অবশ্য রিক্সার পিছনে বেধেঁ নেওয়া হয়েছে। হাঁসের বাচ্চা দেখাশুনা করা বাবার সামর্থের বাইরে। মা নিজে এসব দেখাশুনা করবে। আমার এসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। আমার মাথাব্যাথা হচ্ছে আমার পকেটে মা টাকা রাখতে দিয়েছেন। এই টাকা দেখাশুনা করা এবং রিক্সায় বসে প্লান করা মাকে নয় ছয় বুঝিয়ে কিছু মেরে দেয়া। টাকা পয়সার ব্যাপারে মা আমাকে কলম কেনার টাকা পর্যন্ত বিশ্বাস করেন। আজ এই ঝুঁকি নেওয়ার কারন বুঝা যাচ্ছে না।অতিরিক্ত আনন্দে মানুষ ছোটখাটো ব্যাপার মাথায় রাখেনা। মা এই মুহুর্তে মহা সুখি।
.
রানি কুঠির চলছে । আমি কুঠিরে না। বাহিরে গদির নিচে বসে আছি। পা ঝুলিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। রিক্সার পেডেল এর জন্যে পারছিনা। মাথা নিচু করে রাস্তা দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। তাতে নিজেকে স্থির মনে হয়। রাস্তাও একটা জীবন পাবে। কিন্তু হাঁসের বাচ্চারা অস্থির। ওদের খারাপ লাগা ভাল লাগা বুঝা যাচ্ছে না। আমরা নানা বাড়ি বাবার বাড়ি যাব , ওদের আনন্দিত হওয়ের কোন কারন নেই।
.
মামা রিক্সা থামান। আমার জুতা নাই । মামা যেখান থেকে জুতা খুঁঁজে আনলেন সেটা রিক্সা থেকে মিনিট পাঁচেকের পিছনের পথ। এক পাটি পড়েছে বলে কেউ নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখায় নাই। পায়ে ঝিঁ ধরেছিল কখন খুলে গেছে কে জানে।
.
সন্ধ্যা হয়ে আসছে । আমরা নানা বাড়ির কাছাকাছি । কেউ একজন দূর থেকে আমাদের দেখে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলে। আলি হবে মনে হয়। ওর কোমরের নিচের অংশ কিছুটা সরু মাথা বড় হওয়ায় দুর থেকে চেনা সহজ । আমি কুঠিরের ভিতরে ঢুকে গেলাম। নামার সময় একটা ভাব থাকবে। রিক্সা উঠনে গিয়ে থামবে । মামা রিক্সা উঠানে রেখে দূরে গিয়ে দাঁড়াবে । অনেক মহিলা, বাচ্চাকাচ্চা জড় হবে।
.
কুঠির থেকে আগে মাথা বের করতে হবে। মাটিতে পা রাখতে যে কথা শুনতে হবে। কিরে তোর বাপে তোরে খাওন দেই না, এরকম শুকাই গেছস কেন? এটা প্রশ্ন না গ্রামীণ ফর্মালিটি। যে যার সম্পর্ক মত এসব ফর্মালিটি রক্ষা করবে । সবশেষে নানু আমাকে নিয়ে সিন্দুকের উপর বসিয়ে মাথায় রেখে বলবে তোর বাবা কেমন আছে? এটাও প্রশ্ন না এটা আকুতি । আমার অনাগ্রহ দেখলে হাতের আঙ্গুল টিপে দিবে। টিপতে টিপতে জানতে চাইবে তোর বাপের শরীর কেমন, তোরে আদর করেনি, তোদের পুকুরে মাছ আছে নি, কি খাস।নানুর এখন বয়স হয়েছে। শরীরে শক্তি কম। চোখের পানি ধরে রাখার ক্ষমতা নাই। সামর্থের সব দিয়ে চোখ মুচে নিচ্ছেন। ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১:৫৯